তিন বাড়িতে একযোগে হানা, মিলল কার্তুজ, রাতে হাসপাতালে প্রাক্তন মন্ত্রী
জেরায় গোয়েন্দাদের সঙ্গে দিনভর ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ সুশান্তর
জেরা তো নয়, ‘স্নায়ুর লড়াই’! ‘হাই প্রোফাইল’ সিপিএম নেতাকে হেফাজতে নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পরে সিআইডি-র অভিজ্ঞ গোয়েন্দাদের অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা।
সিআইডি সূত্রের খবর, অফিসারেরা যত বারই খুন ও অস্ত্র পাচারের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন ‘আমি কিছু জানি না’ বলে স্রেফ তাঁদের ‘উড়িয়ে দিয়েছেন’ প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। পাল্টা ‘চাপ দিলে’ প্রাক্তন মন্ত্রী ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্নকর্তাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘চাপ দিয়ে কোনও লাভ হবে না’। এমনকী, তাঁকে ‘পলিগ্রাফ’ পরীক্ষায় বসানো হতে পারে শুনে অফিসারদের জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সম্মতি ছাড়া ‘পলিগ্রাফ’ কিংবা ‘নার্কো-অ্যানালিসিস’, কোনও পরীক্ষায় বসানোর অনুমতিই আদালত দেবে না। শুধু তা-ই নয়, তিনি যে এক জন ‘সম্মানীয় বিধায়ক’ সে কথা অসংখ্য বার মনে করিয়ে এক সিআইডি অফিসারের উদ্দেশে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘থার্ড ডিগ্রি দিয়ে জেরার দিন আর নেই, সে কথা মনে রাখতে হবে’। তাই ‘স্নায়ুর লড়াই’টা চালিয়ে যেতে চাইছে সিআইডি। পরিস্থিতি বুঝেই পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের উপরে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে শীঘ্রই সুশান্তবাবুকে কেশপুরের পিয়াশালের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবছেন গোয়েন্দারা। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে সিআইডি-র তিন-তিনটি দল তাই শনিবার দুপুরে একযোগে অভিযান চালায় পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা রোড, বেনাচাপড়া এবং কলকাতার এজেসি বসু রোডে সুশান্তবাবুর বাসস্থানে। এর মধ্যে বেনাচাপড়ার বাড়ি থেকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে ব্যবহারযোগ্য ১৭টি ৭.৬৫ তাজা কার্তুজ, পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেলের ৫টি কার্তুজ, একটি পিস্তলের ‘ম্যাগাজিন’, কার্তুজ রাখার ‘পাউচ’ উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি সিআইডি-র। সিআইডি-র ইন্সপেক্টর পূর্ণশিব মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গিয়েছে।” সিআইডি-র দাবি, ওই বাড়িটি থেকেই একটি পেনের মতো দেখতে স্পাই ক্যামেরা (৮ জিবি মেমোরি), দু’টি সিম-কার্ড বিহীন মোবাইল, সুশান্তবাবুর ভাই প্রশান্ত ঘোষের নামে বহু নম্বর সংবলিত একটি টেলিফোন-ইনডেক্স ও কয়েকটি চাবিও মিলেছে। চন্দ্রকোনা রোডের বাড়িতে তল্লাশি করে দু’টি উন্নতমানের অয়্যারলেস সেট, দু’টি নোটবই (যার একটিতে আবার বেশ কিছু মোবাইল নম্বর রয়েছে) ‘সিজ’ করেন তদন্তকারী অফিসারেরা। এ দিন দুপুর ১টা নাগাদ কলকাতায় ২৪৭/১ এজেসি বসু রোডে মিন্টো পার্ক গভর্নমেন্ট হাউসিং এস্টেটের একটি ফ্ল্যাটে হানা দেয় সিআইডি। গোয়েন্দাদের দাবি, ওই আবাসনে পাঁচ তলায় ৪৬ নম্বর ফ্ল্যাটটি সুশান্তবাবুর। ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ছিল।
কলকাতায় ‘সিল’ করা সুশান্ত ঘোষের সেই ফ্ল্যাট। নিজস্ব চিত্র
সিআইডি-র দাবি, আবাসনের কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পেরেছে, মাঝেমধ্যে ওই ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন সুশান্তবাবু। ফ্ল্যাটের চাবি কেয়ারটেকারের কাছে না থাকায় গোয়েন্দারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চান, তালা ভেঙে তাঁরা ফ্ল্যাটে ঢুকবেন কি না। কিন্তু সিআইডি-কর্তারা তাঁদের তালা ভাঙতে নিষেধ করেন। গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, ফ্ল্যাটটি ‘সিল’ করে দিতে। পরে ফ্ল্যাটটি ‘সিল’ করে দেয় সিআইডি। সিআইডি-র ডিআইজি (অপারেশন) কালিয়াপ্পন জয়রামন বলেন, “ওই ফ্ল্যাটের চাবি জোগাড় করার চেষ্টা হবে। চাবি পাওয়া গেলে তবেই ওই ফ্ল্যাটে তল্লাশি করা সম্ভব হবে।”
রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার এই ‘তৎপরতা’য় যারপরনাই অস্বস্তি বেড়েছে সিপিএমের। দলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “আইন আইনের পথেই চলবে। আমার আর কী বলার থাকতে পারে!”
সিআইডি-র একটি সূত্র অবশ্য সংশয়ে, সুশান্তবাবুর বাড়ি থেকে ‘কার্তুজ উদ্ধার’ হলেও, তা তদন্তের কাজে কতটা সহায়ক হবে। কারণ, কোনও অভিযুক্ত হেফাজতে থাকাকালীন তাঁর আস্তানায় তল্লাশি চালিয়ে কোনও অস্ত্র কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে সাধারণত অভিযুক্তকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রথা অনুসরণ করেন তদন্তকারী অফিসারেরা। অভিযুক্তের উপস্থিতিতে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হলে বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে প্রাথমিক ভাবে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এ ক্ষেত্রে তল্লাশির সময়ে সুশান্তবাবুকে সঙ্গে রাখা জরুরি ছিল বলে সিআইডি ও পুলিশের বেশ কয়েক জন কর্তা মনে করেন। এ ব্যাপারে সিআইডি-র তরফে সরকারি ভাবে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তল্লাশির পরে সিআইডি-র ডিআইজি (অপারেশন) বলেন, “বেনাচাপড়ার বাড়ি থেকে বেশ কিছু তাজা কার্তুজ পাওয়া গিয়েছে। কার্তুজগুলি কী ধরনের, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।”
ভবানী ভবন থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়। নিজস্ব চিত্র
শনিবার রাতে সুশান্তবাবু অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে যত দ্রুত সম্ভব সুশান্তবাবুকে কেশপুরের পিয়াশালের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়ার ভাবনাও রয়েছে গোয়েন্দাদের মাথায়। সিআইডি সূত্রের খবর, গড়বেতা ৩ ব্লকের দাসেরবাঁধে যেখানে মাটি খুঁড়ে কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে, সেখানেও সুশান্তবাবুকে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে তখন গোটা ঘটনার বিবরণ সুশান্তবাবুর সামনে দিতে পারেন অফিসারেরা। কঙ্কাল উদ্ধারের পরে ডিএনএ-পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে যে সব সূত্র গেঁথে মামলা দায়ের হয়েছে, তা মাথায় রেখেই ওই বিবরণ দেওয়া হবে। ঘটনার দিন তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে যে ভাবে নির্দেশ দিয়ে ‘কাজ হাসিল করিয়েছিলেন’ বলে অভিযোগ উঠেছে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা করতে সুশান্তবাবুকে কেশপুরে নিয়ে যাওয়া জরুরি বলেই মনে করছে সিআইডি। পুলিশ সূত্রের খবর, প্রাক্তন মন্ত্রীকে কেশপুরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ইতিমধ্যেই জেলা পুলিশ-প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। সেই মতো ওই এলাকায় যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আর ‘স্নায়ুর লড়াই’ পেরিয়ে ভবানীভবনে এই দু’দিনের জেরায় কী জানলেন গোয়েন্দারা? সিআইডি-এর একটি সূত্র দাবি করছে, জেরার সময়ে ৯ বছর আগে কেশপুরের গণহত্যায় ‘অন্য কারও’ যোগসাজশ থাকতে পারে বলে এক বার তাদের বলেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী। ওই ‘অন্য কারও’ বলতে প্রাক্তন মন্ত্রী কী ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন, সেই ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য মিলবে বলে সিআইডি অফিসারেরা আশা করছেন। দিনের শেষে তদন্তকারী এক অফিসার জানান, খুন ও অস্ত্র আইনের ধারায় যে মামলা হয়েছে সুশান্তবাবুর নামে, তা বেনাচাপড়া থেকে উদ্ধার হওয়া হাড়গোড়ের ফরেন্সিক রিপোর্ট ও খুন করে লাশ গায়েবের অভিযোগকে ভিত্তি দিয়েছে। কার্তুজ উদ্ধারের পরে অস্ত্র আইনেও সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করার ক্ষেত্রে বাড়তি ‘হাতিয়ার’ এল। বৃহস্পতিবার রাত থেকে হেফাজতে রেখে দফায় দফায় জেরা করেও যখন মুখ খোলানো যাচ্ছে না প্রাক্তন মন্ত্রীর, তখন মামলার ক্ষেত্রে হাতেগরম তথ্যপ্রমাণ বা ‘মেটিরিয়াল এভিডেন্স’ জোগাড়ে জোর দিয়েছে সিআইডি।
সিআইডি অফিসারদের কয়েক জন জানান, প্রাথমিক তদন্তে যে তথ্য মিলেছে, তাতে অস্ত্র মজুত ও পাচারের কাজে প্রাক্তন মন্ত্রীর গাড়ির একাধিক চালক ও দেহরক্ষীকে ব্যবহার করা হয়েছে বলে তাঁদের সন্দেহ জোরদার হয়েছে। গত ১০ বছরে সুশান্তবাবুর সরকারি ও বেসরকারি গাড়ি কারা চালিয়েছেন তাঁদের নামের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি দেহরক্ষীদের নামের তালিকাও সংগ্রহ করা হচ্ছে। সুশান্তবাবুর বাড়ি লাগোয়া বন বিভাগের অতিথিশালার ‘গেস্ট রেজিস্ট্রার’ বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
উদ্ধার
বেনাচাপড়া থেকে
• ১৭টি ৭.৬৫ তাজা কার্তুজ (স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে ব্যবহারযোগ্য)
• ৩০৩ রিভলভারের ৫টি কার্তুজ
• পিস্তলের ‘ম্যাগাজিন’
• কার্তুজ রাখার ‘পাউচ’
• পেনের মতো স্পাই ক্যামেরা
• টেলিফোন ইনডেক্স (ভাইয়ের নামে)
• দু’টি সিম-কার্ডহীন মোবাইল, চাবির গোছা
চন্দ্রকোনা রোড থেকে
• দু’টি অয়্যারলেস সেট
• দু’টি নোটবই
২০০২ সালেই কিন্তু পিয়াশালের ঘটনায় ২০ জন সিপিএম নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল কেশপুর থানায় (কেস নং ৬১/০২)। তৃণমূলের তরফে যে ৭ জন দলীয় কর্মী নিহত বলে দাবি করা হয়েছিল, উদ্ধার হয়েছিল তাঁদের মধ্যে দু’জনের দেহও। অন্য ৫ জনের খোঁজ মেলেনি। তার পরেও কারও সাজা হয়নি। ‘নিষ্পত্তি’ হয়ে গিয়েছিল মামলার। তৃণমূলের অভিযোগ, সে সময়ের শাসকদল সিপিএমের প্রতি পক্ষপাতের কারণেই পুলিশ ঠিক মতো তদন্ত করেনি। মামলা তাই ভেস্তে গিয়েছিল। সেই মামলার কাগজপত্রও সিআইডি-র তরফে চেয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই ঘটনার তদন্তকারী আধিকারিককেও জেরা করতে চাইছে সিআইডি। রাতে হাসপাতালে শনিবার ভবানী ভবনে জেরা চলাকালীন অসুস্থ বোধ করেন সুশান্ত ঘোষ। দেখা যায় তাঁর রক্তচাপ তখন ১৬০/৯০। উচ্চ রক্তচাপের রোগী সুশান্তবাবুকে এর পর নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানে তাঁর ইসিজি করা হয়। তাতে কিছু মেলেনি। এর পর তাঁর ইকো-কার্ডিওগ্রামও করা হয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.