পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু রাজ্যে এ বৎসর কৃষকরা অতিশয় বিপন্ন। কেহ বহু লোকসান করিয়া ধান বিক্রয় করিতে বাধ্য হইতেছেন, কেহ ক্ষতি স্বীকার করিয়া বিক্রয় করিতে চাহিয়াও ক্রেতা পাইতেছেন না। ইহার মূলে এ বারের অতিরিক্ত ফলন, না কৃষি বিপণনের পরিকাঠামোর অভাব, না কি অকস্মাৎ নীতি বদলাইয়া ধান ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতা বাদ দেওয়া, তাহার নির্ণয় হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট। দরিদ্র কৃষকের স্বার্থে যে সকল নীতি প্রণয়ন করা হইয়াছে, সেগুলি তাঁহাদের কাজে লাগে নাই। তাঁহারা স্বল্প মূল্যে ধান বিক্রয় করিতেছেন এবং অতিরিক্ত দামে তাহাই বাজার হইতে কিনিয়া খাইতেছেন। সরকারের কোন কোন ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের কারণে এই পরিস্থিতির সূচনা হইয়াছে, তাহা বিবেচনা করা প্রয়োজন। সেই বিবেচনা কোনও গড়পড়তা কৃষকের গড়পড়তা উৎপাদন-বিক্রয়ের দিকে তাকাইয়া অঙ্ক কষিয়া করিলে ভুল হইবে। যে রাজ্য, যে জেলা-মহকুমার যেমন প্রয়োজন, তেমনই সিদ্ধান্ত হইতে হইবে। পঞ্জাবের বড় চাষিদের চাহিদা ভাবিয়া নীতি করিলে পশ্চিমবঙ্গের ভাগচাষির তাহা কাজে লাগিবে না। অথচ একই নীতি সকল রাজ্যের সকল চাষির উপর চাপাইবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। তেমনই বিপুল নীতিপ্রণেতাদের আত্মপ্রত্যয়। তাই নীতি কাজ করিতেছে কী না, কোথায় সমস্যা হইতেছে, সীমিত প্রয়োগে তাহা পরীক্ষা করিবার কথাও তাঁহাদের মনে হয় নাই। তাই সংকট যখন দেখা দিল তখন তাহা সর্বত্র সর্বব্যাপী হইল।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষিচিত্রের দিকে দেখিলে স্পষ্ট হয়, কয়েকটি বিষয়ে এখনই পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। কৃষি উৎপাদনের খরচ এ রাজ্যে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি। এই খরচে চাষ করিতে হইলে কৃষি লাভজনক হইবে না, বা অতি সামান্য লাভ থাকিবে। তাহার একটি প্রধান কারণ, এ রাজ্যে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি হইয়াছে অতি সামান্য। তাহার ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষককে সেচের খরচ বহন করিতে হইতেছে। সেচের খরচ কমাইতে আরও কার্যকর সেচব্যবস্থা নিশ্চিত যদি না করা যায়, তাহা হইলে কৃষির খরচ কমিবে না। ইহা যদি বাস্তবচিত্র হয়, তাহা হইলে সারের উপর সরকার যে বিপুল ভর্তুকি দিতেছে, তাহা নিরর্থক নহে কি? মানুষের টাকা নষ্ট হইল, কিন্তু কৃষক লাভ করিল না ভ্রান্ত নীতি এমনই অবস্থার সূচনা করিতেছে। আর সর্বভারতীয় স্তরে চিন্তার প্রয়োজন সরকারি খাদ্য ক্রয়ের নীতি লইয়া। রেশন ব্যবস্থার জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য ক্রয় করিয়া সরকার কৃষি-উৎপাদনের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহিয়াছে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণার উদ্দেশ্য তাহাই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাইতেছে, গরিব চাষি সেই মূল্য পাইতেছে না। অন্য দিকে, রেশন ব্যবস্থা হইতে লব্ধ খাবার গরিব পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে পারে নাই। সরকারি প্রকল্পে গর্ভবতী মা, দরিদ্র শিশুকে অতি নিম্নমানের চাল সরবরাহ করা হইতেছে। বিপুল পরিমাণ শস্য গুদামে পড়িয়া নষ্ট হইতেছে। সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা না করিয়া, সরকারি নীতি শস্যের বাজারে সরকারি ক্রয় আরও বাড়াইয়া কৃষকদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করিতে চাহিতেছে। ইহাতে বর্তমান ব্যবস্থার ছিদ্রগুলি আরও বড় হইতেছে মাত্র। অতএব কৃষি, খাদ্য, পুষ্টি, এই তিনটি বিষয়েরই নীতি ঢালিয়া সাজার প্রয়োজন। আর তাহা করিতে হইবে দরিদ্র পরিবারকে কেন্দ্রে রাখিয়া। |