উন্নয়নের ঢালাও অর্থ কী ভাবে, স্পষ্ট দিশা নেই অমিত-বিবরণীতে
‘উন্নয়ন’ খাতে দরাজ হাতে দেদার টাকা বরাদ্দ করেছেন তিনি। কিন্তু সে টাকা কোথা থেকে আসবে?
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের পেশ করা আর্থিক বিবরণীতে তার হদিস খুঁজে পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদেরাই। তাই ধোঁয়াশা বাড়ছে। বাড়ছে বিভ্রান্তি। রাজস্ব খাতে কত আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন অর্থমন্ত্রী?
বিধানসভায় পেশ করা আর্থিক বিবরণী বলছে, চলতি অর্থবর্ষে রাজ্যের নিজস্ব কর বাবদ আয় হবে ২৭,৬৯০ কোটি টাকা, যা কিনা গত বারের চেয়ে ৬,৩৯০ কোটি বেশি। এই প্রায় ৩১% বাড়তি আয়ের উৎস কী?
মন্ত্রীর হিসেব তৈরি। কৃষি, ভূমি, স্ট্যাম্প ও রেজিস্ট্রেশন ফি, আবগারি শুল্ক, বিক্রয় কর সব খাতেই গত বারের তুলনায় কিছুটা বাড়তি আয় দেখিয়ে হিসেব মিলিয়েছেন তিনি। অতিরিক্ত আয় দেখিয়েছেন বিদ্যুৎ মাসুল এবং পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ করের ক্ষেত্রেও। কিন্তু কোন পথে আসবে সে সব?
বস্তুত এতগুলোর মধ্যে শুধু আবগারি শুল্কের প্রসঙ্গেই অমিতবাবু খোলসা করে জানিয়ে দিয়েছেন, মদে কর বসানো হয়েছে। সেখান থেকে কোষাগারে বাড়তি টাকা আসবে। কতটা বাড়তি, তারও একটা হিসেব দিয়েছেন। আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, এই খাতে চলতি অর্থবর্ষে আয় হবে ২,৪১৮ কোটি টাকা, গত বারের চেয়ে ৬০৬ কোটি বেশি।
কিন্তু এখানেও আশঙ্কার সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। ওঁদের বক্তব্য, মদে কর অতিরিক্ত বাড়ালে বহু গরিব মদ্যপায়ী ‘বেআইনি’ চোলাইয়ের দিকে ঝুঁকতে পারেন। তাতে অসুস্থতা, এমনকী মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়বে। ভিন রাজ্য থেকে আনা মদের রমরমা ব্যবসা শুরু হওয়ারও সম্ভাবনা। তাই এই সিদ্ধান্ত ‘আত্মঘাতী’ হতে পারে বলে এই মহল মনে করছেন।
পাশাপাশি ‘অনলাইন লটারি’-তেও কর চেপেছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এ বাবদ বাড়তি আয়ের স্পষ্ট হিসেব তিনি দিতে পারেননি। এটি ঢোকানো রয়েছে আর্থিক বিবরণীর ‘অন্যান্য কর’ খাতে, যেখান থেকে চলতি বছরে ১২৭ কোটি টাকা বাড়তি আয় দেখানো হয়েছে। এরই একটা অংশের সংস্থান করবে ‘অনলাইন লটারি।’
অর্থাৎ আয়বৃদ্ধির ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী এ পর্যন্ত যা তথ্য দিয়েছেন, তাতে বাড়তি ৬৩৯০ কোটি টাকার মধ্যে মেরেকেটে ৭০০ কোটির মতো হিসেব মিলছে। বাকিটা কী ভাবে আসবে?
শুক্রবারও বিধানসভায় এ প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। অমিতবাবু অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি। শুধু বলেছেন, “কর সরলীকরণ করে আয় বাড়ানো হবে।”
মন্ত্রীর মন্তব্যে বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। বিরোধীদের প্রশ্ন, যেখানে বিদ্যুতের দাম না-বাড়ানোর নীতি নেওয়া হয়েছে, ভর্তুকি রদেরও সিদ্ধান্ত হয়নি, সেখানে বিদ্যুৎ মাসুল থেকে ২৬৭ কোটির বাড়তি রাজস্ব কোন পদ্ধতিতে তোলা হবে? অন্য দিকে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গরিবদের ছাড় দিয়ে সম্পন্নদের থেকে, শপিং মল, উচ্চবিত্তের আবাসন থেকে জলকর নেওয়া যেত, এমনকী জেএনএনইউআরএমের টাকা পাওয়ার অন্যতম শর্তও ছিল এটি। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। রাজ্যের এক বামপন্থী অর্থনীতিবিদের কথায়, “এই প্রবণতা তো প্রাচীন বামপন্থীদের সস্তায় জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টার মতোই ভয়ঙ্কর!”
একই ভাবে বাড়ানো হয়নি যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট)-ও। সরকারি কর্তাদের বক্তব্য, এখন ভ্যাটের তিনটি ধাপ (স্ল্যাব)। প্রথম ধাপে রয়েছে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। যেগুলোয় ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় স্তরের পণ্যে ৪% ভ্যাট। তৃতীয় ধাপে মূলত বিলাসদ্রব্য। আগের সরকার এই ধাপে ভ্যাট ১২.৫% থেকে বাড়িয়ে ১৩.৫% করেছিল। নতুন সরকারের সামনেও বাছাই করা কিছু বিলাসদ্রব্যে কর বসানোর সুযোগ ছিল। তাতে রাজস্ব আদায় বাড়ত বলে সরকারি কর্তাদেরই একাংশ মনে করছেন।
বস্তুত অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাড়তি রাজস্ব আদায় করে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে খরচ বাড়ানোর পক্ষে নতুন সরকারের সামনে এ বছরটাই ছিল সবচেয়ে প্রকৃষ্ট সময়। কারণ, এখন শাসকদলকে কোনও নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। নতুন অর্থমন্ত্রী অবশ্য ‘উন্নয়ন’-এর জন্য এক-একটা দফতরকে গত বারের দ্বিগুণ-আড়াই গুণ বরাদ্দ করেছেন। বাড়তি আয়ের স্পষ্ট কোনও দিশা না দিয়েই!
ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে এখানেই। যার উত্তর খুঁজতে অর্থনীতিবিদেরাও হিমশিম। তাঁদেরই এক জনের মন্তব্য, “কিছুই তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না! বিক্রয় কর কী ভাবে বাড়ানো হবে, নতুন কোনও কর বসানো হবে কি না, তারও কোনও হিসেব নেই! বিভ্রান্তি তো হবেই।”
অর্থনীতিবিদদেরই যখন এই হাল, তখন সাধারণ মানুষ কী বুঝবেন এই আর্থিক বিবরণী থেকে? উত্তর মেলেনি অর্থমন্ত্রীর কাছে। শুক্রবার যিনি এ প্রসঙ্গে শুধু বলেন, “সব কিছু পরিষ্কার করে দেব।”
এই পরিস্থিতিতে সবার নজর অগস্টের শেষে বিধানসভায় পেশ হতে চলা অর্থবিলের দিকে। এই আশায় যে, তাতে হয় তো কিছু দিশা মিললেও মিলতে পারে।
বাড়তি আয়
পথ জানি
আবগারি শুল্ক (৬০৬)
অনলাইন লটারি ইত্যাদি (১২৭) নেই
জানা নেই
কৃষি (২.৭৭)
আয়-ব্যয়ে কর (১১৩.২৫)
ভূমি-রাজস্ব (৪৩৩.৮৮)
স্ট্যাম্প-রেজিস্ট্রেশন ফি (৭৩৭.৭৮)
সম্পত্তি কর (০.০২)
বিক্রয় কর (৩৭৪৮.৭২)
যানবাহনে কর (৩৫২.৩৩)
পণ্য ও যাত্রী কর (০.০১)
বিদ্যুৎ মাসুল (২৬৬.৯৯)
(সব অঙ্ক কোটি টাকায়)
ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে ডিভিসি-র টানাপোড়েন চলছেই। সেই লড়াইয়ে এখন সামিল হয়েছে ঝাড়খণ্ড সরকারও। ডিভিসি সূত্রের খবর, জলাধার নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় যে-ভাবে জল ছাড়ার কথা বলা আছে, তা মেনে চললে পাঞ্চেতের জলস্তর কোনও ভাবেই ৪২৫ ফুট অতিক্রম করার কথা নয়। শুক্রবার দুপুরেই সেখানে জলস্তর ৪২২ ফুটে পৌঁছে যায়। জলস্তর ৪২৫ ফুট ছাড়ালে প্লাবিত হবে ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা। কোনও মতেই যাতে জলস্তর ৪২৫ ফুটের মাত্রা অতিক্রম করতে না-পারে, সেই জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে ঝাড়খণ্ড সরকার। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে মহাকরণ থেকে বৃহস্পতিবারেই সেচ দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারকে মাইথনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কারও নেই। অনেকের বাড়ি-জমি ডুবে গিয়েছে। আমরা পরে তাঁদের সে-সব ব্যবস্থা করে দেব। আপাতত দুর্গতদের সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছি।” আজ, শনিবার থেকে মন্ত্রীরা জেলায় জেলায় যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। কলকাতা পুলিশ হাসপাতালে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে তোড়ে জল ছাড়ার প্রসঙ্গও তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “এই ক’দিন আমরা প্রাণপণে বন্যা ঠেকিয়ে রেখেছি। জল ছাড়তে দিইনি। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। আগে মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ না-দিয়ে জল ছাড়া হত। এখন অন্তত সেটা হচ্ছে না।”
রাজ্যের উদ্বেগ বাড়িয়েছে কংসাবতী জলাধারের অবস্থাও। রাজ্যের সেচ দফতর জানায়, কংসাবতী জলাধারে জলস্তর ৪৩৪ ফুট ছুঁয়ে ফেলেছে। ওই জলাধারের জলধারণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ৪৪৪ ফুট। তাই ঝুঁকি না-নিয়ে ওই জলাধার থেকে ২০ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়া শুরু হয়েছে। সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে জলাধার সংলগ্ন এলাকাগুলিকে। প্রবল বৃষ্টি আর জলাধারের ছাড়া জলে বন্যার আশঙ্কা বাড়ছে পূর্ব মেদিনীপুরে। ওই জেলার পটাশপুর ও ভগবানপুরের বেশ কিছু গ্রাম জলমগ্ন। কেলেঘাই, চণ্ডীয়া ও বাগুই নদীর জল চরম বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। রূপনারায়ণের বাঁধ ধসে মহিষাদলের মায়াচরে ও হুগলি নদীর পাড় উপচে হলদিয়ার নয়াচরে জল ঢুকছে। ভরা কোটালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলেই আশঙ্কা জেলা প্রশাসনের। উপকূলবর্তী এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
রাজ্যের বহু জায়গায় নদীবাঁধ এবং সেতু ভেঙে গিয়েছে বলে জানান সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। এর মধ্যেই আজ, শনিবার পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনায় ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসার কথা। তাতে বিপদ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেচমন্ত্রী। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কয়েকটি জায়গায় নদীবাঁধ ভেঙে গিয়েছে। তা ঠিকমতো সারানোর আগেই আজ, শনিবার ভরা কোটালে ওই সব এলাকায় নতুন করে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি-২ ব্লক এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা, নামখানা, গোসাবা, সাগর প্রভৃতি এলাকায় সেচ দফতর ও পঞ্চায়েত প্রশাসনকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আরও ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে দুর্গতদের জন্য। বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে দুই জেলা প্রশাসনই। সেচমন্ত্রী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী জরুরি ভিত্তিতে কিছু টাকা দিয়েছেন। তা দিয়ে প্রয়োজনীয় মেরামতির কাজ চালানো হচ্ছে।”
রাজ্যের দুর্যোগ পরিস্থিতি যে আরও খারাপ হবে, তার ইঙ্গিত মিলেছে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসেও। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, দক্ষিণবঙ্গের উপরে থাকা নিম্নচাপটি আরও শক্তিশালী হয়েছে। তার ফলে উপকূলে জোরদার হাওয়া বইবে। উত্তাল হবে সমুদ্র। মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যেতে নিষেধ করেছেন আবহবিদেরা। নিম্নচাপটির অবস্থান শুক্রবারেও ছিল ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের উপরে। তাই রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টি বাড়বে বলে মনে করছেন আবহবিদেরা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের পক্ষে অশনি-সঙ্কেত, ওই শক্তিশালী নিম্নচাপটি আজ, শনিবার নাগাদ ঝাড়খণ্ডের দিকে সরতে পারে। তার প্রভাবে ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার একাংশে ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দফতর। আর সেই জল ধেয়ে আসবে পশ্চিমবঙ্গের দিকেই।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, “শনিবারেও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিতে বৃষ্টি হবে। বেশি বৃষ্টি হবে ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন জেলাগুলিতে। নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে সরে যাবে ঝাড়খণ্ডের দিকে। সেখানে বৃষ্টি উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.