অজানা কোনও ‘বিষক্রিয়ায়’ ভোর হতেই করলায় ভেসে ওঠে রাশি রাশি মাছ। বোরোলি, ট্যাংরা, পুঁটি, খলসে তো বটেই, ৫-১০ কেজি ওজনের অসংখ্য বোয়াল মাছও ভাসতে দেখে প্রথমে হইচই শুরু করেন প্রাতর্ভ্রমণকারীরা। সেই খবর চাউর হতেই করলা নদীর পাড়ে জনতার ভিড়। মাছ নিতে হুড়োহুড়ি।
সোমবার এমনই ঘটনা ঘটেছে জলপাইগুড়ি শহরে। শহরের বুক চিরে যাওয়া করলার পাড় বরাবর প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেখা গিয়েছে সেই দৃশ্য। ১০ কেজি ওজনের বোয়াল মাছ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন কেউ। কেউ ‘জাম্বো’ আকারের আমেরিকান রুই বুকে চেপে বাড়ির দিকে ছুটছেন।
|
করলায় ভেসে ওঠা মরা মাছ। জলপাইগুড়িতে সন্দীপ পালের তোলা ছবি। |
নানা জনের কাছ থেকে খবর গেলেও পুরসভা, পুলিশ-প্রশাসন প্রথমে বিষয়টি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করলে টনক নড়ে পুরসভা-পুলিশ-প্রশাসনের। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্য পুলিশের ডিজিকে বিষয়টি জানিয়ে ‘নাশকতার’ পিছনে কে বা কারা তা খুঁজে বার করার নির্দেশ দেন। মুখ্যমন্ত্রীর তরফে জলপাইগুড়ির ডিএম-এসপি-র কাছে নির্দেশ যায়, যে ভাবেই হোক ‘বিষাক্ত মাছ’ বাজারে যাওয়া কিংবা খাওয়া আটকাতে হবে। পুরসভাকেও অভিযানে নামার নির্দেশ দেওয়া হয়। দিনভর চেষ্টা চালিয়ে পুলিশ-পুরসভা ও প্রশাসন প্রায় আড়াই কুইন্টাল মাছ উদ্ধার করেছে। তবে প্রশাসনের একাংশের আশঙ্কা, অন্তত ১০-১৫ কুইন্টাল মাছ উদ্ধার করা যায়নি। পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু পুলিশের কাছে নাশকতার আশঙ্কা করে অভিযোগ দায়ের করেছেন। নদীর জলের নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছে পুলিশ।
এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ভীষণ উদ্বেগজনক ঘটনা। খবর পাওয়া মাত্র অফিসারদের বলেছি, কেউ যেন ওই মাছ না-খান তা নিশ্চিত করতে হবে। জলে বিষক্রিয়ার ফলে ওই ঘটনা হয়ে থাকতে পারে বলে শুনেছি।
|
মাছ মারার কায়দা |
|
কীটনাশক: নদীর উজানে কীটনাশক ঢেলে
মাছ মারা হয়। এক দেড় কিলোমিটার দূরে
স্রোতের বিপরীতে পেতে রাখা জালে তা ধরা হয়। |
|
বিদ্যুৎ: হুকিং করে বা
জেনারেটরের মাধ্যমে নদীর জলে বিদ্যুৎ চালিয়ে মাছ মারা হয়। |
জিলেটিন: নদীতে জিলেটিন বিস্ফোরণ ঘটিয়েও মাছ মারা হয়। |
|
আড়াল থেকে কে বা কারা শয়তানি করছে তা খুঁজে বার করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছি। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়ার কথাও পুলিশকে বলেছি। দোষীদের চিহ্নিত করে রাজ্য সরকার কড়া ব্যবস্থা নেবে।”
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশও নাশকতার অভিযোগটি গুরুত্ব দিয়েই দেখছে। রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “জিলেটিন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মাছ মারার ঘটনাও আগে ঘটেছে। এটা নাশকতা হতে পারে। আমরা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু করেছি।” পুলিশ সূত্রের খবর, তদন্তে নেমে নদীর ধারে বেশ কিছু বক ও সাপ মরে থাকতে দেখা গিয়েছে।
মৎস্য দফতরের জলপাইগুড়ি জেলার মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক সুমন সাহা বলেন, “কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যে পরিমাণ মাছের মৃত্যু হয়েছে তাতে স্পষ্ট, জলে বিষ বা রাসায়নিক মেশানো হয়েছে। বেশ কিছু মৃত মাছের নমুনা পরীক্ষার জন্য কলকাতায় পাঠিয়েছি।”
যে মাছ ভেসে উঠেছে তা খেলে কী হতে পারে? উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞ শেখর চক্রবর্তী জানান, বিষক্রিয়ার কারণে মাছ ভেসে উঠলে তা রান্না করে খেলেও নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। যেমন, বমি, পেটের রোগ, জ্বর, চর্মরোগএমনকী আলসারও হতে পারে। জলপাইগুড়ি পুরসভা অবশ্য ওই মাছ যাতে কেউ না-খান, সে জন্য মাইক নিয়ে শহর জুড়ে প্রচারে নেমেছে।
|