খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগ্নির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যে দৃঢ় ও অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করিয়াছেন এবং সনিয়া গাঁধীর নির্দেশে কংগ্রেস দলও যে-ভাবে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াইয়াছে, তাহা স্বাগত। এই দৃঢ়তা আরও অনেক আগেই দেখানো উচিত ছিল। সংসদে এই সিদ্ধান্তের সমস্বর প্রতিবাদ করা ছাড়াও দিনের পর দিন সংসদের কাজকর্ম ভণ্ডুল করিয়া বিরোধীরা এবং ইউ পি এ-র শরিক ও সমর্থক দলগুলিও যে চাপ সৃষ্টির পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন, তাহা ক্ষুদ্র রাজনীতি ছাড়া কিছু নয়। সংসদ অচল করার এই কাণ্ডের পিছনে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের কোনও ভূমিকা নাই, জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করারও কোনও সদিচ্ছা নাই। কংগ্রেস দল প্রাথমিক পর্যায়ে এই সমবেত উচ্চৈঃস্বর বিরোধিতায় সম্ভবত কিছুটা ঘাবড়াইয়া গিয়াছিল, দলের কোনও কোনও মহল হইতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থের প্রশ্ন তুলিয়া উৎপাদক ও ক্রেতাদের স্বার্থ অগ্রাহ্য করার অপচেষ্টাও হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিচলিত না হইয়া দৃঢ় ভাবে বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষে সওয়াল করেন। এখন দলও তাঁহার পিছনে।
প্রসঙ্গত ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী পক্ষের অনাস্থাজ্ঞাপক সংসদীয় আচরণ ও তাহার প্রেক্ষিতে মনমোহন সিংহের দৃঢ় অবস্থানের কথা মনে পড়িবে। সে-দিনও প্রধানমন্ত্রী চুক্তি, সপক্ষে দাঁড়াইয়া সরকার পতনের ঝুঁকিও বরণ করিয়া লইয়াছিলেন। মনমোহন সিংহ যে অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদৌ লালকৃষ্ণ আডবাণী কথিত দুর্বল রাজনীতিক নহেন, আবারও তাহা প্রমাণিত। তুলনায় আডবাণীর দলটির ভূমিকা কিন্তু রীতিমত দুর্ভাগ্যজনক, বস্তুত লজ্জাকর। পরমাণু চুক্তির মতো খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগ্নির প্রশ্নেও ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্বের নীতিগত অবস্থান ছিল আজকের ইউ পি এ সরকারেরই অনুরূপ। দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে পর্যন্ত খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বানের কর্মসূচি নথিভুক্ত হইয়াছিল। অথচ আজ বিজেপি নেতারা সংসদের ভিতরে-বাহিরে বামপন্থীদের সহিত গলা মিলাইয়া সেই বিনিয়োগের বিরোধিতায় অবতীর্ণ। নিছক রাজনীতি, বিরোধিতা করিতে হইবে বলিয়া বিরোধিতা করা, যে কোনও মূল্যে শাসক দলকে কোণঠাসা করার ব্রতই এই আচরণের একমাত্র ব্যাখ্যা। তবে এই রাজনীতির নেপথ্যে রহিয়াছে আর এস এস নামক সংগঠনের চাপ, যাহারা কার্যত সর্ব ক্ষেত্রেই বিদেশি লগ্নির, এমনকী প্রযুক্তিরও বিরোধী। নাগপুর হইতে আসা এই চাপই বিজেপির এজেন্ডা স্থির করিয়া দেয়। কে দলের সভাপতি হইবেন, কে-ই বা প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী, কে লোকসভা ও রাজ্যসভার নেতা সকলই নাগপুরের ছাঁকনি দিয়া নির্ণীত হয়। খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগ্নির নির্বাচনী অঙ্গীকারও সেই ছাঁকনিতে আটকাইয়া গিয়াছে।
বিজেপি একাই অবশ্য এমন উল্টা রথের যাত্রী নয়। অনুগমনকারীদের মধ্যে কেন্দ্রের ইউ পি এ সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক তৃণমূল কংগ্রেসকেও দেখা যাইতেছে। পশ্চিমবঙ্গের এই শাসক দল প্রতিবাদে মুখর। সে-অধিকার তাহার বিলক্ষণ আছে। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধেও এমন প্রতিবাদ শুনা গিয়াছিল, যদিও সেই বৃদ্ধি কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল না। যাহাই হউক, সেই প্রতিবাদ সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের মতো কোনও চরম পদক্ষেপের দিকে যায় নাই। এ বারও কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খাদের কিনারে লইয়া গিয়া সেখান হইতে ইউ পি এ সরকারকে বাঁচাইবার প্রকল্প রচিয়াছেন? তিনি কি খরিফ ও রবিশস্য উৎপাদক চাষির অতিরিক্ত মূল্য-প্রাপ্তি এবং ক্রেতাদেরও সুলভে কৃষিপণ্য কিনিবার সুবিধা অপেক্ষা মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীদের মঙ্গলচিন্তায় ব্যস্ত? তবু যদি তিনি ইহাকে ভ্রান্ত নীতি মনে করেন, তাহা কার্যকর না করিলেই হইল। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত কোনও আইন নয়, খুচরায় বিদেশি লগ্নি রাজ্যের মোট একান্ন রকম ছাড়পত্র পাইলে তবেই সম্ভব। তৃণমূল মুখ্যমন্ত্রীর খাদ্য দফতর না-হয় তখন একটি ছাড়পত্র আটকাইয়া দিবেন। কিন্তু সে জন্য সংসদে নিজ সরকারের বিরুদ্ধাচরণে বিরোধীদের অনাস্থায় শামিল হওয়া কি উচিত? রাজ্যবাসীর আশা, রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের স্থিতি ও অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের জন্যই মমতা ইউ পি এ-র সঙ্গে থাকিবেন। |