চিকিৎসা-বিভ্রাট/৩ ভাবমূর্তি বদলানোই
‘রোগ’ চিকিৎসকদের
হাসপাতালে যে চিকিৎসক কোনও মতে পুরনো প্রেসক্রিপশন দেখে, বুক, চোখ, নাড়ি দেখে ওষুধ লিখে দেন, কী অসুখ করেছে সেটাই ভাল করে বলেন না, তাঁকেই চেনা দায় ব্যক্তিগত চেম্বারে। সেখানে তিনি স্নেহশীল, আন্তরিক।
নজরুল হালসানার স্ত্রীর প্রসব যন্ত্রণা শুরু হতে রাত দুপুরে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে হাজির হন। ডাক্তারবাবু তাঁর স্ত্রীকে ভর্তিও করিয়ে নিলেন। নজরুল বলেন, “কিন্তু সেখানে দীর্ঘ ক্ষণ বাদে চিকিৎসক এলেন। সঙ্গে তিন জন বাইরের লোক। তিনি দেখে চলে গেলেন। ওষুধ দিলেন। তার পরের দুপুর পর্যন্ত ও ভাবেই কাটল।” প্রসব যন্ত্রণায় কাতর স্ত্রীকে দেখে বারবার স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে পায়েও ধরেও চিকিৎসককে কোনও খবর দিতে পারেননি তিনি। কিন্তু কিছু ক্ষণ বাদে হঠাৎ খবর এল, তাঁর স্ত্রীকে কলকাতায় ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি ভাড়া করার জন্য যখন ছুটে বেড়াচ্ছেন অসহায় নজরুল, তখনই ওই আগের রাতে দেখা ডাক্তারের এক সঙ্গী এসে জানালেন, কলকাতা যাওয়ার কোনও দরকারই নেই, কৃষ্ণনগরেই নার্সিংহোমে স্ত্রীকে ভর্তি করিয়ে দিলে ভাল চিকিৎসা পাওয়া যাবে। নজরুল বলেন, “একে কলকাতার কিছু চিনি না। তার উপরে গাড়ি ভাড়া। আরও কত খরচ লাগবে কে জানে। তাই নার্সিংহোমেই স্ত্রীকে ভর্তি করিয়ে দিলাম।” সেখানে নজরুল দেখলেন ওই চিকিৎসককেই। তিনি তখন অনেক বেশি আন্তরিক। হাসপাতালে যাঁর সঙ্গে একটা কথাও বলা যায়নি, তিনিই নিজে থেকে এগিয়ে এসে কী করতে হবে বলে দিচ্ছেন। নজরুল বলেন, “একই মানুষ স্রেফ জায়গা বদল ঘটে গেলে শয়তান থেকে ভগবানে বদলে যায়।”
হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটির জেলা সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, “একই রোগী একই ডাক্তার। কিন্তু ব্যবহারে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে যায়। অথচ, জেলা হাসপাতালের যা পরিকাঠামো তার সঙ্গে নার্সিংহোমগুলো কখনওই পাল্লা দিতে পারে না।” ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠনের কালীগঞ্জ-নাকাশিপাড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক অংশুমান দে-ও বলেন, “সাধারণ ভাবে অনেক রোগীর পরিবার শিক্ষা ও বিত্তে ডাক্তারবাবুদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও, অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ মানুষ অনেক কথাই বুঝতে পারেন। তাঁরা জানেন, ব্যক্তিগত চেম্বারে ডাক্তারবাবু কী রকম ব্যবহার করেন, আর হাসপাতালে কী রকম ব্যবহার করেন।” তিনি বলেন, “হাসপাতালের পরিকাঠামোগত সুযোগটা রোগীরা পান না।”
তবে সব চিকিৎসক যে এরকমই, তা কিন্তু নয়। চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ-র অনুপকুমার বসুমল্লিক বলেন, “একটা কথা আপনারা ভুলে যাচ্ছেন যে, হাসপাতালের পরিকাঠামো খাতায় কলমে ভাল। কিন্তু অনেক যন্ত্রই খারাপ হয়ে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। তার উপরে যত রোগী আসে প্রতিদিন, সেই চাপ নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নেই। তার মধ্যেই ডাক্তারবাবুরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন ভাল পরিষেবা দেওয়ার।” হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, কোনও কোনও চিকিৎসককে আউটডোরে দিনে তিনশো রোগী দেখতে হয়। তা হলে এক এক জনের জন্য কতটা সময় দেওয়া যাবে? সদর হাসপাতালের সুপার কাজল মণ্ডল বলেন, “আমি জানি এক জন চিকিৎসককে এক দিনে চারশো নিরানব্বুই জনকে আউটডোরে দেখতে হয়েছে। তারপরে ওয়ার্ডে দেখতে হয়েছে আরও একশো জনকে। তা হলে হল মোট ছ’শো। এ বার তাঁর কাছ থেকে আপনি কতটা সময় আশা করতে পারেন?”
কিন্তু হাসপাতাল আর চেম্বারে ডাক্তারবাবুর ব্যবহার বদলে যাওয়ার রহস্যটা কী? নদিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অমিত হালদার বলেন, “বেশিরভাগ চিকিৎসকই হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীর সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করেন। তবে কিছু চিকিৎসক অবশ্য তা করেন না, সে কথা ঠিক। আসলে এটা নির্ভর করে ওই চিকিৎসকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপরেই।” হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটির দেবাশিসবাবুর কথায়, এই ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ আসলে নির্ভর করে অর্থের উপরেই। তিনি বলেন, “চেম্বারে বা নার্সিংহোমে খারাপ ব্যবহার করলে রোগী আসবে না। তা ছাড়া, চেম্বার বা নার্সিংহোমের মালিকও ডাক্তারবাবুকে ছেড়ে কথা বলবেন না। কিন্তু হাসপাতালে রোগীও আসবে, খারাপ ব্যবহার করলে কেউ কিছু বলবেও না। অতএব, ব্যবহারের ফারাক তো ঘটবেই।”
সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের ফলেই এক সময় ডাক্তারবাবু ছিলেন ভগবান। গ্রামে গঞ্জে ডাক্তারবাবুরা চিকিৎসা ছাড়াও অন্য অনেক সামাজিক কাজকর্মে জড়িত থাকতেন। তাঁকে লোকে শ্রদ্ধা করত। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেবাশিস দাশগুপ্ত বলেন, “এখন সেই ভাবমূর্তিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তা সামলাতে চিকিৎসকদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।”

(শেষ)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.