তিন বাড়িতে তল্লাশি, উদ্ধার কার্তুজ
নয়াচর নিয়ে নয়া ত্রিমুখী প্রস্তাব জমা দিলেন প্রসূন
পূর্ব মেদিনীপুরের নয়াচরে পেট্রো-রসায়ন প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা এখন অতীত। প্রায় জনমানবহীন এই দ্বীপে শিল্প, পর্যটন ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির ত্রিমুখী প্রকল্প-সম্ভার নিয়ে এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন অনাবাসী বাঙালি শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সংস্থার প্রতিনিধি প্রসূন সেনগুপ্ত ওই প্রকল্প নিয়ে ‘প্রেজেন্টেশন’ দিয়েছেন। রাজ্য সরকার তা নীতিগত ভাবে গ্রহণও করেছে।
এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা কেমিক্যাল-হাবের বিপক্ষে। কিন্তু চলতি সমস্ত প্রকল্প বাতিল করে দেওয়াটা কোনও সরকারেরই লক্ষ্য হতে পারে না। রাজ্যের জন্য শিল্প প্রয়োজন। এর আগের সরকার সুষ্ঠু নীতি এবং প্রশাসনিক যোগ্যতার অভাবে কোনও প্রকল্পই ঠিক ভাবে করতে পারেনি।” মমতা জানান, নয়াচরে কেমিক্যাল-হাব না হলেও সেখানে ইকো-পার্ক বা বিদ্যুৎ প্রকল্প হতে পারে। দেখতে হবে, কৃষকরা যাতে বঞ্চিত না হন। জমি যাঁদের, তাঁদের কোনও অভিযোগ না থাকে। পরিবেশ দূষিত না হয়। সে কথা তিনি প্রসূন মুখোপাধ্যায়কেও জানিয়েছেন।
প্রসূনবাবুদের নিউ কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (এনকেআইডি) সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে প্রথমে নন্দীগ্রাম এবং পরে নয়াচরে পেট্রো-রসায়ন শিল্প গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, রাজ্য সরকারের সঙ্গে এনকেআইডি-র ব্যবধান তত বেড়েছে। এবং এই টানাপোড়েনের মধ্যেই গত মার্চ মাসে, বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পরে, প্রসূনবাবুদের সঙ্গে ২০০৬-এর ৩১ জুলাই করা পেট্রো-প্রকল্প তৈরির মূল চুক্তি বাতিল করে দেয় বাম সরকার। কার্যত, সে দিনই নয়াচরে পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পে যবনিকা পড়ে যায়।

বিদ্যাসাগর দ্বীপ (নয়াচর)
প্রফুল্লচন্দ্র রায় শিল্পতালুক
(২৫৩০ একর)
• প্রক্রিয়াকরণ শিল্প
• যন্ত্রাংশ কারখানা
• উৎপাদন শিল্প
বিনিয়োগ ৮ হাজার কোটি
কর্মসংস্থান ৪০ হাজার
মাতঙ্গিনী হাজরা পর্যটন তালুক
(৭২৫২ একর)
• শিক্ষা
•‘অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম’
• বাংলা হাট
বিনিয়োগ ২৬৮ কোটি
কর্মসংস্থান ১০ হাজার
সাগর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
(১৩৬০ একর)
• পরিবেশ বান্ধব ২০০০ মেগাওয়াট ‘সুপার ক্রিটিক্যাল’ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
• বিনিয়োগ ১২ হাজার কোটি কর্মসংস্থান ৬০০
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আগের সরকারের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মপন্থার মূল ফারাক হল, মমতা কোনও বিশেষ শিল্পপতির পক্ষে বা বিপক্ষে নন। আমাদের দর্শন হল, শিল্পক্ষেত্রে শত পুষ্প বিকশিত হোক। রাজ্যে শিল্প প্রয়োজন। যে প্রকল্প প্রসূন মুখোপাধ্যায় জমা দিয়েছেন, তা আমরা এখন বিচার-বিবেচনা করে দেখছি।” প্রসূনবাবু বলেন, “এর আগের সরকারের কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য আমরা ৯৮৬ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা জমা দিয়েছিলাম। যার থেকে প্রকল্প না হওয়ায় ফেরত পেয়েছি ৩৪০ কোটি টাকা। কিন্তু এই টাকা রাজ্যের কাছে থাকায় সুদই হয়ে গিয়েছে ২১১ কোটি টাকা। অথচ আমাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছিল যে, আমরা শিল্প করতে চাইছি না!” প্রসূনবাবু আরও বলেন, “বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন, কেমিক্যাল-হাব করা চলবে না। প্রথমে আমাদের একটা সংশয় ছিল, যে হেতু এটি কেন্দ্রীয় পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পের অধীন, তা-ই কেন্দ্রের অনুমতি ছাড়া এটি বাতিল করা যায় কি না। রাজ্যের শিল্প দফতর কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করেছে। জানা গিয়েছে, কেন্দ্রের পেট্রোলিয়াম কেমিক্যালস অ্যান্ড পেট্রোকেমিক্যালস ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন (পিসিপিআইআর) নীতি অনুসারে কেমিক্যাল হাব করা বাধ্যতামূলক নয়। নয়াচরে যে শিল্পতালুক হবে, তা ওই কেন্দ্রীয় নীতির আওতাতেই করা সম্ভব।”
বাঙালির আবেগের সঙ্গে যুক্ত হতে প্রসূনবাবু নয়াচরের নাম বদলে ‘বিদ্যাসাগর দ্বীপ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রকল্প-প্রস্তাব অনুযায়ী ওই দ্বীপে একটি শিল্পতালুক হবে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নামে। মাতঙ্গিনী হাজরার নামে গড়া হবে পর্যটনতালুক এবং সাগর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।নয়াচর দ্বীপে মোট জমির পরিমাণ ১৩ হাজার একরের মতো। এর মধ্যে ১১ হাজার ৯২৭ একর জমি একর-প্রতি ২৫ হাজার টাকায় লিজ-চুক্তি করে এনকেআইডি-র হাতে তুলে দিয়েছিল আগের বাম সরকার। প্রকল্পের মূল চুক্তিটি বাতিল হলেও জমি এখনও ওই সংস্থার হাতেই রয়েছে। ফলে নতুন প্রকল্প চূড়ান্ত হলে জমি নিয়ে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যদিও সংস্থার তরফে আরও কিছু জমি দাবি করা হয়েছে।
নতুন প্রকল্প-প্রস্তাবে কী বলেছে এনকেআইডি?
প্রফুল্ল রায় শিল্পতালুক: ২৫৩০ একর জমিতে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নামে তৈরি হবে শিল্পতালুক। যাতে থাকবে তিনটি ভাগ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা এবং উৎপাদন শিল্প। এই তিনটি প্রকল্পের জন্য কাঁচামাল আসবে মূলত হলদিয়া থেকে। শিল্পতালুকে মাঝারি ও ছোট মাপের শিল্প এবং রফতানিজাত পণ্য তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। শিল্পতালুককে ঘিরে তৈরি হবে বিশ্বমানের রাস্তা, জেটি, সেতু, টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইমারজেন্সি রেসপন্স কেন্দ্র ইত্যাদি। ৭৮৫ একর জমিতে তৈরি হবে এই পরিকাঠামো।
শিল্প প্রকল্পের জন্য পরিবেশ নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে এমভিটেক ইন্ডিয়া সংস্থাকে। জমি ভরাটের জন্য বেলারি দ্বীপ থেকে মাটি তুলতে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে কলকাতা বন্দর। জেটি তৈরির অনুমতি চাওয়া হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে। বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে টাটা কনসালটেন্সি ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থাকে। শিল্পতালুকে কর্মসংস্থান হবে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের। প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা ১৫ বছর। এই প্রকল্পে ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবে শিল্পতালুকের জন্য রাজ্যের কাছে ১৫ বছরের জন্য সুদবিহীন ১০০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছিল এনকেআইডি। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর ছাড় এবং অনুদানও চাওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রসূনবাবু শনিবার অবশ্য বলেন, “এই প্রস্তাব লিখিত ভাবে থাকলেও যে হেতু আর্থিক সঙ্কটের জন্য রাজ্য সরকার এতে রাজি নয়, তাই ঋণের প্রস্তাবটি আমরা প্রত্যাহার করে নিয়েছি।”
সাগর বিদ্যুৎ কেন্দ্র: পরিবেশ বান্ধব ‘সুপার ক্রিটিকাল’ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ‘ইউনিভার্সাল ইভেসেন্ট পাওয়ার’ নামে একটি নতুন সংস্থা তৈরি করে তার হাতে ১৩৬০ একর জমি তুলে দিয়েছে এনকেআইডি। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য হল এতে কম জল ব্যবহার হবে। এবং ছাইয়ের পরিমাণও কম হবে। কয়লা-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলেও পরিবেশ দূষণ হবে না বলে দাবি। মোট ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হবে। যার ৮৫% রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ কিনে নেবে বলে ঠিক হয়েছে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রথম পর্যায়ে ৬৬০ মেগাওয়াট করে দু’টি ইউনিট চালু হবে ২০১৫ সালে। তৃতীয় ৬৬০ মেগাওয়াট ইউনিটটি চালু হবে ২০১৭ সালে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে খরচ হবে ১২ হাজার কোটি টাকা। কাজ পাবেন ৬০০ লোক। এই প্রকল্পের জন্য কয়লা আসবে ইন্দোনেশিয়া থেকে। প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক, কয়লা ও জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জলের অনুমতি দিয়েছে কলকাতা বন্দরও। প্রকল্পের ডিপিআর তৈরি করছে ডিসিপিএল। নির্মাণ কাজের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডাকার প্রস্তুতিও শেষ।
মাতঙ্গিনী হাজরা পর্যটন তালুক: ৭২৫২ একর জমিতে তৈরি হবে এই পর্যটন তালুক। এখানে থাকবে শিক্ষামূলক ও অ্যাডভেঞ্চার পর্যটনের ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে বিকিকিনির জন্য ‘বাংলা হাট’। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, শিক্ষামূলক বিভাগে থাকবে নেচার পার্ক, সাইক্লিং, ট্রেকিং, থিম পার্ক, বোটানিক্যাল পার্ক, বাটারফ্লাই পার্ক, চিলড্রেনস পার্ক ইত্যাদি। অ্যাডভেঞ্চার বিভাগে থাকবে ফিশিং-বোটিং-রাফটিং, সার্ভাইভাল ট্রেনিং, হর্স ব্যাক রাইডিং ইত্যাদি। আর বাংলা হাট হবে দিল্লি হাটের অনুকরণে। এখানে সব প্রদেশের হস্তশিল্প ও খাবার পাওয়া যাবে। থাকবে গান-নাচ-নাটক ইত্যাদির ব্যবস্থা।
প্রস্তাব অনুযায়ী, পর্যটন তালুকে ১০ হাজার লোকের কাজের ব্যবস্থা হবে। খরচ হবে ২৬৮ কোটি টাকা। কোস্টাল রেগুলেশন জোনে এই পর্যটনতালুক গড়ে উঠবে বলে কেন্দ্র ও রাজ্যের কাছে প্রয়োজনীয় আর্থিক ছাড় চাওয়া হয়েছে।
এই তিনটি প্রকল্প মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ ১১ হাজার ৯২৭ একর। এ ছাড়াও সামাজিক পরিকাঠামো গড়ার জন্য আরও কিঠু জমি চায় এনকেআইডি।
নয়াচরে মোট ৯৫০টি মৎস্যজীবী পরিবার রয়েছে। তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে। এ জন্য আধুনিক ব্যবস্থা-সহ একটি মৎস্যজীবী গ্রাম তৈরি করা হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি পরিবারের লোকেরা নির্মাণ কাজ এবং পর্যটকদের ‘গাইড’ হিসেবে কাজ পাবেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.