ভয়েই কাঁটা মা
ছেলেটা কোথায় জানেন, মনটা যে বড় কু-ডাক দিচ্ছে
সামনের খামারে কাটা ধান গাদা করে রাখা। এ দিক-ও দিকে পড়ে ধান কাটার যন্ত্র, পাওয়ার টিলার, পাম্প।
খামারের সামনে কয়েক বিঘায় নানা রকম ফলের গাছ। দোতলা মাটির বাড়ির উঠোনে বসে লাউডাঁটা কাটছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধা।
বাড়িতে ঢুকতেই এগিয়ে আসেন এক মাঝবয়সী মহিলা “আপনি কে?” খবরের কাগজ থেকে এসেছি শুনেই তিনি ঘুরে তাকান বৃদ্ধার দিকে। কথাটা তাঁরও কানে গিয়েছিল। চোখে জল এসে যায় বৃদ্ধার। কাঁপতে থাকে গলা। আকুল স্বরে জানতে চান “ছেলেটা কোথায় আছে জানেন?”
ছেলের নাম অসীম মণ্ডল ওরফে তিমির। কিন্তু পুলিশের খাতায় তিনি ‘আকাশ’। মাওবাদীদের রাজ্য সম্পাদক। একদা কিষেণজি-ঘনিষ্ঠ, কিষেণজির মতোই অঙ্কে অনার্স।
বুড়িশোলের জঙ্গলে কিষেণজির ‘খতম’ হওয়ার খবরটা তাই চন্দ্রকোনার উত্তর ফুলচক গ্রামের এই বাড়িতে এসেছে একটু অন্য ভাবে। বৃদ্ধা শঙ্করী মণ্ডল আর তাঁর স্বামী কার্তিক মণ্ডলের রাতের ঘুম গিয়েছে। দিনে-রাতে যখনই ছেলের কথা মনে পড়ছে, ‘কু-ডাক’ দিচ্ছে মন। যদি একই পরিণতি হয় ছেলের! সে-ও যে রয়েছে জঙ্গলে!
শঙ্করীদেবীর সাত ছেলে, পাঁচ মেয়ে। অসীম তাঁর নবম সন্তান। মায়ের মনে পড়ে, ছেলেটা ছোট থেকেই চঞ্চল। ফুটবল খেলতে ভালবাসত। পড়শোনায় ভাল ছিল। ১৯৮৪-তে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হয় গড়বেতা কলেজে। মাঝে-মধ্যে বাড়ি আসত। বলেছিল, পড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় যাবে। “ছেলের ইচ্ছে ছিল কলেজে পড়াবে। কষ্ট করেও ওকে পড়াতাম আমরা। মাঝপথে কী যে হয়ে গেল ওর!” বলতে বলতে গভীর চিন্তায় তলিয়ে যান মা।
ছেলের অপেক্ষায়। আকাশের মা শঙ্করী মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র
পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশের দাবি, কলেজে পড়ার সময়েই অসীম ওরফে আকাশ অন্ধ্রপ্রদেশে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে যান। বাড়ির সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ছিল। আকাশের ভাই রামকৃষ্ণের কথায়, “তখনও বুঝিনি, দাদা মাওবাদী হয়ে যাবে। জঙ্গলে রাত কাটাবে। এক দিন পুলিশ বাড়িতে আসতেই সব জানতে পারলাম।” তত দিনে অন্ধ্র থেকে ফিরে জঙ্গলমহলের দুর্গম এলাকায় সাংগঠনিক দায়িত্ব নিয়েছেন আকাশ। আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের মাওবাদী স্কোয়াডে আনার কাজে নেমেছেন। এমনকী ভাই-বোনদের বিয়ের সময়ে অনেক চেষ্টা করেও বাড়ির লোক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
পুলিশের খাতা বলছে, গোড়ার দিকে জনযুদ্ধ নেতা অসিত সরকারের সঙ্গে গোয়ালতোড় ও সিমলাপালে কয়েকটি নাশকতার ছক কষেছিলেন আকাশ।
২০০৪-এর ফেব্রুয়ারিতে সিপিআই (মাওবাদী) গঠিত হওয়ার পরেই বেলপাহাড়ির দলদলিতে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে পুলিশের গাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হয়। সাত পুলিশকর্মী-সহ আট জন মারা যান। ওই হামলায় আকাশ প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন বলে পুলিশের অভিযোগ। লালগড়-পর্বে জনসাধারণের কমিটিকে সামনে রেখে পুলিশ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম হোতাও ছিলেন তিনি।
পুলিশের দাবি, বছর ছয়েক আগেও আকাশ বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পরে বিভিন্ন নাশকতায় নাম জড়িয়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। কারণ, বাড়িতে এলে ‘সোর্স’ মারফত পুলিশের খবর পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। তবে আকাশ না এলেও পুলিশ মাঝে-মধ্যেই তাদের বাড়িতে খোঁজ নিতে যায়। রাজ্য পুলিশের পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের পুলিশও এসেছে এই বাড়িতে। তাতে বাড়ির লোকের বিড়ম্বনাই বেড়েছে। ভাল ছাত্র হওয়ায় এক সময়ে যাকে পছন্দ করতেন পাড়া-পড়শি, তারই জন্য দিনের পর দিন বাঁকা কথা, বিরূপ মন্তব্য মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে তাঁদের। এখনও হচ্ছে। ছেলে কী কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, শঙ্করীদেবী অবশ্য সে খবর রাখেন না। অতশত শুনতেও চান না। শুধু বোঝেন, ছেলের খুব বিপদ! বলেন, “কাগজে লিখে দেবেন, আমি আর ওর বাবা খুব অসুস্থ। দাদার শরীরও ভাল নয়। বৌমারা, নাতি-নাতনিরা সবাই ওর জন্য চিন্তা করছে।” পাশে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আকাশের বউদি ভারতী মণ্ডল। কাপড়ের খুঁটে চোখ মোছেন বৃদ্ধা।
কাঁপতে থাকে গলা “ও যেন ওদের সঙ্গ ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসে!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.