মেয়েলি বলে তুমি কিন্তু ‘ভুল’ নও
মি বি এড পাশ। বয়স ৩০। বর্তমানে ভীষণ হতাশায় ভুগছি। আমি মেয়েলি স্বভাবের। গলার আওয়াজ, হাঁটাচলায় সেটা প্রকাশ পায়। চেষ্টা করেও আমি এগুলো পাল্টাতে পারছি না। এর জন্য দিনরাত ঘরে বাইরে আমাকে টিটকিরি আর অপমান সহ্য করতে হয়। এর ফলে লোকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বেচ্ছানির্বাসন গ্রহণ করেছি। যাকেই বিশ্বাস করে বন্ধুত্ব করতে গিয়েছি, তার কাছ থেকেই আঘাত পেয়েছি। ঘরে অন্য ভাই-বোনের থেকে আমাকে কুনজরে দেখা হয়, সবাই অপমান করে। প্রথম দিকে আমি কোনও প্রতিবাদ না করলেও এখন আমিও দু-চার কথা শুনিয়ে দিই। মায়ের অত্যাচারে বাড়িতে যেমন ভবিষ্যতে থাকা সম্ভব হবে না, তেমনই বাইরের মানুষেরা আমাকে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে দেবে না। এই নিয়ে দিনরাত দুশ্চিন্তা করে শরীর ও মন ভেঙে পড়েছে। আত্মহত্যা করার কথা মাথায় আসে! কিন্তু তবু মনের জোরেই বেঁচে আছি। আমি ঠিক হতে চাই, লোকের কাছ থেকে আদর-সম্মান পেতে চাই।
ভবিষ্যতে চাকরি পাব কি না তাই নিয়েও চিন্তা করি। কারণ মেয়েলি ছেলেকে কে চাকরি দেবে? লোকে আমার সততা দেখতে পায় না, শুধু আমার ত্রুটি দেখে। সারা দিন পশুপাখি নিয়ে থাকি। ভবিষ্যতে এই নিয়েই কাজ করতে চাই। আমার মন খুব নরম। কারও দুঃখ-কষ্ট দেখতে পারি না, কেঁদে ফেলি। আমি যে রক্তমাংসের মানুষ তা কেউ বুঝতে চায় না। এ সব দুঃখের কথা কাউকে বলতেও পারি না। নিজের মা-ই যখন বুঝল না, তখন অন্য কেউ বুঝবে, তা আশা করি না। আমি কী করব, কোথায় যাব, কী ভাবে বাকি জীবনটা কাটাব এ সম্পর্কে যদি পরামর্শ দেন, তা হলে বাধিত হব। আমার এই চিঠির উত্তর দিলে অনেক মেয়েলি ছেলেই উপকৃত হবে।
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তোমাকে বলছি
পাহাড়ি ঝর্না দেখেছ? মূল ঝর্নাটি নির্দিষ্ট খাতে বয়ে চলে। তার থেকে ছোটখাটো শাখা বেরিয়ে পাথর কেটে স্বতন্ত্র শাখা তৈরি করে নেয়। সমাজ এই রকম মূল স্রোতের ঝর্ণা। কিছু মানুষের মোটামুটি সুবিধে হয় এই ধরনের একটা অভ্যস্ত পথ সে আঁকড়ে রাখে। তার মানে এই নয় যে তার সব হিসেব ঠিক, আর যে অন্য রকম সে ভুল।
তুমি লিখেছ যে তুমি ‘ঠিক’ হতে চাও। তুমি ‘ভুল’ এটাই আমি মানতে পারিনি। তুমি ছেলে হয়েও ব্যবহারে মেয়েলি এটা তোমার ত্রুটি নয়। মেয়েরা আচরণে মেয়েলি হবে, ছেলেরা পুরুষালি এটা একটা সামাজিক নির্মাণ, চিরকালীন সত্য নয়। নারীত্ব ও পুরুষত্বের একটা শারীরিক সংজ্ঞা আছে তা জিন ও হরমোনের প্রভাবে নির্ধারিত হয়। মানসিক অবস্থানের ক্ষেত্রে হরমোনের কিছুটা প্রভাব আছে, যেমন টেস্টিস্টেরোনের সঙ্গে ক্রোধের সম্পর্ক আছে। কিন্তু মেয়েলি বা পুরুষালি হাবভাব বলতে যা বোঝায় তার অনেকটাই সমাজ নিজের সুবিধা মতো বানিয়ে নিয়েছে। যুগে যুগে তা বদলেও গিয়েছে। এক সময় মেয়েলিপনা মানে ছিল ঘর সংসার আর সন্তানধারণ। তার থেকে আমরা পাল্টে গিয়েছি। পুরুষের চোখে জল আগে দুর্বলতার চিহ্ন মনে করা হত। এখন সংবেদনশীল পুরুষকে আমরা পরিশীলিত মনে করতে পারি। আসলে নারীত্ব ও পুরুষত্বকে সামাজিক-মানসিক গণ্ডি টেনে আলাদা করা একটা রাজনৈতিক কৌশল তাতে কিছু মানুষের অন্যকে দাবিয়ে রাখতে সুবিধে হয়।
কোনও ছেলে কেন মেয়েলি বা কোনও মেয়ে কেন পুরুষালি, তার ঠিক ঠিক কারণ বিজ্ঞান জানে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হরমোনের সমস্যা পাওয়া যায় তোমার এ রকম কিছু আছে কি না পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারো। অনেক ক্ষেত্রেই হরমোনের গোলমাল থাকে না। কোনও ছেলেকে মেয়ের মতো করে মানুষ করলে তার মধ্যে মেয়েলি ভাব তৈরি হয় বলে অনেকে মনে করেন। সন্তোষকুমার ঘোষের ‘শেষ নমস্কার’-এ রকম একটা চরিত্র আছে বাঁশি। কিন্তু সব সময়ে এ রকম পারিবারিক ইতিহাসও থাকে না। আসলে মেয়েলি আর পুরুষালি ভাব বলতে সমাজ যা বোঝে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সকলের সঙ্গে মিশে আছে কারও ভেতর তথাকথিত মেয়েলিপনা একটু বেশি হয়ে গেলে লোকে তাকে মেয়েলি বলে। যেহেতু বেশির ভাগ মানুষ নারী এবং পুরুষের জন্য সমাজের বেঁধে দেওয়া ছকেই থেকে যায়, তাই কেউ অন্য রকম হলে সমাজ তাকে হেনস্থা করে।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুরুষালি মেয়ে বা মেয়েলি পুরুষেরা যৌনতার ক্ষেত্রে সমাজের বাঁধা রাস্তা থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। অনেক পুরুষালি মেয়ে নিজেকে ছেলে এবং মেয়েলি পুরুষ নিজেকে মেয়ে বলেও মনে করে। এখানে দৈহিক লক্ষণের সঙ্গে ‘আইডেনটিটি’র বিরোধ লাগে। এখন সারা পৃথিবীতেই ‘অন্য যৌনতা’র অধিকার নিয়ে লড়াই চলছে, তৈরি হচ্ছে সাহিত্য, ফিল্ম বাংলাতেও। এই রকম অনুভূতির কথা যদিও তুমি বলোনি, আমি প্রসঙ্গটা ছুঁয়ে গেলাম যাতে বোঝা যায় যে লড়াইটা অনেক ব্যাপক পরিধির। এ বার সরাসরি তোমার কথায় আসি। তোমার মেয়েলি ভাব বাড়িতে বা বাইরে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তুমি ভেঙে পড়েছ, নিজের ওপর আস্থা চলে গিয়েছে। আমি বলতে চাই যে, মানুষ হিসেবে তোমার স্থান তোমার মেয়েলি বা পুরুষালি ভাবের চেয়ে অনেক বড়। তোমার প্রধান আত্মবিশ্বাসের জায়গা হবে তোমার মানবিক গুণ তোমার বুদ্ধি, তোমার কার্যক্ষমতা, অন্যদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা। যদি তুমি সমাজে ও পরিবারে সহানুভূতি পেতে তা হলে নিশ্চয়ই ভাল হত। কিন্তু যেহেতু সমাজ নিজের খাতে বয়ে যায়, সেহেতু যারা মূলস্রোত থেকে সরে যায়, তাদের নিজের পথ কেটে নেওয়ার চ্যালেঞ্জটা নিতেও হয়। তোমার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা দরকার। তোমার ভাবা দরকার যে তুমি মূল্যবান। মানুষ হিসেবে তোমার কিছু করার বা দেবার আছে। মেয়েলি মানে কিন্তু শুধু ভাগ্যকে দোষারোপ করে ‘কেউ ভালবাসে না, চাকরি দেয় না’ ভেবে মন খারাপ করা নয়। হতাশা, বিষাদ, আত্মহত্যাও সম্মানজনক সমাধান নয়। প্রয়োজনে মনোবিদের পরামর্শ নাও তিনি তোমার পারিবারিক পরিস্থিতি অনুসারে পরামর্শ দেবেন। তুমি কী ভাবে মেয়েলি হাবভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে পারো সে ব্যাপারেও আলোচনা করবেন। কিন্তু তুমি মেয়েলিপনা পাল্টাতে পারো বা না-ই পারো, তুমি তোমার নিজের অস্তিত্বকে মর্যাদার সঙ্গে দেখতে শেখো। তোমার মেয়েলিপনা, তোমার ক্ষমতা ও গুণ তোমার পরিচয় হোক। নিজেকে সমাজের কাছে প্রয়োজনীয় করে তোলো। তোমার সুন্দর একটা গুণের কথা বলেছ অন্যের কষ্ট তুমি সইতে পারো না। কিন্তু অপরকে সাহায্য করার জন্য তুমি কী করো তা বলোনি। অন্যকে সাহায্য করা সমাজে নিজের স্থান অর্জন করায় সাহায্য করে। বাবা মায়ের সঙ্গেও কথা বলো, তাঁদের তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করো। আজকের পৃথিবীতে বেশ কিছু মেয়েলি পুরুষ এবং পুরুষালি মেয়ে নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁরা ভাল আছেন, অন্যদের জন্য অবদানও রেখেছেন। তুমি যদি এই ভাবে ভাবতে পারো, তবে তোমার মুখের ও দেহের ভাষা অন্যদের কাছেও সেই পরিচয়কে ফুটিয়ে তুলবে।
বাবা-মাকে বলছি
আপনাদের ছেলে যথেষ্ট বড়। আপনাদের ও নিজের বহু চেষ্টাতেও ও নিজেকে এত দিন বদলাতে পারেনি। এটা কোনও ইচ্ছাকৃত অপরাধ নয়, অবাধ্যতাও নয়। মেয়েলি এবং পুরুষালি ভাব কমবেশি আমাদের সবার মধ্যে থাকে। তার জন্য কাউকে বিদ্রুপ করা রোগা-মোটা, কালো-ফর্সা, বলে অপমান করার মতোই অন্যায়। ওকে অবহেলা, অপমান করে চললে ও নিজের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছে। বিষণ্ণতা ওকে গ্রাস করছে। ও কোনও অন্যায় করছে না। নিজের মতো হয়ে ও যদি ভাল থাকে, তাতে ওকে সাহায্য করা যায় না? সন্তান ভাল থাক, এটা আমরা সকলে চাই। আপনাদের কাছে সহানুভূতি পেলে ওর জীবনটা অনেক সাবলীল হতে পারে। ছেলের জন্য ও আপনাদের বোঝার সুবিধের জন্য মনোবিদের পরামর্শ নিলে ভাল হয়।

ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সমস্যা? নাকি মা-বাবাকে নিয়ে ছেলেমেয়ের সমস্যা? পড়ার খরচ
নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তা? দূরের শহরে পড়তে যাওয়ার নামে মেয়ের গায়ে জ্বর আসা? যে
মুশকিলই হোক না কেন, পরিবারের সবাই মিলেই সমাধানে পৌঁছতে হবে। এ বার থেকে
‘প্রস্তুতি’-ও কথা বলবে গোটা পরিবারের সঙ্গেই। অভিভাবকদের বা সন্তানের যে কোনও দুশ্চিন্তার
কথা আমাদের জানান (এবং জানাও) নিজেদের সমস্যা। সুচিন্তিত উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।

ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়: Haate Haat।

অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.