বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত ‘স্থগিত’ রাখার কথা শেষ পর্যন্ত সংসদে ঘোষণা করল মনমোহন সরকার। আজ পূর্ব নির্ধারিত সর্বদল বৈঠকের পর লোকসভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় সংসদে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের’ সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতি গড়ে না ওঠা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হবে। তবে এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। বরং সংসদের অচলাবস্থা কাটাতে বিরোধীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ’ (স্টেকহোল্ডার) বলতে তিনি সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও বোঝাতে চাইছেন। “কারণ মুখ্যমন্ত্রীদের এ ব্যাপারে আলোচনায় সামিল করা না হলে এই নীতি রূপায়ণ করা সম্ভব নয়।”
রাজনৈতিক সূত্রে বলা হচ্ছে, সরকার ‘সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ’ এই শব্দগুলো ব্যবহার করে ভবিষ্যতে বেরোনোর পথ করে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিল। কিন্তু গত কাল মধ্যরাত পর্যন্ত এই শব্দগুলো নিয়ে সরকার এবং বিরোধী নেতৃত্বের মধ্যে টানাপোড়েন চলে। অভিধান বের করে ‘স্টেকহোল্ডার’ শব্দের অর্থ খোঁজা হয়। কিন্তু বিরোধীরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ভবিষ্যতে খুচরো প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার যে দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করবে, তা স্পষ্ট ভাষায় সংসদকে জানাতে হবে। আজ সকালে সর্বদল বৈঠকেও সেই দাবি ওঠে। তার পর বাধ্য হয়েই কেন্দ্রে প্রধান শাসক দলকে সেই দাবি মেনে নিতে হয়। শীতকালীন অধিবেশন শুরুর পরে এই প্রথম সচল হয় সংসদও।
কিন্তু অতঃকিম? রাজনীতি থেকে শিল্পজগৎ, সকলের কাছে আজ বড় প্রশ্ন হল, তা হলে ভারতে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির ভবিষ্যৎ কী? বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়া সময়ের চাহিদার নিরিখে কতটা পিছিয়ে থাকবে?
খুচরো প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার কৃতিত্বের পুরোটাই নিয়ে চলে গিয়েছে তৃণমূল। তা সত্ত্বেও সেই কৃতিত্বের ভাগ পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া বাম নেতারা আজ আহ্লাদিত। কারণ সীতারাম ইয়েচুরিদের মতে, সরকার যে ভাবে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য সংসদে কথা দিয়েছে, তার পর খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সম্ভাবনা এখন অথৈ জলে। কারণ, রাজনৈতিক সর্বসম্মতির আশু কোনও সম্ভাবনা নেই। তা ছাড়া, সব থেকে বড় বাধা রয়েছে সরকারের মধ্যেই, এবং তিনি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে ২০১২ কেন, ইউপিএ-র দ্বিতীয় মেয়াদেই খুচরোয় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত আর হচ্ছে না। সামগ্রিক ভাবে বিভিন্ন মহলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতও সেটাই।
যদিও প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ শিবির এবং কংগ্রেস নেতাদের একাংশ এ কথা মানতে এখনও রাজি নন। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তথা বৃহত্তম শরিক তৃণমূল কংগ্রেসের আপত্তির বিষয়টি স্বীকার করে নিলেও তাঁদের পাল্টা যুক্তি রয়েছে। সরকারের এক শীর্ষ নেতার কথায়, এ যাত্রায় সরকারের যে মুখ পুড়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শেষ হওয়া মাত্রই প্রধানমন্ত্রী কৃষক সংগঠন, শিল্পমহল এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক ডাকবেন। তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন ডেকে মনমোহন বোঝাবেন, কোনও রাজ্যের আপত্তি থাকলে তাঁরা খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি থেকে বিরত থাকুন। কিন্তু যে রাজ্য তা করতে চাইছে তাকে সুযোগ করে দিন। তার পর প্রতিবেশী রাজ্যে তা রূপায়ণের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক তুল্যমূল্য বিচার করে দেখুন।
আবার সরকারের এক শীর্ষ নেতার কথায়, প্রণববাবু আজ সংসদে সব দলের সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছেন ঠিকই। কিন্তু তাতেও কৌশল রয়েছে। প্রতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। তা ছাড়া, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কৃষক এবং ব্যবসায়ী সংগঠন রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করার অর্থই দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা। প্রধানমন্ত্রী আলোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মতির পথ খোঁজার দায়িত্ব প্রণববাবুকেই দিয়েছেন।
কংগ্রেসের আর এক নেতার কথায়, উত্তরপ্রদেশের ভোটই এ ব্যাপারে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে। রাজ্যে যদি ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হয়, এবং মায়াবতী বা মুলায়মকে যদি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়তে হয়, তা হলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সমীকরণ বদলে যাবে। সংসদে তখন ভোটাভুটিতে সরকার তথা কংগ্রেসের অসুবিধা
হবে না। অর্থাৎ মুলতুবি প্রস্তাবে যে ভোটাভুটির ভয় এখন কংগ্রেস পাচ্ছে তা তখন আর থাকবে না। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের প্রচার কমিটির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল আজ তো এও বলে দেন, “উত্তরপ্রদেশে ভোটের প্রচারে কংগ্রেস খুচরো বিতর্ককে অস্ত্র করবে। এটাই বলবে যে কংগ্রেস এর মাধ্যমে কৃষক এবং মধ্যবিত্তকে সুরাহা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু বিরোধীরা হতে দিল না। তবে কংগ্রেস ও সরকারের সম্মিলিত অবস্থান ভবিষ্যতে কী হবে, তার ইঙ্গিত কাল স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাল এ ব্যাপারে কংগ্রেস সংসদীয় দলের বৈঠকে সনিয়া গাঁধীর উপস্থিতিতে আলোচনা হবে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিজেপি আজ খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করতে নারাজ। দলের শীর্ষ নেতারা চান, যত শীঘ্র সম্ভব এই বিতর্ক থেকে বেরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যেতে। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, দলের অনেকেই এই বিদেশি লগ্নির পক্ষে। তা ছাড়া, কৃষকদের মধ্যেও বিজেপি-র জনভিত্তি রয়েছে। শিল্পমহলের চাপও রয়েছে বিজেপি-র উপর। ফলে বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে সুর চড়া করার ঝুঁকিও রয়েছে। তবে তাঁর বক্তব্য, আজকের পর বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সম্ভাবনা যে একেবারেই শেষ হয়ে গেল, তা বিজেপি-র অনেকেই মনে করেন না। রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সর্বসম্মতির যে আশ্বাস প্রণববাবু দিয়েছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা যে বাধ্যতামূলক নয়, তা লোকপাল বিলের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে। ফলে সরকার যে এ বিষয়ে সুযোগ খোঁজার চেষ্টা এবং জনমত গঠনের প্রয়াস চালিয়ে যাবে সে ব্যাপারেও বিজেপি-র সন্দেহ নেই। |