চিকিৎসার উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে বিভিন্ন গ্রামীণ হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে রোগীদের অভিযোগের অন্ত নেই। বেহাল পরিকাঠামোর জন্য বহু স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই মানুষ সুষ্ঠু চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের সাহেবখালি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আধুনিক সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা পরিষেবা মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। কারণ যিনি চিকিৎসা পরিষেবা দেবেন সেই চিকিৎসক সমস্যাতেই ভুগছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এলাকার মানুষের অভিযোগ, প্রত্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ার কারণেই তাঁদের প্রতি এই বঞ্চনা।
উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার হিঙ্গলগঞ্জে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া কালিন্দী নদী। নদীর একদিকে সাহেবখালি অন্যদিকে বাংলাদেশ। বড় সাহেবখালি, দুলদুলি, ছোট সাহেবখালি, চাঁড়াখালি, পুকুরিয়া, রমাপুর, কাঁঠালবেড়িয়া-সহ লাগোয়া এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বাস। বাসিন্দাদের অধিকাংশই তপশিলি জাতি-উপজাতি সম্প্রদায়ের। দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। এত মানুষের চিকিৎসা পরিষেবা বলতে একদিকে ১০ কিলোমিটার দূরে যোগেশগঞ্জ, অন্যদিকে নদী পেরিয়ে ১৫ কিলোমিটার দূরের সন্দেশখালির খুলনা হাসপাতাল। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত সাহেবখালি অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা ভেবে ১৯৫৫ সালে এখানে গড়ে ওঠে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু তৈরির পরে ঠিকমতো পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে না বলে বার বার অভিযোগ ওঠায় কয়েক বছর পরে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। টানা ১২ বছর বন্ধ থাকার পরে ফের চালু হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু সেই একই অভিযোগে একদিন ক্ষুব্ধ জনতা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দেন। ১৯৯৭ সালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার পরে কেটে যায় আরও তিন বছর। |
শেষ পর্যন্ত নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন। মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০০ সালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তালা খুলে শুরু হয় নতুন করে সাজিয়ে তোলার কাজ। কারণ হিসাবে বলা হয়, বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সাহায্যে গড়ে তোলা হবে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এক কোটি টাকা খরচ করে নতুন ভাবে গড়ে তোলা হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। তৈরি হয় ঝকঝকে মোজাইক, টাইলস বসানো চিকিৎসকদের আবাসন। সাজিয়ে তোলা হয় বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগ, লেবার রুম। ব্যবস্থা হয় ১৫টি শয্যার। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে শুরু করে অস্ত্রপচারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এমনকী বিদ্যুতের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থাও করা হয়। সর্বক্ষণের জন্য একজন চিকিৎসক এবং ফার্মাটিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মীর থাকার ব্যবস্থা হয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এমন ভোল বদলে স্বাভাবিক ভাবেই উৎফুল্ল হয়েছিলেন এখানকার মানুষ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত বাসিন্দারা এর পর থেকে বিপদে আপদে সব সময় চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন ভেবেছিলেন।
সাহেবখালির মানুষের সেই ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। ২০০৯ সালে এই সব অঞ্চলে আছড়ে পড়ল আয়লা। আয়লার জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি, জমির ফসল খুইয়ে মানু, যখন দিশাহারা। এক কাপড়ে নদীবাঁধের উপরে এক ফালি পলিখিনের নীচে কোনওরকমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি রোগভোগে নাজেহাল। যখন তাঁদের কাছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র হাতে পাওয়া চাঁদের মতো। তখনই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একমাত্র চিকিৎসক নিরাপত্তার অভাবের কারণ দেখিয়ে চলে গেলেন। ফের তালা পড়ল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। আয়লার পরে যখন এলাকায় ঘন ঘন পা পড়ছে বিভিন্ন দলের নেতা, মন্ত্রীদের তখন তাঁদের কাছে ফের সমস্যার কথা তুলে ধরেন বাসিন্দারা। অসহায় দুর্গত মানুষগুলির একটাই দাবি ছিল, একজন চিকিৎসক চাই। দাবি-দাওয়ার পরে পাওয়া গিয়েছে চিকিৎসক। তবে এ বার আর সর্বক্ষণের জন্য নয়, শুধুমাত্র দিনের বেলায় কয়েক ঘণ্টার জন্য।
ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হালও খারাপ হয়েছে। মেরামতির অভাবে ছাদ থেকে জল পড়ে। দিনের পর দিন তালাবন্ধ হয়ে থাকায় চিকিৎসার জন্য আনা দামি যন্ত্রপাতিতে মরচে ধরেছে। দরজা-জানলার ভাঙা কাচ আর সারানো হয়নি। সর্বত্র বাসা বেঁধেছে চামচিকি। দেখভালের অভাবে চুরি যাচ্ছে জিনিসপত্র। যে চিকিৎসক আসেন তিনি দুপুরে চলে যান। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বর গরু। ছাগলের বিচরণের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপর সন্ধের পর বেড়ে যায় অসামাজিক কার্যকলাপ। রাত বিরেতে কেউ অসুস্থ হলে মানুষ নিরুপায়। রোগী ভর্তির ব্যবস্থা না থাকায় সাপে কাটা, ডায়েরিয়া কিংবা আন্ত্রিকে আক্রান্ত রোগীকে ছুটতে হয় বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরের হাসপতালে। এই অবস্থায় পথে রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার।
স্থানীয় বাসিন্দা রঞ্জিত দাস, উজ্জ্বল মণ্ডল বলেন, “বিশ্বব্যাঙ্কের টাকায় হাসপাতালের নতুন ভবন তৈরি হয়। আনা হয়েছিল চিকিৎসার নানা সরঞ্জাম। এখানকার মানুষ ভেবেছিল এ বার তাঁদের সুবিধা হবে। আর সব সময় অন্যত্র ছুটতে হবে। কিন্তু আয়লার পরে যে ভাবে চিকিৎসক চলে গেলেন তাতে আমরা হতাশ। একজন চিকিৎসকের ব্যবস্থা হলেও তিনি সপ্তাহে তিন-চার দিন আসেন। ঘণ্টাখানেক থেকে চলে যান। কিন্তু রোগবালাই কি সময় বুঝে আসে। রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ হলে কী হবে তা কি কেউ ভেবে দেখেছে?”
বর্তমানে যে চিকিৎসক রয়েছেন সেই পঙ্কজ মণ্ডল বলেন, “স্বাস্থ্যকর্তাদের নির্দেশে পঞ্চায়েত ও ব্লকে ডিউটি দিতে হয়। সাহেবখালিতে যত ক্ষণ রোগী থাকে তত ক্ষণ তাঁদের চিকিৎসা করি।” মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক অসিত পাণ্ডে বলেন, “আয়লার পরে ওই এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। পানীয় জলেরও অভাব রয়েছে। তা ছাড়া গ্রামের হাসপাতালে যেতে চাইছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। সেই কারণেই সাহেবখালিতে সর্বক্ষণের জন্য চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না।”
কিন্তু মানুষের অসুখ-বিসুখ তো আর এ সব মানবে না। বিশেষ করে রাতে কেউ অসুস্থ হলে কি হবে? এ প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মিলল না স্বাস্থ্যকর্তার কাছে। |