গুরু গ্রেগের বিতর্কিত সন্ধিক্ষণে যেন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ঐতিহ্যের ওভাল
কোনটা বেশি উপকারী হবে? ১-৩ না ০-৪? বাংলা কথা, ওভাল টেস্ট হারলে খারাপ হবে, না উল্টে ভাল হবে ধোনিদের?
জিজ্ঞাসাটা চরম অস্বাভাবিক। বিভ্রান্তিমূলক। এমনকী অপ্রকৃতিস্থও শোনাতে পারে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের অন্দরমহলে সংখ্যালঘু, চিন্তামনস্ক অংশের কাছে নয়। এঁরা ০-৪ হোয়াইটওয়াশের ভ্রুকুটিতে আতঙ্কিত নন। বরঞ্চ মনে করেন দীর্ঘমেয়াদি টিম তৈরির জন্য এই ‘শক’টা দরকার। ওভালে জিতে গেলে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে না। আর শুদ্ধিকরণ না হলে ভারতের পক্ষে এক নম্বরে ফেরা সম্ভব নয়।
এই অংশটা মহাবিতর্ক এড়াতে এখনই প্রকাশ্য হতে রাজি নয়। এটুকু লিখতে অসুবিধে নেই, তালিকায় ইংল্যান্ডে সিরিজজয়ী অধিনায়কেরাও রয়েছেন। যাঁদের মতে, শুদ্ধিকরণের সেরা লোক ভারতীয় ড্রেসিংরুমেই রয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁকে অথর্ব করে রাখা হয়েছে। ডানকান ফ্লেচার। শুধু প্রাক্তন লিখছি কেন, বোর্ডের সেন্ট্রাল কন্ট্র্যাক্ট স্কিমে থাকা এক জনও বুধবার বলছিলেন, “টিমের যা হাল, সংস্কার চাই আমূল। গ্রেগ চ্যাপেলের আমলে যেটা হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয়েছিল। কিন্তু একটা ধাক্কা তখন দরকারও ছিল। এটা ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন ভাবে করার সেরা লোক ফ্লেচার। কার্স্টেনও এটা পারবে না। এর জন্য প্রয়োজনে অপ্রিয় হতে হবে।”
দৃশ্যত এখনও ‘ক্যাপ্টেন কুল’। ভেতরে ভেতরে যা-ই চলুক। ওভালে বুধবার পুলিশ কুকুরের সঙ্গে খেলছেন ধোনি। ছবি: অমিত শাহ।
চিন্তামনস্ক যে শ্রেণির কথা লিখছি, এঁরা ০-৩ পরবর্তী ভারতীয় বোর্ডের সভায় কর্তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে খুব মুষড়ে পড়েছেন। বৈঠকে কোথায় শোচনীয় হারে বিসর্জিত পয়লা নম্বর র্যাঙ্কিং নিয়ে আলোচনা হবে। তা নয়, দু’টো মিডিয়া বিজ্ঞপ্তি বৈঠকের পর দেওয়া হয়েছে। একটাতে বলা, আমাদের বার্ষিক অ্যাকাউন্টস পাশ হল। অন্যটায় মার্কেটিং কমিটি মোবাইল ও ইন্টারনেট স্বত্ব চুক্তির জন্য কী ভাবে টেন্ডার ডকুমেন্ট চাইছে। ন্যূনতম কত কোটি টাকা দিতে হবে তার সব হিসেবটিসেব। সাপোর্ট স্টাফের ব্যর্থতার পর কোথায় নতুন বিদেশি মুখ খোঁজা হবে, কোথায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ক্রীড়াসূচি কমানো হবেকিস্যু হয়নি।
কারও কারও মনে হচ্ছে, ১-৩ হয়ে গেলে তো বোর্ড কর্তাদের আরওই সোনায় সোহাগা। জনতা শেষ ম্যাচ জিতে উঠে সব ভুলে যাবে। তখন আর চিৎকার-চেঁচামেচি-জবাবদিহি! নতুন সংস্কারটংস্কারের কোনও বালাই থাকবে না। এঁদের মনে হচ্ছে, ওভাল টেস্ট ম্যাচ খাতায়-কলমে নিশ্চয়ই ধোনি বনাম স্ট্রস। কিন্তু অদৃশ্য ভাবে ভবিষ্যতের জন্য ধোনি ভার্সেস ফ্লেচার। ভারত জিতলে ধোনি একচ্ছত্র ক্ষমতাসীন থাকবেন। যেমন এখন আছেন। ফ্লেচার থেকে যাবেন ঠুঁটো জগন্নাথ। যেমন এখন আছেন। আবার ভারত হারলে ধোনির প্রভাব কমবেই। ফ্লেচার জায়গা এবং সুযোগ পাবেন টিমের নতুন দর্শন তৈরির।
ইতিহাস ধোনির পক্ষে। যেহেতু ওভাল ইংল্যান্ডের একমাত্র মাঠ যেখানে গত বাহান্ন বছর ভারত কোনও টেস্ট হারেনি। এখানেই সেই একাত্তরের যুগান্তকারী জয়। এমনই আবেগঘন ছিল ওয়াড়েকরদের সেই বিজয় যে, মাঠে হাতি নিয়ে চলে এসেছিলেন ভারতীয় সমর্থকেরা। ক্রিকেটের একশো চৌত্রিশ বছরের ইতিহাসে যা ওই এক বারই ঘটেছে।
বুধবারের ওভাল একটু অন্য রকমের। বেশ কিছু সংখ্যক স্যুটেড-বুটেড মানুষ। হাতে কারও শ্যাম্পেন। কারও ওয়াইন। উইকেটের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ক্রিকেট পিচের সঙ্গে শ্যাম্পেন-ওয়াইনের এমন সহাবস্থান আইপিএলেও হয় না। রক্ষণশীল ইংল্যান্ডে কী করে ঘটছে? জানা গেল, ওরা সারে কাউন্টির বিশিষ্ট সদস্য। অ্যালেক বেডসার স্মারক মধ্যাহ্নভোজ হচ্ছে আজ ওভালে। বক্তৃতা দেবেন গণ্যমান্য অনেকে। বেডসাররা দুই ভাই, স্যার জ্যাক হবস এঁরা সবাই সারের এক-এক জন রত্ন। লেন হাটন এখানকার নন, ইয়র্কশায়ারের। কিন্তু এ মাঠেই তো তাঁর সেই ৩৬৪, যা ব্র্যাডম্যানকে দেখতে হয়েছিল। লর্ডসেরও আগে ওভালে টেস্ট ম্যাচ হয়েছে। অ্যাসেজ রূপকথার জন্মই তো দেয় এ মাঠের হার। ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্ট। গাওস্করের ২২১। এমনকী প্রথম এফএ কাপ ফাইনাল ওভালের মতো রঙিন ইতিহাস লর্ডসেরও নেই।
কিন্তু বহিরঙ্গ অতি সাদামাঠা। লর্ডস যদি ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট অফিস হয়, ওভাল তা হলে কারখানা। লর্ডস যদি পার্ক স্ট্রিট ফ্লুরিজ হয়, ওভাল মধ্যমগ্রামের কাদা-জল জমে থাকা গলি। লর্ডস যদি ইডেন হয়, ওভাল হাওড়ার ডুমুরজলা স্টেডিয়াম। লর্ডসের প্রতীক যদি আভিজাত্য হয়, ওভাল তা হলে মা-মাটি-মানুষ।
দেখলে অবাকই লাগবে, যে মাঠের ধারের প্রতিটি খিলানে, প্রতিটি ঘাসে, প্রতিটি বক্সে এত উদ্দীপক জমা, সেই স্টেডিয়াম এত বিবর্ণ হয় কী করে? কেন এত স্পনসর বদলাতে হয় তাকে? কখনও ফস্টার্স ওভাল। কখনও কেআইএ ওভাল! অবশ্য আর একটা দিকও আছে। এমন তৃতীয় বিশ্ব মার্কা দেখতে বলেই কি ভারতের রেকর্ড এত ভাল? তাদের হয়তো মনেই হয় না বিদেশে সিরিজ খেলছি বলে! ভারতীয় সমর্থকদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য ওভালের ঐতিহ্যে ভরসা করতে রাজি নন। টিমের ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন। সুইস কটেজ নিবাসী মানব মজুমদার যেমন বললেন, “লর্ডসে কড়কড়ে ৯৫ পাউন্ড খরচা করে এই খেলা দেখেছি। আর যাচ্ছি না হার দেখতে।” বেকার স্ট্রিট স্টেশনের সামনে যাঁর দোকান সেই রতন পানিকর জানালেন, বৃহস্পতিবার চ্যানেল ফাইভ-এ যে বিগ ব্রাদার শো শুরু হচ্ছে, ওভাল না গিয়ে সেটা দেখবেন। বিগ ব্রাদার অন্তত বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দেবে না।
সমস্যা হল এঁদের স্যাম্পল ধরার উপায় নেই। এই বাজারেও ওভাল টেস্টের প্রথম চার দিনের টিকিট নিঃশেষিত। বুধবারের হাল্কা বৃষ্টিও সেই আগ্রহের ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। মনে হচ্ছে ইংরেজ সমর্থকেরা এ বার বেশি সংখ্যায় থাকবেন। ক্রিকেট হঠাৎ এই শেয়ার বাজারে ধস, মার্ডকের কাগজের ফোনে আড়িপাতা কেলেঙ্কারি, গোটা দেশে আচমকা সংঘর্ষের বাতাবরণে এমন একটা শীর্ষে ওঠার মহিমা দান করেছে যে, জাতি আপ্লুত। প্রিমিয়ার লিগের ভরা বাজার, আর্সেনালের বিপন্নতা সবার মাঝে স্ট্রসদের বন্দনা চলছেই। ইয়ান বোথাম লিখেছেন, ‘তোমরা আমায় আবার সুস্থ ভাবে থাকার সম্মান দিলে। নইলে অর্ধেক সময় ইংল্যান্ডের হারের পর উত্তেজিত বা ব্যঙ্গ করতে উৎসাহী দর্শক এড়িয়ে আমাকে পিছনের গেট দিয়ে পালাতে হত।’
এমনি অক্সফোর্ড স্ট্রিটের সামনে এইট বি বাসের পিছনের গেটের মতো ভিড়। হাইড পার্কে শান্তির পদচারণা। শার্লক হোমসের কাল্পনিক ঠিকানায় লম্বা লাইন দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, আরাম করে ছুটি কাটানোর দৃশ্যত এই মেজাজটা কেবল পর্যটকদের। দেশের নয়। দেশ বেকারিত্ব থেকে শুরু করে স্টক মার্কেট নানা সমস্যায় বিদ্ধ। আর তাই ক্রিকেটের তিন টেস্টের সাফল্য তাদের এতটা ভাসিয়ে দিয়েছে! দেশের মেজাজ বুঝছেন বলেই হয়তো অ্যাসেজ জিতেও এমন বীরপুজো না পাওয়া ক্রিকেটাররা ৪-০ করতে এত একমনা। জেতা-হারা অথবা ড্র ঠিক হবে প্রধানত ইংল্যান্ড বোলিং বনাম ভারতীয় ব্যাটিংয়ের যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে জেমস অ্যান্ডারসনকে খেলানো নিয়ে ইংরেজ দোলাচল এখনও কাটেনি। পুরো সুস্থ নন। তবু সচিনের ওপর চাপ রাখবে বলেই হয়তো প্র্যাক্টিসে তাকে বল করিয়ে গেল ইংল্যান্ড।
সচিন-রাহুল অবধি তো ঠিক আছে। সহবাগ নিজের মন্ত্রে দীক্ষিত। কিন্তু বাকিদের কী হবে যদি বল ফের ঘণ্টায় ৮০/৮৫ মাইল গতিতে সুইং করতে শুরু করে? ভারতের প্রাক্তন মনোবিদ প্যাডি আপটন দলকে দেওয়া নির্দেশিকায় বছরখানেক আগে বলেছিলেন, ব্যাটসম্যানরা ম্যাচের আগের দিন শারীরিক সম্পর্ক করে দেখতে পারো। টেনশন কমবে। সেই নির্দেশিকা নিয়ে এমন বিতর্ক হয়েছিল যে, তার পর আপটন বহু দিন ভারতীয় মিডিয়ার সামনে আসেননি। প্রাক্ মনোবিদ আমলেও মুম্বইয়ের বিখ্যাত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের গল্প ফেরে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে। ১৯৬২-র ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এ রকমই ত্রাস তাড়া করেছিল ভারতকে। হল-গ্রিফিথের সামনে নাগাড়ে টেস্ট হারার মাঝে এই ব্যাটসম্যান সবচেয়ে ভাল খেলতেন। রটনা হল, প্রকাশ্যেই তিনি টয়লেটে চলে যেতেন। বলতেন, কল্পনায় মীনাকুমারীকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। আদৌ মীনাকুমারীকে হয়তো চিনতেন না। কিন্তু সিরিজ শেষে বলেছিলেন, “সব রান মীনাকুমারীকে উৎসর্গ করলাম। ওর ভাবনাই ব্যাটিংয়ের সময় আমাকে রিল্যাক্সড রেখেছিল।” ওভাল-সমস্যা বলছে, এত উঁচু মানের সুইং বোলিং রিল্যাক্সড থেকেও খেলা যাবে না। এটা সাহসের ব্যাপার নয়। টেকনিকের ব্যাপার। রাহুল দ্রাবিড় সে দিন যেমন বলছিলেন, “সুইংয়ের বিরুদ্ধে ব্যাটিং হল জিওমেট্রি অ্যাট হাই স্পিড।” শার্লক হোমস শেষ টেস্টের প্রিভিউ লিখতে বসলে কী ভাবে শেষ করতেন? এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ওয়াটসন। ওরা সেই ওভালের ঐতিহ্যের ওপর ভরসা করে থাকবে!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.