দাপুটে নিম্নচাপে বাংলার চাপ ঠেলেই জলের গ্রাস
বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছাড়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাংলার চাপ চলছেই। কিন্তু ডিভিসি-র উপরে পশ্চিমবঙ্গের সেই চাপ বেমালুম চাপা দিয়ে দিল একা নিম্নচাপই।
ঝাড়খণ্ডে প্রবল বৃষ্টি নামায় বাঁধ বাঁচানোর তাগিদে পশ্চিমবঙ্গের অনুরোধ বা চাপকে আর খুব বেশি আমল দিতে পারছে না ডিভিসি। যতটা সম্ভব জল ছাড়ার পরিমাণ বাড়িয়ে বাঁধ রক্ষা করতে তারা মরিয়া। তার উপরে আছে অতিবর্ষণে দিশাহারা ঝাড়খণ্ডের চাপ। ডিভিসি বেশি মাত্রায় জল ছাড়ার ফলে নিম্ন দামোদরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টি এবং গত চার দিন ধরে ডিভিসি-র ছাড়া জলে এমনিতেই হুগলির আরামবাগ, গোঘাট, খানাকুলের বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায়। হাওড়ার আমতা ও উদয়নারায়ণপুরের অবস্থাও সঙ্কটজনক। ডিভিসি-র অতিরিক্ত জল দামোদরের খাত বেয়ে নেমে আসার পরে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না রাজ্য প্রশাসন।
রাজ্যের সঙ্গে তুমুল টানাপোড়েনের মধ্যেই শুক্রবার দুপুরের পর থেকে ডিভিসি জল ছাড়ার হার ৮৫ হাজার কিউসেক থেকে বাড়িয়ে ৯৫ হাজার কিউসেক করে দেয়। আর দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ বেড়ে হয় এক লক্ষ ১৫ হাজার কিউসেক। ডিভিসি-র এক মুখপাত্র জানান, আবহাওয়া দফতর ঝাড়খণ্ডে আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। তাই আজ, শনিবার থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ আরও বাড়বে। নইলে পাঞ্চেত জলাধারেরই বিপদ হতে পারে। বৃহস্পতিবার রাতে পাঞ্চেতে জল ঢুকছিল এক লক্ষ ৬০ হাজার কিউসেক হারে। তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাপে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ৮৫ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়ছিল ডিভিসি। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত জল ছাড়ার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয় তারা।
জল ছাড়ার পরিমাণ*
পাঞ্চেত জলাধার৯০ হাজার
মাইথন জলাধার৫ হাজার
দুর্গাপুর ব্যারাজ১ লক্ষ ১৫ হাজার
কংসাবতী জলাধার২০ হাজার
*কিউসেক হারে
ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে ডিভিসি-র টানাপোড়েন চলছেই। সেই লড়াইয়ে এখন সামিল হয়েছে ঝাড়খণ্ড সরকারও। ডিভিসি সূত্রের খবর, জলাধার নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় যে-ভাবে জল ছাড়ার কথা বলা আছে, তা মেনে চললে পাঞ্চেতের জলস্তর কোনও ভাবেই ৪২৫ ফুট অতিক্রম করার কথা নয়। শুক্রবার দুপুরেই সেখানে জলস্তর ৪২২ ফুটে পৌঁছে যায়। জলস্তর ৪২৫ ফুট ছাড়ালে প্লাবিত হবে ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা। কোনও মতেই যাতে জলস্তর ৪২৫ ফুটের মাত্রা অতিক্রম করতে না-পারে, সেই জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে ঝাড়খণ্ড সরকার। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে মহাকরণ থেকে বৃহস্পতিবারেই সেচ দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারকে মাইথনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কারও নেই। অনেকের বাড়ি-জমি ডুবে গিয়েছে। আমরা পরে তাঁদের সে-সব ব্যবস্থা করে দেব। আপাতত দুর্গতদের সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছি।” আজ, শনিবার থেকে মন্ত্রীরা জেলায় জেলায় যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। কলকাতা পুলিশ হাসপাতালে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে তোড়ে জল ছাড়ার প্রসঙ্গও তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “এই ক’দিন আমরা প্রাণপণে বন্যা ঠেকিয়ে রেখেছি। জল ছাড়তে দিইনি। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। আগে মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ না-দিয়ে জল ছাড়া হত। এখন অন্তত সেটা হচ্ছে না।”
রাজ্যের উদ্বেগ বাড়িয়েছে কংসাবতী জলাধারের অবস্থাও। রাজ্যের সেচ দফতর জানায়, কংসাবতী জলাধারে জলস্তর ৪৩৪ ফুট ছুঁয়ে ফেলেছে। ওই জলাধারের জলধারণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ৪৪৪ ফুট। তাই ঝুঁকি না-নিয়ে ওই জলাধার থেকে ২০ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়া শুরু হয়েছে। সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে জলাধার সংলগ্ন এলাকাগুলিকে। প্রবল বৃষ্টি আর জলাধারের ছাড়া জলে বন্যার আশঙ্কা বাড়ছে পূর্ব মেদিনীপুরে। ওই জেলার পটাশপুর ও ভগবানপুরের বেশ কিছু গ্রাম জলমগ্ন। কেলেঘাই, চণ্ডীয়া ও বাগুই নদীর জল চরম বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। রূপনারায়ণের বাঁধ ধসে মহিষাদলের মায়াচরে ও হুগলি নদীর পাড় উপচে হলদিয়ার নয়াচরে জল ঢুকছে। ভরা কোটালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলেই আশঙ্কা জেলা প্রশাসনের। উপকূলবর্তী এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
রাজ্যের বহু জায়গায় নদীবাঁধ এবং সেতু ভেঙে গিয়েছে বলে জানান সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। এর মধ্যেই আজ, শনিবার পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনায় ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসার কথা। তাতে বিপদ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেচমন্ত্রী। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কয়েকটি জায়গায় নদীবাঁধ ভেঙে গিয়েছে। তা ঠিকমতো সারানোর আগেই আজ, শনিবার ভরা কোটালে ওই সব এলাকায় নতুন করে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি-২ ব্লক এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা, নামখানা, গোসাবা, সাগর প্রভৃতি এলাকায় সেচ দফতর ও পঞ্চায়েত প্রশাসনকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আরও ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে দুর্গতদের জন্য। বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে দুই জেলা প্রশাসনই। সেচমন্ত্রী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী জরুরি ভিত্তিতে কিছু টাকা দিয়েছেন। তা দিয়ে প্রয়োজনীয় মেরামতির কাজ চালানো হচ্ছে।”
রাজ্যের দুর্যোগ পরিস্থিতি যে আরও খারাপ হবে, তার ইঙ্গিত মিলেছে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসেও। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, দক্ষিণবঙ্গের উপরে থাকা নিম্নচাপটি আরও শক্তিশালী হয়েছে। তার ফলে উপকূলে জোরদার হাওয়া বইবে। উত্তাল হবে সমুদ্র। মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যেতে নিষেধ করেছেন আবহবিদেরা। নিম্নচাপটির অবস্থান শুক্রবারেও ছিল ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের উপরে। তাই রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টি বাড়বে বলে মনে করছেন আবহবিদেরা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের পক্ষে অশনি-সঙ্কেত, ওই শক্তিশালী নিম্নচাপটি আজ, শনিবার নাগাদ ঝাড়খণ্ডের দিকে সরতে পারে। তার প্রভাবে ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার একাংশে ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দফতর। আর সেই জল ধেয়ে আসবে পশ্চিমবঙ্গের দিকেই।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, “শনিবারেও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিতে বৃষ্টি হবে। বেশি বৃষ্টি হবে ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন জেলাগুলিতে। নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে সরে যাবে ঝাড়খণ্ডের দিকে। সেখানে বৃষ্টি উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.