অবশেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারলেন মনমোহন সিংহ। আজ ফোন করে মুখ্যমন্ত্রীর মায়ের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। সরকারের অবস্থান সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছেন শরিক দলগুলির সঙ্গে বৈঠকেও। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও বরফ এখনও গলেনি বলেই তৃণমূল সূত্রে খবর। যার ইঙ্গিত দিয়ে আজ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। ফলে বিরোধীদের মুলতুবি প্রস্তাব মেনে নিয়ে সংসদে ভোটাভুটিতে যাওয়ার আগে দুশ্চিন্তায় কংগ্রেস নেতৃত্ব।
এটা ঠিক যে, মুলতুবি প্রস্তাব পাশ হয়ে গেলে সরকার পড়ে যাবে এমন নয়। কিন্তু সরকারের নৈতিক কর্তৃত্ব যে দুর্বল হয়ে পড়বে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কংগ্রেসের অনেকেই মনে করছেন, এই ভোটাভুটিতে হেরে গেলে মনমোহনের পক্ষে আর সরকার চালানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিশেষ করে কমনওয়েল্থ গেমস, টু-জি স্পেকট্রাম দুর্নীতি নিয়ে যখন সরকার কোণঠাসা। তার ঘাড়ের উপর প্রবল ভাবে নিঃশ্বাস ফেলছেন অণ্ণা হজারে।
তৃণমূলের একটি সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, মমতা যে ভাবে সংসদের ভিতর-বাইরে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, তাতে তাঁর পক্ষে মুলতুবি প্রস্তাবের বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। তিনি দলীয় সাংসদদের ভোটাভুটির সময় অনুপস্থিত থাকতে বলতে পারেন বলে তৃণমূল সূত্রে ইঙ্গিত। কিন্তু সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি বা রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো সহযোগীরা যে ভাবে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরোধী, তাতে তৃণমূল গরহাজির থাকলেও ভোটে হেরে যেতে পারে সরকার।
অন্য দুই শরিক নিয়ে কংগ্রেসের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। টু জি-কাণ্ডের পর কংগ্রেসের উপর নির্ভর করতেই হচ্ছে ডিএমকে-প্রধান করুণানিধিকে। সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও সংসদে ‘অন্য রকম’ কিছু না-করার আশ্বাস ইতিমধ্যেই দিয়েছেন তিনি। এনসিপি প্রকাশ্যেই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টিকে সমর্থন করেছে। ফলে বাকি রইলেন মমতা। সরকারের সম্মান রক্ষার প্রশ্নে তাঁর সাংসদ সংখ্যা (এ ক্ষেত্রে ১৯, কেননা এসইউসি-ও কংগ্রেস বিরোধী) কংগ্রেসের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাই মমতার উপরে যতই ‘ক্ষোভ’ থাক, আপাতত তাঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে মুলতুবি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিতে রাজি করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। আজ দুপুরে শরিক দলগুলির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকেও তৃণমূলকেই সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে খবর। যদিও সেখানে মনমোহন এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সামনে দলের অনড় অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, তৃণমূল চায় বিদেশি লগ্নি আনার সিদ্ধান্ত সরকার প্রত্যাহার করে নিক। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দলের বিশ্বাস রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, মনমোহনই প্রধানমন্ত্রী পদে যোগ্যতম প্রার্থী। এ ক্ষেত্রে তিনি শরিক দলের আবেদন মেনে নেবেন, এমনটাই আশা করছে তৃণমূল।
সরকারের পক্ষ থেকেও অবশ্য তাদের যুক্তি তৃণমূলকে বোঝানোর চেষ্টা অব্যাহত। মনমোহনের পরে সনিয়া গাঁধীও প্রয়োজনে মমতার সঙ্গে কথা বলবেন। কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা কথা বলছেন সুদীপের সঙ্গে, প্রণববাবু যোগাযোগ করছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ের সঙ্গে। সব মিলিয়ে যে বার্তা তৃণমূল নেত্রীকে কংগ্রেস দিতে চাইছে তা হল খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি আনার ফলে কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে। সিপিএম এবং বিজেপি অপপ্রচার করছে। সেই ফাঁদে পা না-দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
তবে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব এ-ও মনে করছেন যে, তৃণমূলের এই বিরোধিতা শুধুমাত্র খুচরো ব্যবসা কেন্দ্রিক নয়। সামগ্রিক ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতির প্রতিফলন। তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে তাঁকে প্রথমে গুরুত্ব না-দেওয়া থেকে শুরু করে রাজ্যের আর্থিক প্যাকেজের মতো বিষয়গুলি নিয়ে এই মতপার্থক্য ক্রমশ বেড়েছে। তাই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই ‘আপৎকালীন’ সময়ে মমতার মন জয়ের চেষ্টা শুরু হয়েছে। গত কালই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজির মৃত্যু নিয়ে মমতার পাশে এসে দাড়িয়েছেন। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তোলা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ভুয়ো সংঘর্ষে নয়, গুলির লড়াইয়েই মৃত্যু হয়েছে কিষেণজির। সেই চেষ্টায় কী ফল দেয়, সেটাই দেখার। |