২৯ আশ্বিন ১৪১৯ সোমবার ১৫ অক্টোবর ২০১২



প্রতিমার গায়ে পড়ছে তুলির শেষ টান। প্যান্ডেলের কাঠামোতেও ঠোকা হচ্ছে ফিনিশিং টাচের পেরেক। কেনাকাটার প্রহর তাড়াহুড়ো করে শেষের পথে। প্রকৃতিও উজাড় করে দিয়েছে
তার শারদ-ভাণ্ডার— শিউলি-কাশ-রোদ্দুর-মেঘের ভেলা। বাকি শুধু সেই দিন ক’টি আসার। আশার জোয়ারে বুক বেঁধে বাঙালি এখন তাদেরই অপেক্ষায়— বোধন থেকে নবমীর রাত।
শেষের দিনটির কথা আনন্দের শুরুয়াতেই মনে করাটা মূর্খামি। তাই উত্সবের দিন ক’টির আগে কী খ্যাপামিতে ডুবে রয়েছে বং-সন্তানেরা তারই খবরাখবর নিয়ে এক্সক্লুসিভ শারদ সংবাদ।
‘দাদারা’ মন্ত্রী হওয়ায় জমেছে লড়াই, ‘দিদি’ বললেন সবই তাঁর পুজো
যুবকল্যাণমন্ত্রীর ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছেন পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী। বুক চিতিয়ে লড়ছেন শিল্পমন্ত্রী। দুদ্দাড় করে উঠে আসছেন পরিবহণমন্ত্রীও। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী বা বিধায়ক নন, তবু কলকাতার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য)-এর দৌড়ই বা কীসে কম! পুজো-আপডেটের সার সংক্ষেপে এটুকু না লিখলেই নয়। এমন নয় যে নেতা-মন্ত্রীর দাপট ছাড়া পুজোই হচ্ছে না কলকাতায়। এমনও নয়, এই প্রথম কলকাতার পুজোয় রাজনৈতিক নেতাদের ছায়া পড়ল। কিন্তু নেতা-মন্ত্রী-রাজ্যসভার সাংসদ-কাউন্সিলর থেকে ব্লক সভাপতি, সবাইকে এমন ঢাকঢোল পিটিয়ে পুজোর ময়দানে নামতে আগে কি দেখেছে কলকাতা? এ বার ‘উপদেষ্টা’ বা ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’-এর নামমাত্র অস্তিত্ব থেকে এক লাফে কমিটির ‘সভাপতি’-র ভূমিকায় উঠে এসেছেন বেশ কয়েক জন বিধায়ক বা মন্ত্রী। ভবানীপুর, কালীঘাট, বরাহনগর, কামারহাটি থেকে হুগলির কম করে ৪০টি পুজোর ব্যানারে মদন মিত্রের নাম। চেতলায় চোদ্দ আনা পুজোর সভাপতির নামই ববি (ফিরহাদ) হাকিম। মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নাম ব্যবহার করতেও বেহালার পুজো কমিটিগুলির উৎসাহের অন্ত নেই। এ যুগের দাদাদের মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু অরূপ বিশ্বাস। তিনি একটি পুজো নিয়েই ব্যস্ত। পুজোর ময়দানে দাদায়-দাদায় রেষারেষির আবহে ‘দিদি’ কিন্তু সবাইকে মিলিয়ে দিচ্ছেন। পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠকে ‘সব পুজোই আমার পুজো’ বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

জৌলুস বাড়াতে নয়া ধারণা ‘পুজোর মুখ’
পুজো-বিপণনের নতুন শব্দবন্ধ এখন পুজো-অ্যাম্বাসাডর। এমনিতে অ্যাম্বাসাডর অর্থ দূত বা প্রতিনিধি। তবে কোনও বারোয়ারি পুজোর অ্যাম্বাসাডরকে বলা যেতে পারে সেই পুজোর মুখ। তাঁকে সামনে রেখেই সেই বারোয়ারি পুজো টানবে দর্শক এবং আরও বেশি করে অর্থ— পৃষ্ঠপোষক ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। স্বভাবতই, সেই পুজোর মুখ কোনও তারকা না-হয়ে যান কী ভাবে? যেমন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। নিজের পুরনো পাড়া, রাজা বসন্ত রায় রোডে নিজেদের পুজোর মুখ এ বার তিনি। জোড় হাতে, আগাম শারদ-শুভেচ্ছায় ঝকঝকে হাসিমুখের ঋতুপর্ণার ছবি ও বার্তা সম্বলিত হোর্ডিং গোটা শহর জুড়ে— ৭০টি হোর্ডিং ও ২০টি কাট-আউট। সেলিব্রিটিকে পুজোর মুখ করে শুধু পুজোর বিপণন নয়, একই সঙ্গে সেই পুজো উপলক্ষে সেলিব্রিটিরও প্রচার। পুরাণের দেবী আর সেলুলয়েডের দেবী যেন একে অপরের পরিপূরক! বেহালার একটি পুজোর অ্যাম্বাসাডর টলিউডের উঠতি নায়ক সোহম। এখানেও সেই পাড়া-একাত্মতা। আর্য সমিতি রোডে বড় হয়ে ওঠা সোহম গত বছর থেকেই নিজের পাড়ায় পুজো-অ্যাম্বাসাডর। একটা সময়ে পুজো বিপণনের প্রধান কৌশল ছিল, প্রতিমা শিল্পীদের নাম আগাম ঘোষণা করা। বারোয়ারি পুজোর ব্যানার, হোর্ডিংয়ে জ্বলজ্বল করত প্রতিমা শিল্পীদের নাম। তার পরে এল সেই সঙ্গে আলোকসজ্জা ও মণ্ডপসজ্জার বিশেষত্বের উল্লেখ। থিম পুজোর রমরমার যুগ থেকে এখনও পর্যন্ত শিল্পীর নাম থাকছে ‘সমগ্র পরিকল্পনা’ বা ‘সৃজনশীল ভাবনা’-র উপস্থাপক হিসেবে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে পুজো-অ্যাম্বাসাডর। কলকাতার প্রথম ঘোষিত পুজো-অ্যাম্বাসাডর মিঠুন চক্রবর্তী। সেটা ছিল ২০০৮ সাল। রাসবিহারী এলাকার একটি পুজো সে বার মিঠুনকে পুজোর মুখ করে শহর জুড়ে হোর্ডিং ছড়িয়ে দিয়েছিল।

এক হাতে অনেক পুজো, শিল্পীর ভাবনা মান নিয়ে
একাধিক পুজোর কাজ করতে গিয়ে কোথাও একটা আপস করতেই হয়। সব পুজো তাঁদের চোখে ‘লেটার মার্কস’ পায় না। তবে চাহিদা আর পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে ‘একাধিক সন্তান’-কে সমান গুরুত্ব দিতে মরিয়া চেষ্টা চালান কলকাতার পুজো ভাবনার কারিগরেরা। শিল্পী ভবতোষ সুতার যেমন এ বার কাজ করছেন তিনটে পুজোয়। শহরের তিন জায়গায় তিনটে পুজোতেই কি সমান গুরুত্ব দিতে পারছেন? ভবতোষবাবুর অকপট স্বীকারোক্তি, “বাস্তবে সম্ভব হয় না। কোনওটাকে একশোয় নব্বই দেব, তো কোনওটাকে ষাটের বেশি নয়। মানের কিছুটা হেরফের তো হবেই।” শিল্পী সনাতন দিন্দাও মনে করেন একাধিক কাজ করলে মানের সঙ্গে কিছুটা আপস করতে হয়। তবে তাঁর দাবি, তিনি চেষ্টা করেন নিজের সেরাটা দিতে। এবং তা করতে গিয়ে আত্মত্যাগও করতে হয়, বলছেন তিনি। এ বার দু’টো পুজো করতে গিয়ে প্যারিসে নিজের প্রদর্শনী পর্যন্ত বাতিল করেছেন। দুটোই তার কাছে এখন যমজ সন্তানের মতো, যার কাউকেই হেলাফেলা করা যায় না। আর এক শিল্পী অমর সরকার আবার মনে করেন টিমওয়ার্ক ঠিক থাকলে একাধিক কাজও ভাল করা যায়। এ বার শহরের চার দিকে চারটে পুজোর দায়িত্বে আছেন তিনি। তাঁর মতে, ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’ করতে পারলে সব পুজো সম মানের না হলেও একটা নির্দিষ্ট মানের থেকে খারাপ হয় না। শিল্পী পূর্ণেন্দু দে-র মতে আবার একাধিক কাজ করতে করতে কোনও একটা কাজ যেন নিজে থেকেই ভাল হতে থাকে। অন্য দিকে শিল্পী রূপচাঁদ কুণ্ডুর মতে, একসঙ্গে দু’টোর বেশি কাজ ভাল করা যায় না। মানের এমন ভাবনা নিয়েই জমে উঠেছে কলকাতার পুজো-প্রস্তুতি।

দুগ্গা ঠাকুরের দেশে যেতে ভরসা এ বার ট্রাম
এক ট্রাম, অনেক পুজো। পুজোর ভিড়ে নিশ্চিন্তে ঠাকুর দেখার সুযোগ করে দিতে পুজোর চার দিনে বিশেষ পরিষেবা দেবে কলকাতা ট্রাম কোম্পানি (সিটিসি)। ষষ্ঠী থেকে নবমী রাজাবাজার ও গড়িয়াহাট ডিপো থেকে সকালে একটি, বিকেলে ধর্মতলা থেকে দু’টি ট্রাম দর্শনার্থীদের নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরবে। যে সব এলাকায় অনেক পুজো হয়, তার কাছের ট্রাম গুমটিতে দাঁড়াবে ট্রাম। যাত্রীরা বড় পুজোগুলি দেখে ফিরে এলে রওনা দেবে পরবর্তী আকর্ষণের দিকে। সকাল আটটায় রাজাবাজার থেকে পুজো-স্পেশাল ট্রামটি ছেড়ে পার্ক সার্কাস, গড়িয়াহাট, খিদিরপুর ও শ্যামবাজার হয়ে ফের ফিরবে রাজাবাজারে। সকাল আটটায় গড়িয়াহাট থেকে ছাড়া ট্রামটি পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, বাগবাজার, শ্যামবাজার হয়ে ফিরবে গড়িয়াহাটে। বিকেল সাড়ে তিনটে ও চারটেয় ধর্মতলা থেকে দু’টি ট্রাম গ্যালিফ স্ট্রিট, খিদিরপুর, পার্ক সার্কাস, গড়িয়াহাট, রাজাবাজার হয়ে ফিরবে ধর্মতলায়। রাজাবাজার ও গড়িয়াহাট দু’জায়গা থেকে ছাড়বে দু’টি হেরিটেজ ট্রাম ‘বনলতা’ বা ‘বলাকা’র একটি। এই পরিষেবা পেতে মাথাপিছু ৫০ টাকার আগাম টিকিট কাটতে হবে। ওই সব ট্রামে বোতলবন্দি জল কেনা যাবে। থাকবেন এক জন যাত্রী-সহায়ক। ষষ্ঠী থেকে নবমী ১০০ টাকার ‘অল-ডে’ টিকিটে কলকাতার চৌহদ্দির মধ্যে সিটিসি-র বাস বা ট্রামে ইচ্ছে মতো ঘোরা যাবে।

মণ্ডপে মানুষের হাসিই পুরস্কার জরিশিল্পীদের

ছড়িয়ে ছিটিয়ে সুতো, দড়ি, আঠা, বোর্ড। গভীর মনোযোগে কাজে ব্যস্ত কয়েক জন। চুমকি, পাথর, কাচ, ভেলভেটে তৈরি হবে মায়ের গলার হার, বুকের চেলি, কোমরবন্ধ, কানপাশা। মণ্ডপের বাহারি আলোয় ঝলমল করবে সে সব। তখন অবশ্য তাঁদের কথা কেউ মনে রাখবে না। জরির সাজের এই কুশীলবেরা চলে যাবেন পরিচিত অন্ধকারে। কালনা শহরে মূলত ৮টি কারখানায় এখন প্রতিমার জরির সাজ তৈরি হয়। দেড়শোরও বেশি শিল্পী যুক্ত এই কাজে। রাখি পূর্ণিমার পর থেকেই শুরু হয় গয়না তৈরির কাজ। কলকাতার বড়বাজার থেকে নিয়ে আসা হয় সাজ তৈরির জিনিসপত্র। তবে প্রতিমা শিল্পীদের যদি বিশেষ কোনও চাহিদা থাকে, হয়তো কোনও বিশেষ বাহারি রং অথবা বিশেষ নকশা, তাও তৈরি করে দেন এই শিল্পীরা। সারা বছরই এই কাজ করলেও দুর্গাপুজোয় এমন বরাত মেলে বেশি। এক সময়ে শোলার সাজের চাহিদা ছিল বেশি। কিন্তু এখনকার দস্তুর মতো জরির সাজই বেশি পছন্দ ব্যবসায়ী থেকে মৃৎশিল্পীদের। একে উজ্জ্বল সোনালি রং, তার উপর নিপুণ হাতের রকমারি নকশাকাটা। পুজোর চার দিন মণ্ডপে ঢল নামবে মানুষের। মণ্ডপ, আলো, প্রতিমা, উদ্যোক্তাদের প্রশংসা বা বিচারকদের বিচারে বাদ যাবে না কিছুই। শুধু আঁধারে রয়ে যাবেন এই শিল্পীরা।

প্রাক্তন ফুটবলারের হাতে সেজে উঠছেন মা দুর্গা
বেশ কয়েক বছর আগে পায়ের চোট তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিল ফুটবল মাঠ থেকে। এই ক’বছরে উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার প্রাক্তন ফুটবলার সুদীপ দাস হয়ে গিয়েছেন পুরোদস্তুর প্রতিমা শিল্পী। সুদীপবাবুর তৈরি দুর্গাপ্রতিমা এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকী কলকাতাতেও পাড়ি দিচ্ছে। বেজায় ব্যস্ত তিনি। কখনও সিংহের মুখ তৈরি করছেন, কখনও বা প্রতিমার গায়ে রং চাপাচ্ছেন। ৩১টি পুজোর প্রতিমার বায়না রয়েছে যে। নিজের বাড়িতেই প্রতিমা গড়েন বছর চল্লিশের সুদীপবাবু। ছেলেবেলা থেকেই ভাল ফুটলার হিসেবে নাম ডাক ছিল তাঁর। এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে বারাসত, কলকাতা, অসম, শিলিগুড়ি-সহ বহু এলাকায় ফুটবল খেলেছেন। কলকাতার এরিয়ান ক্লাবে খেলেও সাড়া ফেলেছিলেন। বছর বারো আগে অসমের একটি টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে পায়ে বড় ধরনের চোট পান। খেলা ছেড়ে দিতে হয়। কী করা যায়, এই ভাবনা থেকেই প্রতিমা তৈরিতে হাতেখড়ি। বছর দশেক আগে শখের বশে স্থানীয় প্রতিমা শিল্পী বলরাম পালের সহযোগিতায় কয়েকটি সরস্বতী প্রতিমা নির্মাণ করেন তিনি। দুর্গাপ্রতিমা বানানোর কাজে প্রথম হাত দেন ২০০৪ সালে। ২০০৬ সাল থেকে নিজেই প্রতিমা গড়ছেন সুদীপবাবু। এলাকার মানুষেরা এক জন ফুটবলারকে প্রতিমা শিল্পী হয়ে উঠতে দেখে অবাক!

পুজোর বাজারে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ই ‘অসুর’
বিদ্যুত্সচিব জানিয়েছেন, “রাজ্যে বিদ্যুতের কোনও অভাব নেই।” তবু পুজোর মুখে বাঁকুড়া জেলা জুড়ে দফায় দফায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বাসিন্দারা। এক দিকে, ভ্যাপসা গরমে নাকাল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অন্য দিকে, জেনারেটরের টিমটিমে আলোয় দোকানগুলিতে কেনাবেচার দফরফা বলে ক্ষোভ ব্যবসায়ী মহলে। ফলে পুজোর বাজারে এ বার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ই তাঁদের কাছে ‘অসুর’ হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েক দিন ধরে সন্ধ্যা নামলেই ঘণ্টা খানেক ধরে বিদ্যুৎ বিপর্যয় প্রায় ‘রুটিন’ হয়ে উঠেছে জেলার বিভিন্ন এলাকায়। জেনারেটর থাকলেও তাতে দোকানের সব আলো জ্বালানো যায় না। ফলে ক্রেতাদের সমস্যা হচ্ছে। আবার অন্ধকারে ক্রেতারাও বাজার করতে বাড়ি থেকে বের হতে চাইছেন না। ফলে আখেরে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই ক্ষতি হচ্ছে। ক্রেতারাও জানাচ্ছেন, দিনের বেলায় রোদের তেজে শান্তিতে বাজার করা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা রাতের বেলায় বাজার করতে স্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় তাও সম্ভব হচ্ছে না। সমস্যায় পড়ছেন মৃৎশিল্পীরাও। বৈদ্যুতিন বাতির বদলে গ্যাসের হ্যাজাক অথবা মোমবাতির আলোই এখন তাঁদের ভরসা।

চাঁচলে মুখ তুলল পদ্মের কলি
পদ্ম ফুলের খোঁজে এ বার চাঁচলের পুজো উদ্যোক্তাদের আর হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না। কারণ, দেবী আরাধনায় নিজেদের চাষ করা ফুল বিলিয়ে দেবেন গ্রামবাসীরা। এ জন্য পয়সা দাবি করবেন না কেউ। এমনই অভিনব ঘটনা ঘটবে চাঁচল লাগোয়া শ্রীরামপুরে। এত দিন পদ্মফুলের জন্য কোথায় না কোথায় যেতে হয়েছে পুজো কমিটির লোকজনকে। গ্রাম থেকে শহর যেখানে খোঁজ মিলেছে সেখানে দৌড়ে গিয়েছেন তাঁরা কয়েকটা তাজা ফুলের জন্য। ফুল না মিললে কলি নিয়েই ফিরতে হয়েছে। পুজো আয়োজকদের সমস্যার কথা ভেবে প্রায় এক বিঘের জলাশয়ে পদ্ম ফুলের চাষ করেছেন শ্রীরামপুরের বাসিন্দারা। ইতিমধ্যে থরে থরে ফুল ফুটেছে সেখানে। কয়েক দিন পরে তা বিলিয়ে দেওয়া হবে। বাসিন্দারা জানান, পুজোর পরে গ্রামে বড় যজ্ঞ অনুষ্ঠান হয়। সেখানেও পুজোয় পদ্মফুল লাগে। কিন্তু সেই ফুল সংগ্রহ করতে নাজেহাল হতে হয় তাঁদের। সহজে মেলে না। মিললেও চড়া দাম। সমস্যা মেটাতে স্থানীয় জলাশয়ে পদ্মফুল চাষ করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। গত বছর পুজোর পরে চারা এনে পদ্ম চাষ শুরু করেন বাসিন্দারা। কয়েক মাসে জলাশয়ের জল সবুজ পাতায় ঢেকে যায়। কলি মুখ তোলে। ফুল ফোটে। জলাশয়কে আগলে রেখে শুরু হয় পরিচর্যার কাজ। পুজোর প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন ফুল নষ্ট না করে সে জন্য পালা করে পাহারাও দেওয়া হয়।

তিন বছর পর দুর্গার পুজোয় পুড়বে রাবণ
এক বছরেরও বেশি হিংসা থেমেছে। মাথা চাড়া দিতে পারেনি অশান্তি ডেকে আনা শক্তি। যেন তারই প্রতীক হিসেবে তিন বছর পরে এ বার দুর্গাপুজোয় ফের ‘রাবণ পোড়া’ উৎসবে মাতবে লালগড়। অকাল বোধন করে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিলেন রামচন্দ্র। রাবণ বধ হয়েছিল দশমীতে। সে জন্য দুর্গাপুজোর দশমীর সন্ধ্যায় ঘটা করে বহু জায়গায় হয় রাবণ দহন। রাবণের একটি বিশাল কাঠামো বানানো হয়। বাঁশের মূল কাঠামোর উপরে কাগজের মণ্ড, রঙিন কাগজ ও বাঁশের টুকরো দিয়ে তৈরি সেই রাবণের গোটা শরীর ঠাসা থাকবে বোমা ও পটকায়। রাবণ পোড়া শুরু হলে সেই বাজি ফাটতে থাকে সশব্দে। এই উৎসব মূলত উত্তর ভারতের হলেও পশ্চিমবঙ্গের লালগড়, খড়্গপুরের মতো বেশ কিছু জায়গায় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে এই প্রথা। লালগড় শেষ ‘রাবণ পোড়া’ দেখেছে ২০০৮-এর পুজোয়। পরের তিন বছর লালগড়ে দুর্গাপুজো হয়েছে। ‘রাবণ পোড়া’ হয়নি। রাবণ পোড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে যে বিরাট মেলা বসে, তারও অনুমতি এ বার দেওয়া হয়েছে। এক দিনের ওই মেলায় এলাকার প্রায় পনেরো বিশ হাজার মানুষ আসেন। সিঁদুর খেলার পরে দশমীর সন্ধ্যায় দুর্গা প্রতিমাকে মণ্ডপ থেকে বার করে এলাকায় পরিক্রমা করানোর পরে স্থানীয় মাঠে নিয়ে যাওয়া হবে। তার পরে দুর্গতিনাশিনীর সামনেই হবে ‘রাবণ পোড়া’।

প্রথম বার গ্রামে পা রাখবে দুগ্গা, দীর্ঘ দিনের বাসনা পূরণ
ঘুম চোখ কচলাতে কচলাতেই ছোটরা ছুটছে মণ্ডপের বাঁশ বাঁধা দেখতে। কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে বড়রাও মণ্ডপের সামনে খানিক ক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছেন। পুকুরঘাটে গ্রামের মেয়ে-বউরা পুজোর দিন ক্ষণ নিয়ে আলোচনায় মশগুল। এই প্রথম গ্রামে পুজো হচ্ছে যে! ওঁদের কত দিনের ইচ্ছে, এ বার সত্যি হতে চলেছে! বরাবর বহু দূরের গ্রাম থেকে ভেসে আসা ঢাক ও মাইকের শব্দ শুনে পুজোর দিন কেটেছে সারেঙ্গার পানচুড়, গুনিয়াদা, বেলাটিকরি ও বাঁশকোপা গ্রামের বাসিন্দাদের। কখনও সখনও বড়দের হাত ধরে ছোটদের সেই সব পুজো মণ্ডপ ঘুরে আসার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও বাড়ির মেয়ে বউরা দিনের বেলায় পুষ্পাঞ্জলি বা রাতে সন্ধি ক্ষণের পুজো দিতে যেতে পারেননি। আফশোস ছিল। এ বার তাই চার গ্রামের মাথারা এক হয়ে নিজেরাই পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চারটি গ্রামের নামে পুজো কমিটির নাম ঠিক করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি চাঁদা তোলার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে পুরোদমে। ঠিক হয়েছে, পানচুড় স্কুল মাঠে পুজো হবে। সেখানে এখন মণ্ডপ তৈরির কাজ চলছে। ষষ্ঠীর দিন থেকেই মণ্ডপ চত্বরে আদিবাসী নাচ, গান থেকে কীর্তন সবই হবে। কংসাবতী নদী লাগোয়া শাল-মহুয়ার জঙ্গল ঘেরা ওই চারটি গ্রামে ২২টি পাড়ায় প্রায় ৭০০ পরিবারের হাজার চারেক মানুষের বাস। গ্রামের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা। বিদ্যুৎও রয়েছে। গ্রামে শুধু দুর্গাপুজো ছিল না। এ বার সে বাসনা পূর্ণ হল।

রেণুকার ঘরে সংসার পেতেছেন ‘দশভুজা’
সীমান্তে সংসার পেতেছেন স্বয়ং দশভুজা। মোট চারটে ঘরের মধ্যে ছেলেমেয়েকে নিয়ে জগজ্জননীই দখল করে রয়েছেন তিনটে ঘর! বারান্দা, উঠোনের অস্থায়ী ঘরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কার্তিক, গণেশরা। রং তুলি হাতে জগজ্জননীর সংসার থেকে একচিলতে উঠোনে দাঁড়িয়ে বছর পঞ্চাশের রেণুকা পাল। এটা আপনার বাড়ি না মা দুগ্গার? সস্তা সুতির কাপড়ে ঘাম মুছতে মুছতে হেসে রেণুকাদেবী বলেন, “এটা তো মায়েরই বাড়ি। উনি রয়েছেন বলেই তো আমরা দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে রয়েছি।” মুর্শিদাবাদ মুরুটিয়া থানার সীমান্তঘেঁষা গ্রাম বারুইপাড়া গ্রামে ঢুকে রাস্তার পাশেই বাড়ি রেণুকাদেবীর। বাড়িতে লোক বলতে তিনি আর তাঁর অসুস্থ স্বামী মনোজ পাল। প্রতিমা তৈরির কাজে এলাকায় মনোজবাবুর বেশ নামডাকও রয়েছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে শরীর আর সঙ্গ দিচ্ছে না। অবস্থা এমনই দাঁড়াল যে, প্রতিমা তৈরি তো দূরের কথা, শারীরিক দুর্বলতার কারণে কথা বলতে গিয়েই হাঁফিয়ে উঠছিলেন। পাল পরিবারে এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। মুশকিল আসান করতে এগিয়ে এলেন রেণুকাদেবীই। স্বামীকে ভরসা দিলেন, “আমিই বানাব প্রতিমা। তুমি শুধু বসে থেকে আমার ভুল ভ্রান্তিগুলো ধরে দিও।” এটা যে শুধু কথার কথা নয়, সেটা গত কয়েক বছরে প্রমাণও করে দিয়েছেন রেণুকাদেবী। শুধু এই বছরেই তিনি একাই বানিয়েছেন আটটি দুর্গা ঠাকুর।

ভূমিপুত্রদের হাত ধরে সম্মান রক্ষার চ্যালেঞ্জ অসমে
কথায় আছে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। যবে থেকে থিম নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে সেই সময় থেকেই স্থানীয় শিল্পীদের কদর গিয়েছে কমে। কিন্তু এ বছর টোকোবাড়ির পুজোয় ভূমিপুত্ররাই সর্বেসর্বা। সরকারি আর্ট কলেজের ছাত্রীছাত্রীরা মিলে মহাবলীপুরমের মন্দির এনে বসাচ্ছেন ব্রহ্মপুত্র নগরীতে। পুজোর চেনা ছক ভাঙতে পরিকল্পনা করা হয়েছে তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরম বা মামল্লাপুরমের মহিষমর্দিনী গুহামন্দিরের আদলে মণ্ডপ গড়া হবে। প্রায় ৩২ ফুট উঁচু প্যান্ডেল। পাথরের খোদাইয়ের কাজ প্লাস্টার অব প্যারিসের মণ্ডে ফুটিয়ে তোলা হবে। ওই পাথর খোদাইয়ের জন্যই তো বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র মামল্লাপুরমের খ্যাতি। কোমর কষে মণ্ডপ বানাচ্ছেন দায়িত্বে থাকা ৮ জন ছাত্র। অবশ্য তাঁদের পরিকল্পনামতো বাঁশ, কাঠ, কাপড়, প্লাস্টার সামলাতে কয়েকজন স্থানীয় কর্মীও হাত লাগিয়েছেন সেখানে। আপাতত, অবিকল প্লাস্টারে খোদাই ও প্রস্তরের আদল ফুটিয়ে তোলাই তাঁদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও কয়েকটি মূর্তি বানানো হবে মণ্ডপ তৈরির পরে।

স্বপ্ন দেখেই দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা, জনপদেরও
একচালায় চামুণ্ডা মূর্তি। দুর্গাপুজোর চার দিন এই চামুণ্ডা মূর্তির আরাধনায় মেতে ওঠে হাওড়ার জয়পুরের অমরাগড়ির মানুষজন। পুজোর উদ্যোক্তা অমরাগড়ি গ্রামের রায় পরিবার। ২৯৩ বছরের এই পুজোর আনন্দ পারিবারিক গণ্ডির পরিসর ছাড়িয়ে প্রসারিত হয় সারা গ্রামে। পরিবারের পূর্বপুরুষ শান্তি রায় ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসা সূত্রেই বহু দেশে ভ্রমণ করতেন। বাণিজ্যের কারণে শান্তিবাবু এক দিন অমরাগড়ি গ্রামে দামোদরের তীরে রাত্রিযাপনের জন্য নৌকা বাঁধেন। ওই রাতে শান্তিবাবুকে মা গজলক্ষ্মীদেবী স্বপ্নাদেশ দেন, “এই গ্রামে আমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা কর।” স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরে তিনি এই গ্রামে গজলক্ষ্মীমাতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে স্থায়ী ভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। গ্রামটি ছিল কার্যত জনমানবশূন্য। শান্তিবাবু বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা সম্প্রদায়ের মানুষজনকে আমন্ত্রণ করে এনে জনবসতি গড়ে তোলেন। নির্জন এই জায়গা ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি জনবহুল বর্ধিষ্ণু গ্রামে। গ্রামের মানুষের কথা ভেবেই রায় পরিবার গজলক্ষ্মীমাতা ছাড়াও চালু করেন বিভিন্ন পুজো ও উৎসব। তার মধ্যে রয়েছে রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী উৎসব, রাসযাত্রা, চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ উৎসব, ঝাঁপ ও গাজন, শিবরাত্রি পুজো, চাঁচড় ও দোল এবং দুর্গাপুজো। পরবর্তী কালে দুর্গাপুজোই জাঁকজমক এবং পরিসরের দিক দিয়ে সেরা হয়ে ওঠে।

স্বদেশিদের রক্ষা করতেই শুরু বাঙালি আখড়ার পুজো
পটনায় বাঙালির সংখ্যা কমে গেলেও বাঙালি আখড়া কিন্তু এখনও সংস্কৃতি আর পুজোকে নিয়েই বেঁচে আছে। দুর্গা, কালী, বাসন্তী, শিব এবং গণেশের পুজো নিয়ে দিব্যি মেতে আছে এখানকার বাঙালি সমাজ। ইস্ট ইন্ডিয়া শাসনের সময়েই পটনা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাঙালিরা ঘাঁটি গেড়েছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে সংগঠনের প্রয়োজন ছিল তা গড়ে উঠেছিল এই পটনাতেও। স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াইয়ে সারা বাংলা জুড়ে যখন লড়াই শুরু হয়, তখন এই পটনাতেও তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। সেই লক্ষ্যেই ১৮৭৪ সালে সুরোদ্যান অ্যাথলেটিকস ক্লাব তৈরি হয়েছিল। যেখানে শরীর চর্চা চলত নিয়মিত। ক্রমশ এই সুরোদ্যানই লোকমুখে বাঙালি আখড়া নামে পরিচিত হয়। এর পরে ইংরেজের চোখে ধুলো দিতে ১৮৯৩ সালে শুরু হয় দুর্গা পুজো। কারণ, সাধারণ ভাবে ইংরেজরা ধর্মীয় কোনও স্থানে চট করে হানা দিত না। আর সেই সুযোগে, পুজোর পিছনে আসলে থাকত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের কৌশল রচনা। স্বাধীনতার পরে এই আখড়ার প্রয়োজন কমে আসে। পুজো কিন্তু বন্ধ হয়নি। বরং তা বেড়েছে। এবার ১২০ বছরে পড়ল বাঙালি আখড়ার পুজো। এত দিনের দুর্গাপুজোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গত বছর উদ্বোধন হয়েছে দুর্গা মন্দিরের। সেখানে আছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। দুর্গাপুজোয় এই বাঙালি আখড়া হয়ে ওঠে বাঙালিদের মেলবন্ধনের জায়গা।

সিপাহীর তলোয়ারকেই দেবী রূপে বন্দনা
প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে রায়গঞ্জের নিশীথ সরণীর রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো এ বার ১৫৫ বছরে পড়বে। সিপাহী বিদ্রোহের পরের বছর ওই পুজোর সূচনা। সেই থেকে বংশ পরম্পরায় রীতি রক্ষা করে চলছে আয়োজন। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় দেশীয় সিপাহীদের অনেকে রায়চৌধুরী বাড়িতে আত্মগোপন করে। ফিরে যাওয়ার সময় তাঁরা একটি তলোয়ার ফেলে যায়। পরে পরিবারের এক সদস্য স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেই তলোয়ারকে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে একটি প্রতিমা তৈরি করে বাসিন্দাদের মঙ্গলকামনায় পুজোর ব্যবস্থাও করেন। সেটা ছিল ১৮৫৮ সাল। সেই থেকে একই কাঠামোতে প্রতিমা তৈরি করে পুজোর আয়োজন চলছে। পুরোহিত থেকে ঢাকি প্রত্যেকে বংশ পরম্পরায় অংশগ্রহণ করছেন। মহালয়ার পর দিন থেকে পুজো শুরু হয় এখানে। ওই দিন কুলিক নদীতে কলা বউ স্নান করিয়ে মণ্ডপে মঙ্গল ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথমা থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত শুকনো খাবার দিয়ে দেবীকে ভোগ দেওয়া হয়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত থাকে অন্ন ভোগের ব্যবস্থা। প্রাচীনকালে ওই পুজোয় নবমীতে মহিষ বলি দেওয়া হত। এখন সেটা বন্ধ আছে। প্রাচীন প্রথা মেনে দশমীর পুজোর শেষে পুরোহিতরা মঙ্গল ঘট কুলিক নদীতে ভাসিয়ে দেন। বিকেলে পরিবারের সদস্যরা পুঁটিমাছ ও দই দেখে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে কাঠামো ফিরিয়ে আনেন।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে দেবীকে বিদায় জানান
চাঁচল থেকে এক কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুর চাঁচল রাজবাড়ির পুজো বর্তমানে চণ্ডীমণ্ডপের পুজো নামে বেশি পরিচিত। জাঁকজমক বা আড়ম্বরের বালাই নেই। রয়েছে ইতিহাসের সোঁদা গন্ধ। ঐতিহ্য ধরে রাখার আবেগ, নিষ্ঠা, ভক্তির এই পুজোয় কয়েকটা দিন এলাকার বাসিন্দারা ভিড় করেন হারানো দিনের খোঁজে। রাজবাড়ির উদ্যোগে পুজো শুরু হয়েছিল হরিশ্চন্দ্রপুরের সেকসাতন গ্রামে। পরে তা পাহাড়পুরে স্থানান্তর হয়। দেবী এখানে চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী। চণ্ডীমণ্ডপের উল্টো দিকে রয়েছে সতীঘাট। রাজ পরিবারের এক মহিলা সেখানে স্বামীর চিতায় মৃত্যুবরণ করেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে পূর্বপুরুষরা সতীঘাট থেকে অষ্টধাতুর তৈরি দেবী প্রতিমা উদ্ধার করেন। রাজবাড়ি লাগোয়া ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রতিমা হারিয়ে যায়। পরে একই আদলে প্রতিমা তৈরি করা হয়। প্রথা মেনে সপ্তমীর ভোরে ঠাকুরবাড়ি থেকে ওই প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়পুরে। শোভাযাত্রা করে ধাতব প্রতিমা এনে বসানো হয় মাটির প্রতিমার পাশে। মহাঅষ্টমীতে কুমারী পুজো পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপের অন্যতম আকর্ষণ। বিসর্জনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে দেবীকে বিদায় জানান।

বিষ্ণুপুরে গর্জাল কামান, এলেন মহাকালী
রাজবাড়ির উল্টো দিকে গোপালসায়র, সেখানে নবপত্রিকার স্নানপর্ব শেষ হতেই প্রথমে গর্জে উঠল তিনটি কামান। মৃন্ময়ী মন্দিরে পটদুর্গা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আরও তিনটি, সবশেষে দুপুরে ভোগপর্বের পরে আরও তিনটি কামানের তোপ। গর্জাল মোট ন’টি কামান। ঢাকে কাঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১১ দিন আগেই বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজো। যার সূত্র ধরে এক সময় মল্ল রাজাদের রাজধানী বিষ্ণুপুর জেনে গেল, রাজবাড়ির পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। ৩০৩ মল্লাব্দে (ইংরেজির ৯৯৭ খৃস্টাব্দে) এই পুজোর প্রচলন হয়। রাজপুরোহিত নিরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “তিন পটেশ্বরী (বড়ঠাকরুণ, মেজঠাকরুণ, ছোটঠাকরুণ) মূল মৃন্ময়ী মূর্তির বাঁ-দিকে পুজো পান। শুরুতেই এলেন বড়ঠাকরুণ (মহাকালী)। মান চতুর্থীর দিন আসবেন মেজঠাকরুণ (মহাসরস্বতী) এবং মহাসপ্তমীর দিন সকালে বসবেন ছোটঠাকরুণ (মহালক্ষ্মী)। তিনজনই পটদুর্গা। অষ্টমীর সন্ধি ক্ষণ ঘোষণা হবে বড় কামানের গর্জনে। রাজা নেই, নেই রাজত্বও। তবুও দুর্গা পুজোর এই প্রথা রয়ে গিয়েছে বিষ্ণুপুর ছাড়িয়ে বাঁকুড়া জেলার নানা পুজো মণ্ডপে।

সন্তানরা না, দুর্গার সঙ্গে পুজো পান শিব
যেটুকু মাটির কাজ হয়েছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, ষাঁড়ের পিঠে বসে রয়েছেন শিব ও দুর্গা। পাশে শিবের দুই অনুচর নন্দী এবং ভৃঙ্গী। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, অসুর বা তাঁদের বাহনরা সঙ্গে কেউ নেই। তবে এটি কোনও থিম পুজো নয়। বীরভূমের রাজনগরের তাঁতিপাড়া গ্রামের দাস পরিবারের পুজো। বহু বছর ধরে এ ভাবেই শিব-দুর্গার পুজো হয়ে আসছে। গ্রামে ওই মন্দিরটিও শিব-দুর্গা মন্দির নামে পরিচিত। কিন্তু কত বছর ধরে বা ঠিক কী কারণে এই পুজো হচ্ছে তা খুব একটা স্পষ্ট করতে পারেননি বর্তমানে ওই পুজোর দায়িত্বে থাকা শরিকেরা। তবে তাঁরা জানাচ্ছেন, বংশ পরম্পরায় তাঁরা শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো চালালেও এই পুজো শুরু করেছিলেন গ্রামের এক বৃদ্ধা। বহু বছর আগে ‘কোলে বুড়ি’ নামে এক বৃদ্ধা নবদ্বীপ বেড়াতে গিয়ে এই আদলের মূর্তি দেখে এসে গ্রামে শিব-দুর্গা পুজোর প্রচলন করেছিলেন। তবে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, অসুর বা তাঁদের বাহনরা দুর্গার সঙ্গে না থাকলেও অন্য দুর্গাপুজোর সঙ্গে ওই পুজোর রীতিতে কোনও তফাৎ নেই।

গুহার ফাটল গলে পালাচ্ছে অসুর
কোথাও অসুর পালিয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের ফাটল গলে। দেবী ত্রিনয়ন মেলছেন। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে ক্রোধ। অন্যত্র সপরিবার দেবীর মূর্তিতে পদতলে অসুরকেও স্তব করতে দেখা যায়। এখানে কিন্তু সে পলাতক। এমনই অভিনব ‘থিম’ নিয়ে এ বার হাজির হচ্ছে বড়নীলপুরের চৌরঙ্গী ক্লাবের পূজো। এই পুজো আসলে চার বন্ধুর মস্তিষ্কপ্রসূত। থিমের জনক তাঁরাই। কিন্তু তাঁরা কিছুতেই সামনে আসতে চান না। চারমূর্তি বিকাশ দাস, স্বরূপ দাস, রাজু রায় ও অর্পূব নন্দী এই মণ্ডপসজ্জায় জান লড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ মূর্তি নির্মাণ, কেউ প্রতিমার সজ্জা, কেউ মণ্ডপের ভিতর-বাইরের সাজ নিয়ে ভয়ঙ্কর ব্যস্ত। মণ্ডপ জুড়ে গড়ে উঠেছে একটি পর্বত, তাতে রয়েছে গুহা। গুহার মধ্যে দেবী অসুর নিধনে মত্ত। সেই গুহারই ফাটল ভেদ করে পালিয়ে যাচ্ছে অসুর। গুহার পরিবেশ গা ছমছমে। নানা জায়গায় তৈরি হচ্ছে বন। সেই বনের মধ্যে রয়েছে শ্যাওলাও। উড়ছে চামচিকে। সেই পরিবেশেই ভয়াল উপস্থিতি দেবীর। তাঁর গায়ের রং তামাটে। হাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিনি অসুর মোকাবিলায় প্রস্তুত।

তিস্তাপাড়ের বাণিজ্য বন্দরে উমার আরাধনা
ময়নাগুড়ির তিস্তা পাড়ের সাবেক জোরপাকড়ি হারিয়েছে আর্থিক কৌলিন্য। সাধ ও সাধ্যের টানাপোড়েনে দোদুল্যমান জীবন। তারই মধ্যে চলছে দেবী বরণের প্রস্তুতি। ওই প্রাচীন জনপদে দেবী আরাধনার সূত্রপাত কবে হয়েছিল সেটা জানার উপায় নেই। তবে বর্তমান পুজো আয়োজকদের কয়েকজনের দাবি, ১৯৩৫ সালে এখানে প্রথম দেবী আরাধনার আয়োজন হয়। ওই সময় জোরপাকড়ি অবিভক্ত বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। ভুটান-সহ বিভিন্ন দেশের বণিকরা এখানে নানা সামগ্রী নিয়ে আসতেন। স্থানীয় জোতদার ও বিদ্বজ্জনেরা সেখানে পুজোর আয়োজন করেন সমাজের মঙ্গলের আশায়। ধন সম্পদে সমৃদ্ধ বন্দরের পুজোয় জাঁকজমকের অভাব ছিল না। উমার বাপের বাড়ি তখন ধন সম্পদে সমৃদ্ধ। কয়েক বছরের মধ্যে দেবী বরণের ওই উৎসব তিস্তা পাড়ের উৎসবে পরিণত হয়।

পুজোর কলকাতাজোড়া ফিরিস্তি

বর্তমানের গণ্ডি পেরিয়ে অতীতে ফিরে যাওয়ার ভাবনাই এ বছর হাতিয়ার মলপল্লি সর্বজনীন পুজোকমিটির। তাঁদের মণ্ডপ ফিরিয়ে আনবে এক টুকরো পুরনো কলকাতাকে। দেখা মিলবে রানার, ঝাঁকা মাথায় ফেরিওয়ালা আর টোলের পণ্ডিতের। টপ্পার সুরে আর ঘোড়ায় টানা ট্রামের ঘণ্টার শব্দে দর্শনার্থীরা নিমেষে পৌঁছে যাবেন পুরনো কলকাতার অলিগলিতে। সাবেক কলকাতার স্থাপত্যরীতি মাথায় রেখেই তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। প্রতিমার সাজেও থাকবে মানানসই সাবেকিয়ানা। এ ছাড়াও টুকরো ছবির কোলাজে রূপ পাবে এ শহরের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি।


প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয় মানুষের জীবন। শৈশবের রেশ কাটে কৈশোরের হাত ধরে। আবার কৈশোরও পথ চলতে চলতে এক দিন মিশে যায় যৌবনের সঙ্গে। শেষে অনিবার্য ভাবে আসে বার্ধক্য। তার পরে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া আত্মার হয় নবজন্ম। জীবনের এই চক্র চলতেই থাকে নিরন্তর। এই ভাবনাকেই থিম হিসেবে বেছে নিয়ে মণ্ডপ সাজাচ্ছেন অজয়নগর সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। এক উদ্যোক্তা জানান, বর্ধমান থেকে আনা কাঠের পুতুল আর খড়ের ব্যবহারে ফুটে উঠবে সমগ্র থিম।

দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘ পুজোকমিটির ভাবনা রূপ পাবে পাঁচটি শব্দকে ঘিরে রং, উৎসব, দুর্গা, সৃষ্টি, মিলন। এক উদ্যোক্তার কথায়, উৎসব মানেই রঙিন। আর নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য সবথেকে বড় সুযোগ মেলে দুর্গাপুজোতেই। তাই এ বছরের দুর্গোৎসব তথা মিলন উৎসবে দর্শনার্থীদের নতুন ভাবনায় মুগ্ধ করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর।

পুজোর আনন্দের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দকে মিশিয়ে দিতেই পূর্ব কলিকাতা ছাত্র সমিতির থিম নাগাল্যান্ড। মণ্ডপ সেজে উঠবে নাগাল্যান্ডের পরিবেশকে মাথায় রেখে। রঙের খেলায় ফুটে উঠবে নাগা কারুকার্য। মণ্ডপসজ্জায় শোভা পাবে নাগা অলঙ্কার।

পূর্ব কলকাতারই আর এক পুজো, বেলেঘাটা প্রগতি সংসদ দশর্নার্থীদের জন্য মণ্ডপ সাজাচ্ছেন দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের স্থাপত্যরীতিকে মাথায় রেখে। রং ও কাপড়ের মিশেলে পূর্ণতা পাবে কাল্পনিক এই মন্দির। প্রতিমার সাজেও দক্ষিণের স্পর্শ। পুরাণে আছে, মহিষাসুর বধের জন্য দেবী যখন রণসাজে সজ্জিত হন তখন দেবতারা তাঁকে সাজিয়েছিলেন নিজেদের অস্ত্র ও অলংকারে। সে দিন দেবী সেজেছিলেন রুদ্রাক্ষের গয়নায়। সেই থেকে অশুভের বিনাশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রুদ্রাক্ষ। এই ভাবনা মাথায় রেখেই বিবেকানন্দ সঙ্ঘ নিজেদের মণ্ডপ সাজাচ্ছে রুদ্রাক্ষ দিয়ে। মণ্ডপসজ্জায় প্রায় পঁচিশ হাজার রুদ্রাক্ষ ব্যবহার হচ্ছে। দেবীপক্ষ আসন্ন। তাই কুমোরটুলিতে চলছে শেষ মুহূর্তের তুলির টান। মণ্ডপে শিল্পীদের কর্মব্যস্ততাও তুঙ্গে। অপেক্ষা এখন শুধু উমার পিতৃগৃহে পা রাখার।

‘বড়িশা তরুণ তীর্থ’-এর উদ্যোক্তারা। মণ্ডপ চত্বরে তৈরি হচ্ছে মেলার পরিবেশ। সারা বছর যত ভেদাভেদই থাকুক, উৎসবের ক’টা দিন সব ভুলে সকলকে একসঙ্গে আনন্দে মাততে আহ্বান জানাচ্ছে এই পুজো। নানা রং, বিভিন্ন ছন্দ মিলে যেখানে তৈরি হবে মেলার পরিবেশ। প্রাত্যহিক জীবনের ঘূর্ণাবর্তের ছন্দের প্রতীক হিসেবে থাকছে ‘নাগরদোলা’। কারণ উদ্যোক্তারা মনে করেন, মেলা-প্রাঙ্গণ জমজমাট করে তোলে নাগরদোলা। তেমনই আবার রোজের জীবনে ঘুরে ফিরে আসা সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিল রয়েছে নাগরদোলার পাকের। এমনই নানা ভাবনার বিকাশ ঘটছে বেহালা চত্বরের বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে। কোথাও থিমে উঠে আসছে লোকজীবন, শিল্পের উদ্যাপন তো কোথাও মণ্ডপ ভাবনায় প্রাধান্য পাচ্ছে বিভিন্ন পুরাণ-কথা।

যেমন পুরাণকল্পে সৃষ্টির কাহিনি এ বার বেহালা ব্যানার্জিপাড়ার ‘নস্করপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসব’-এর থিম। শিব ও শক্তির যোগাযোগ যে ধরে রাখে গোটা বিশ্বকে, সে বার্তাই উৎসবের কলকাতাকে দিতে চাইছেন এখানকার উদ্যোক্তারা। প্লাস্টিকের বোতল কেটে তা দিয়ে ফুল বানিয়ে সাজছে মণ্ডপ। ভিতরে প্লাইউডে তৈরি শিবের জটা। মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহার হচ্ছে বেলের মালা, অভ্র, পাহাড়ি ঘাসও।

‘বেহালা ক্লাব’-এও এই বছরের পুজোর ভাবনায় থাকছে শক্তির আরাধনা। পুজোর উদ্যোক্তারা জানান, অসুর দমনের পাশাপাশি দেবী দুর্গার শক্তিতে নির্মূল হয়েছে চারপাশের অন্ধকার। পৃথিবীতে আলোর উৎসও তাই এই দেবী। এ বছরে মণ্ডপের বিভিন্ন অংশ সে ভাবনাকেই ফুটিয়ে তুলছে। থাকছে রকমারি রং ও আলোর ব্যবহার।

এ ভাবনাকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ‘নন্দনা যুব সঙ্ঘ’-এর মণ্ডপ। এ বার তাদের থিম ‘নৈবেদ্য’। পুজোর নানা উপকরণের সঙ্গে হিংসা, গ্লানি, ক্ষোভ, দুঃখও দশভূজাধারিণী পরম শক্তির পায়ে নৈবেদ্য রূপে সমর্পণের ভাবনা ছড়াতে চাইছেন উদ্যোক্তারা। ঘট, গ্লাস, ঘণ্টা দিয়ে তৈরি মোড়ার আকারের নাটমন্দিরে বসবেন সাবেক সাজের প্রতিমা। মণ্ডপ থেকে প্রতিমার সাজ সর্বত্র ব্যবহার হবে পিতল ও তামার রং।

‘চণ্ডীতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’ আবার দূষণমুক্ত গ্রাম-বাংলার পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে নিজেদের মণ্ডপ চত্বরে। মণ্ডপ গড়া হচ্ছে বাঁশ, পাতা, মাটির মতো পরিবেশবান্ধব সামগ্রী দিয়ে। সঙ্গে থাকছে রঙের বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার। ইট, কাঠ, কংক্রিটের জঙ্গলে এই শরতে একটু ‘অন্য রকম’ ছোঁয়া দিতেই এমন থিম বাছাই করেছেন, বলে জানালেন উদ্যোক্তারা। মণ্ডপ জুড়ে থাকবে গ্রাম-বাংলার লোকশিল্পীদের হস্তশিল্পের নিদর্শন।

শিল্পের উদ্যাপন থাকছে ‘বড়িশা যুবকবৃন্দ’-এর পুজোতেও। তাল পাতার ছাউনি দেওয়া মণ্ডপ সাজছে পুঁতিচিত্র দিয়ে। ভিতরে বসানো হচ্ছে থিমের সঙ্গে মানানসই সাবেক প্রতিমা। নানা সময়ে এই পুঁতি-শিল্প বিভিন্ন ধর্ম এবং ভারতবর্ষের নানা প্রদেশের মানুষের লোকজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাই এই থিমের মাধ্যমেও উদ্যোক্তারা নানা ধর্ম ও ভাষার মিলনের খোঁজ করছেন উৎসবের শহরে।

মানিকতলার সিমলা রোডের লালাবাগান নবাঙ্কুর। তাদের মণ্ডপে এ বার উঠে আসবে গোটা একটা শরৎকাল। এমনিতেই শহরে স্বাভাবিক নিয়মে দেখা পাওয়া যায় না বর্ষার। এর পরে হঠাৎ করে হয়তো এসে যাবে শীত। তা হলে কী ঋতু-মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে শরৎকাল? কোথায়ই বা দেখা মিলবে শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ বা কাশফুলের? এ সব কিছুই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে গেলে আসতে হবে লালাবাগান নবাঙ্কুরে। পুজোর কর্তারা জানাচ্ছেন, প্যারাসুটের কাপড় দিয়ে বানানো হচ্ছে শরতের মেঘ। মণ্ডপে বিভিন্ন ব্রাশের কারুকাজে ফুটে উঠবে কাশফুল, শিউলিফুল।

এই কলকাতা শহরেই এককালে রাস্তায় দেখা যেত পাল্কি, গরুর গাড়ি। কয়েক বছর আগে পর্যন্তও শহর দাপিয়ে বেড়াত দোতলা বাস। আজকের গতি-সর্বস্ব জীবনে এ সব যানবাহনের দেখাই পাওয়া যায় না। তার বদলে এখন ঝাঁ-চকচকে বিদেশি গাড়ি। ভূগর্ভে মেট্রো। যানবাহনের এই বিবর্তনই এ বার পাথুরিয়াঘাটা পাঁচের পল্লি সর্বজনীনের মূল ভাবনা। এই ভাবনার নাম ‘কালের যাত্রাপথ’। সংগঠকদের দাবি, বাড়ির ফেলে দেওয়া নানা জিনিস যেমন পেন্সিল কাটার কল, পুরনো পেনসিল, কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল দিয়ে সেজে উঠবে যাত্রাপথ। প্রতিমা, আলো, মণ্ডপসজ্জা সব কিছুর মিশেলে ফুটে উঠবে বিবর্তনের মুখ।

দক্ষিণ ভারতের মন্দির তো কলকাতার পুজোমণ্ডপে বহু বারই হয়েছে। কিন্তু জগৎ মুখার্জি পার্ক এক নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনীর সংগঠকদের দাবি, তাঁদের তৈরি দক্ষিণ ভারতের মন্দির এ বার সব দিক থেকেই ব্যতিক্রমী হয়ে উঠবে। মন্দিরের ৪২টি পিলারে থাকবে দেবদেবীর মূর্তি। মন্দিরের ভিতরের পরিবেশ তৈরি হবে দক্ষিণ ভারতীয় ঘরানায়। আদতে বালির তৈরি মন্দিরটি দেখে মনে হবে যেন পাথর কেটে বানানো।

উত্তর কলকাতার হালসীবাগান দুর্গোৎসব কমিটির পুজোমণ্ডপে গেলে পৌঁছে যাওয়া যাবে কর্নাটকের চান্নাপাটনা গ্রামে। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় খেলনার গ্রাম। ভেষজ রং ব্যবহার করে গ্রামে তৈরি হয় কাঠের পুতুল, চিরুনি, রংবেরঙের চুড়ি। এমন নানা ধরনের খেলনা দিয়ে হবে মণ্ডপসজ্জা। পুরো পুজোয় দেখা যাবে চান্নাপাটনা গ্রামের লোকশিল্প।

সাড়ে আটশো বছরেরও বেশি সময় ধরে পিপলির শিল্পীরা বুনে চলেছেন রংবেরঙের অসাধারণ সব অ্যাপ্লিক-এর শিল্পকর্ম। দেশে-বিদেশে সর্বত্রই এই অ্যাপ্লিকের কদর রয়েছে। তবে অনেকেই হয়তো এই অসাধারণ শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত নন। হরি ঘোষ স্ট্রিট সর্বজনীন দুর্গোৎসব দর্শনার্থীদের পরিচয় করাবে এই শিল্পকর্মের নানা কোলাজের সঙ্গে। পুজোমণ্ডপ সেজে উঠবে রঙিন অ্যাপ্লিক ও আলোর মায়ায়।

ভরা বর্ষাতেও এ বার পেটপুরে ইলিশ খেতে না পেরে দুঃখে কাতর বহু বাঙালি। মরসুমে বাজারে ইলিশ যা-ও এসেছিল, তাতে হাত ছোঁয়ানো ছিল দায়। সেই দুঃখেই উল্টোডাঙার ইউনাইটেড ক্লাবের পুজো উদ্যোক্তারা পুজোর থিম হিসেবে তুলে ধরেছেন জলের রুপোলি শস্যকে। তাঁরা জানাচ্ছেন, ভরা মরসুমে ইলিশ না মেলার কারণ জলের দূষণ এবং অপরিণত ইলিশ ধরা। তাই পুজোর থিমে সচেতনতা ছড়াতে চাইছেন তাঁরা। মণ্ডপে থাকছে পরিবেশবান্ধব রং, ফাইবারের তৈরি মাছ ধরার সরঞ্জামও।

শুধু ইলিশই নয়, এ বার উল্টোডাঙা-কাঁকুড়গাছি এলাকায় পুজোকমিটিগুলির থিমের বৈচিত্র্যে বাদ যায়নি কিছুই। ঈশ্বরের রূপ থেকে রুদ্রাক্ষ, ঠাকুর গড়ার মাটি থেকে ধানের মরাই বা বাংলার বাউল। ভিড় টানার লড়াইয়ে একে অন্যকে টেক্কা দিতে এমনই সম্ভার সাজিয়েছে ক্লাবগুলি।

তেলেঙ্গাবাগানে শিল্পী কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত ধাতুর উপরে এঁকে-ঠুকে মণ্ডপ আর ঠাকুর ফুটিয়ে তুলছেন। মণ্ডপ গড়তে লেগেছে প্রায় ২৫ টন লোহা। তামার পাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেবীমূর্তি। এই কাজে তাঁর অগ্রজ চার শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার, রামচাঁদ রায়, বিশ্বম্ভর আচার্য ও লালুপ্রসাদ সাউকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন কৃষ্ণপ্রিয়বাবু। তাঁর কথায়, “এঁদের কাজই আমার প্রেরণা।”

করবাগানের থিম ঈশ্বরের স্বরূপ। যার ক্যাচলাইন বহু প্রচলিত একটি প্রবাদের উপরে ভিত্তি করে, “মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী।” কাঠ, মাটি, প্লাস্টার অফ প্যারিস এবং ফাইবারের সমন্বয়ে শিল্পী কৃশানু পাল গড়ে তুলছেন একটি মন্দির।

করবাগানের ‘প্রতিবেশী’, মুরারিপুকুরের বিধান সঙ্ঘ আবার ঠাকুর গড়ার আদি উপাদান, ‘মাটি’কেই তুলে এনেছে থিম হিসেবে। শিল্পী সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বললেন, “পোড়া মাটির ফুলদানি, ধুনুচি ইত্যাদি দিয়ে সাজছে মণ্ডপ।”

কাঁকুড়গাছির নবোদয় পল্লিমঙ্গল তুলে এনেছে গ্রাম-বাংলার ধানের মরাইকে। মরাইয়ের মতো দেখতে মণ্ডপ সাজানোর হচ্ছে বেল, মেহগনি ফল, বাকলি, সুপুরি দিয়ে। বালির তৈরি নানা দেব-দেবীর মূর্তিও থাকছে সেখানে। ভিতরে মা দুর্গা আঁচলের তলায় রক্ষা করছেন তাঁর সন্তানদের।

উল্টোডাঙার দাসপাড়ার থিম বাংলার বাউল-ফকিরেরা। উদ্যোক্তারা জানান, বাউল-ফকিরেরা হৃদয়ের কথা বলে, মানুষের বেঁচে থাকার কথা বলে। কিন্তু এই লোকসংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই শিল্পী ভোলানাথ কলসী এবং মনজিৎ কলসী কলাগাছের ছাল, তালপাতা, একতারা, ডুগি, খঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে তুলছেন মণ্ডপ। বাংলার বৈষ্ণবী সনাতনী রূপে প্রতিমা গড়ছেন সনাতন রুদ্রপাল।

হাডকো মোড়ের সংগ্রামী এ বার খুঁটির গায়ে রঙিন কাপড় জড়িয়ে সৃষ্টিশীলতাকে তুলে ধরতে চেয়েছে। সঙ্গে থাকছে এলইডি আলোর সজ্জা। ওই এলাকারই পল্লিশ্রীর থিম ফুলের কুঁড়ি। যার পাপড়ি বিকশিত হবে শান্তি-সম্প্রীতির বার্তা হিসেবে।

শোভাবাজার সর্বজনীন। পুরাণে আছে, সমুদ্রমন্থনে যে বিষ উঠেছিল, তা থেকে এক দিকে অসুর, অন্য দিকে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন দেবতা। কিন্তু কী সেই মানুষের পরিচয়? তাঁর বিনাশই বা কখন? এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে যেতে হবে এই পুজোর মণ্ডপে। কারণ, ঠিকুজির মাধ্যমে সেখানে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে মানুষের আত্মপরিচয়ের দিনলিপি।

সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতের মহাকাব্যের সমাদর দেশে-বিদেশে। অশুভকে হারিয়ে শুভ চেতনার বিকাশ বার বার উঠে এসেছে এই সব মহাকাব্যে। সেই জয়গাথার প্রতিফলন আহিরীটোলা সর্বজনীনের পুজোর ভাবনাতেও। কালিদাসের কুমারসম্ভবকে ফিরিয়ে আনবেন তাঁরা। ইতিহাসের পথ ধরে দর্শক পৌঁছে যাবেন স্বর্গলোকে, এমনই দাবি উদ্যোক্তাদের।

বর্তমানের থিম পুজোর রমরমার যুগে হারিয়েই যেতে বসেছে ভিন্ রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামের লোকশিল্প। এমনই একটি লোকশিল্প মধুবনী জেলার দুসার অঞ্চলের গোধনা। মাটির পুতুল, গৃহসজ্জার ড্রাই ফ্লাওয়ার-এর সঙ্গে এই লোকশিল্পের রঙিন প্রকাশ এ বার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট পল্লি সমিতির পুজোমণ্ডপে। তাঁদের বিষয়-ভাবনা ‘আদি অন্ত’। লোকশিল্পের পাশাপাশি থাকবে ভারতীয় সভ্যতার নানা পর্যায়ের বিবরণ। হিন্দু ধর্মের যে প্রধান তিন দেবতা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, তাঁদের মধ্যে থেকে সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সকলের পূজিত হয়ে উঠলেন অনার্য শিব। এই পুজো সন্ধান দেবে না-জানা এমনই অনেক কাহিনির।

মালোপাড়া সর্বজনীনের পুজোয় এ বার অন্য এক ছবি। ‘পুতুল মেলা’। প্রত্যন্ত এক গ্রামের কারিগর কী ভাবে নিপুণ দক্ষতায় তৈরি করেন এমন একটি মনজয়ী জিনিস, এই পুজো তা-ই তুলে ধরবে। মণ্ডপের ভিতরে দেখা যাবে, এক জন বিক্রেতা নিজের হাতে গড়া পুতুল মেলায় ফেরি করে চলেছেন। দেবী দুর্গারও পুতুল-রূপ। জৌলুস বাড়াবে মুখোশের রঙিন সাজ।

দেখতে দেখতে হাটখোলা গোঁসাইপাড়া সর্বজনীন পেরিয়ে এল ৭৪ বছর। দুর্গাপুজোর সাবেকিয়ানা বজায় রাখাতেই এঁদের আনন্দ। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে শিল্পী স্বপন পাল সাবেক সাজে সাজাবেন ত্রিনয়নীকে। তাঁর ভুবনমোহিনী রূপে দূর হবে সব অহংকার, দেখা দেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধা পড়বে জগৎ-সংসার।

শারদোৎসব এখন আর শুধু বাংলার নয়। তার রেশ আজ পৌঁছে গিয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারেও। এই উৎসবে এ বার নতুন মাত্রা যোগ করতে প্রয়াসী বেনিয়াটোলা সর্বজনীন। ত্রিপুরার চাটাই, খড়ের উপরে মাদুরের কাজে সেজে উঠবে তাঁদের মণ্ডপ। মূল প্রবেশপথের দু’পাশে খেটে খাওয়া মানুষের রোজনামচা। সঙ্গে বাড়তি পাওনা সাবেক প্রতিমা।

কলকাতার পুজো-মানচিত্রে বরাবরই স্বতন্ত্র ধারায় হাঁটতে চেয়েছে কুমোরটুলি পার্ক সর্বজনীন। ২০তম বর্ষে শিল্পী দেবাশিস বসু এই পুজোয় মেলাবেন দুই রাজ্যের শিল্প-সংস্কৃতিকে। মণ্ডপে ঢোকার পথে দু’পাশে দেখা যাবে এলইডি আলোর বিচ্ছুরণ। থিমের সঙ্গে মানানসই প্রতিমা।

এখনকার শহুরে জীবন থেকে হারিয়েই গিয়েছে রঙিন প্রজাপতি। প্রজাপতির হরেক রং যেন প্রকৃতির নানা রঙের রূপক। রামমোহন স্মৃতি সঙ্ঘ প্রজাপতির স্বপ্নের মাধ্যমে তুলে আনবে একটুকরো সবুজায়ন। প্রজাপতি যেমন নানা রঙে জগতের শোভা বাড়ায়, তেমন সবুজায়নের মধ্যে দিয়েও নতুন রূপ পাবে প্রকৃতি।



রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা আপনার রান্নাঘর পুরনো সংস্করণ