পরিকল্পনার গলদেই বিপদ-পথে চলছে শহর
মূল পরিকল্পনাতেই গলদ! জল বের হওয়ার সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা না-করেই রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে, প্রতি বছর রাস্তা ভেঙে চৌচির। পূর্ত দফতর, কেএমডিএ, পুরসভা সব দফতরেই ভাঙা রাস্তার জন্য ‘প্যাচ’ মারা অস্থায়ী মেরামতিই যেন নিয়ম হয়ে উঠেছে। দুর্গতি বেড়েছে সাধারণ মানুষের।
প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার পরে বলছেন, “কলকাতা-সহ শহরতলির রাস্তাঘাট বারবার খারাপ হওয়ার মূল কারণ নিকাশি ব্যবস্থার অভাব।” অন্য দিকে, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, “কলকাতায় মাটির যা চরিত্র, তার নিরিখে রাস্তা তৈরিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন।” অর্থাৎ, তিনিও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন যে, রাস্তা তৈরির মূল পরিকল্পনাতেই গলদ রয়ে গিয়েছে।
যশোহর রোড, রাজারহাট রোড, সেক্টর ফাইভ, ভিআইপি রোড, ই এম বাইপাস কলকাতা ও শহরতলির রাস্তাগুলো যেন মরণফাঁদ। রাস্তার মধ্যে কোনও কোনও গর্ত পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি গভীর। সেই সব গর্তে আবার জমে রয়েছে বৃষ্টির জল। ফলে গাড়ির চালক বুঝতেই পারছেন না কোন গর্ত কতটা গভীর। রীতিমতো ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করছে গাড়ি। আকছার দুর্ঘটনাও ঘটে চলেছে।
জল বাঁচিয়ে, কাদা এড়িয়ে এ ভাবেই চলছে দুর্ভোগের রোজনামচা। জল থইথই যশোহর রোড।
যেমন, যশোহর রোডের মাইকেলনগরের কাছে দেখা গেল, প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে রাস্তা এতটাই খারাপ যে, রীতিমতো যানজট হয়ে যাচ্ছে। গর্তে পড়ে গাড়ি বিকল হয়ে পড়ছে। নাগেরবাজারের কাছে অবস্থা দেখে মনে হবে, রাস্তাটাই যেন হারিয়ে গিয়েছে। আবার রাজারহাট পুর-এলাকায় বিমানবন্দরের পাশের রাস্তাটি যেন ছোটখাটো একটি ডোবা। সেখান দিয়েই যানবাহন যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে। সেক্টর ফাইভে টেকনোপলিসের সামনের রাস্তায় দুর্ঘটনার জেরে বিক্ষোভ, ভাঙচুরের পরে রাস্তা মেরামতির ‘প্যাচওয়ার্ক’ হয়েছিল। মাসখানেকের মধ্যেই সেই জায়গা আবার ভেঙেচুরে আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
সায়েন্স সিটির কাছে রাস্তায় বড় বড় গর্তের জন্য এক সময়ে দ্রুত গতির জন্য পরিচিত ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস এখন গাড়িচালকদের কাছে দুঃস্বপ্ন। পথচারীদেরও দুর্ভোগের শেষ নেই।
প্রতি বছর বর্ষায় রীতিমতো নিয়ম করেই রাস্তা ভেঙে যায়। মেরামতি হয় বর্ষা শেষ হলে। পরের বছর ফের ভাঙা রাস্তার নতুন করে ভোগান্তির শুরু।
কিন্তু প্রতি বছর রাস্তা কেন ভেঙে যাবে? কেনই বা মেরামত করা পথের আয়ু আরও দীর্ঘ হবে না? জবাবে সংশ্লিষ্ট সব দফতরের আধিকারিক কারণ হিসেবে বলছেন, রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করার সময়ে জল নিকাশির দিকে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। যেমন, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের অন্যতম চিফ ইঞ্জিনিয়ার বাপ্পা সরকার বলেন, “বিটুমিন ও জল একে অপরের চরম শত্রু। সেই কারণে রাস্তা তৈরির স্থায়ী নিয়ম হল, পথের মাঝখান উঁচু করে দুই ধারে ঢাল রাখা। যাতে বৃষ্টির জল পড়ে ঢালু পথে নালা-নর্দমা (শহরে) বা নয়ানজুলি (হাইওয়ে) দিয়ে বেরিয়ে যায়।”
জল বেরোনোর এই নিয়ম কি সব জায়গায় অনুসরণ করা হয়েছে? “না” এক কথায় জবাব দিয়েছেন রাজ্য পূর্ত দফতরের ‘রোড্স’ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারেরা। নিয়ম না-মানার উদাহরণ হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে, ইএম বাইপাসের মতো বড় রাস্তায়। দু’পাশে জবরদখলের জন্য জল বেরোনোর কোনও ব্যবস্থাই করা যায়নি। আধিকারিকদের বক্তব্য, রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার কারণে এই সব দখল হঠানোর চেষ্টা কোনও রাজনৈতিক দলই করেনি।
শহরতলির রাস্তাগুলি তৈরির সময়েও জল বার করে দেওয়ার উপযুক্ত পরিকল্পনা করা যায়নি। কখনও রাজনৈতিক দখলদারির জন্য, কখনও বা আবার পরিকল্পনাহীন নগরোন্নয়নের জন্য। উদাহরণ হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারেরা বলছেন, কলকাতা ও শহরতলি থেকে জল বেরিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক পথগুলো (যেমন বাগজোলা, কেষ্টপুর, টালি নালা ইত্যাদি) নাব্যতা হারানোয় পথের জল বেরোতে পারে না। ফলে জল জমে পথের গভীরে চুঁইয়ে প্রবেশ করে রাস্তাকে ভঙ্গুর করে দেয়। রাস্তার স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ায় বড় গাড়ির চাকার চাপ সহ্য করতে না-পেরে তা দ্রুত ভেঙে যায়। প্রতি বর্ষাতেই ঘটে চলেছে একই ঘটনা। রাস্তার স্থায়িত্ব এক বছরও থাকছে না।
গর্তের উপর দিয়েই গাড়ি চলেছে রাজারহাট রোডে। বুধবার।
মেয়র বলেন, “অর্থের অভাব আছে। তবে বাইপাস-সহ বেশ কয়েকটি রাস্তার উপরে মেট্রো, উড়ালপুল, রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শেষ হলে ম্যাস্টিক অ্যাসফল্টের রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা আছে। সে ক্ষেত্রে সমস্যা অনেকটা মিটবে।”
প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী বলেন, “রাস্তা ভেঙে যাওয়ার প্রধান কারণ নিকাশির সমস্যা। কলকাতা ও শহরতলির জল যে সমস্ত স্বাভাবিক পথে বেরিয়ে যেত, তা নগরায়নের জেরে বন্ধ। উপরন্তু রাস্তার ধারে দখলদারি সরাতে না-পারাও নিকাশির বেহাল দশার অন্যতম কারণ। তবে এখনও বিভিন্ন খাল সংস্কার ও দখলদারি সরাতে পারলে সমস্যা মিটবে।”
কিন্তু এত বছর ধরেও সেই সমস্যা কেন মেটানো গেল না? জবাবে ক্ষিতিবাবু বলেন, “আলোচনা যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু অর্থের অভাব এবং ‘হচ্ছে-হবে’ মানসিকতার কারণেই এত দিন সেই সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়ে ওঠেনি।”

ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.