: গ্রন্থাগার
চৈতন্য লাইব্রেরি
প্রায় ১২৫ বছর আগের কলকাতা। সাধারণ মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তখন যথেষ্টই তৈরি হয়েছে, শিক্ষিত ব্যক্তিরা নিজেদের বাড়িতে গ্রন্থাগার গড়ে তুলছেন, কিন্তু সাধারণ গ্রন্থাগারের সংখ্যা হাতে গোনা, আর সব জায়গায় সবার প্রবেশাধিকারও নেই। জাতীয় গ্রন্থাগার তখনও দূর অস্ত্, পাবলিক লাইব্রেরি বলতে যা বোঝায়, তা ছিল সাহেবপাড়ায় মেটকাফ হলে। কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি নামে পরিচিত এই গ্রন্থাগার লর্ড মেটকাফের অনুরাগীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৬-এর মার্চ মাসে। কিন্তু এ গ্রন্থাগার ছিল গণ্যমান্য বিশিষ্টজনের জন্য, সাধারণের জায়গা কোথায় সেখানে! আবার পার্ক স্ট্রিটে এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগার তখন একশো বছর পেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেখানেও তো সাহেবদেরই প্রতাপ, বাঙালিদের মধ্যে বড়জোর উচ্চশিক্ষিত বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীরাই তার সদস্য ছিলেন। অথচ নানা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড, পাশাপাশি সাধারণের ক্রমবর্ধমান জ্ঞানস্পৃহা, সব মিলিয়ে বাঙালির আগ্রহে, বাঙালির উদ্যোগে বিভিন্ন পাড়ায় ছোট ছোট লাইব্রেরি এই সময় থেকেই গড়ে উঠতে থাকে। মধ্য কলকাতার তালতলা অঞ্চলে ১৮৮২-র ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় তালতলা পাবলিক লাইব্রেরি। উনিশ শতকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র উত্তর কলকাতায় ইতিমধ্যে শুধু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরি’ (১৮৮৩-র ১৬ জুন)। রাজা রাজবল্লভ স্ট্রিটের ভাড়া বাড়ি থেকে ১৯০১-এ ওই একই রাস্তায় নিজস্ব বাড়িতে উঠে যায় লাইব্রেরি। কিন্তু মানুষের আগ্রহ এতটাই বাড়ছিল যে বিডন স্ট্রিটের মানুষ কম্বুলিয়াটোলায় রাজবল্লভ পাড়ায় গিয়ে গ্রন্থাগার ব্যবহারে উৎসাহী ছিলেন না, তাঁরা চাইছিলেন পাড়ার মধ্যেই একটি গ্রন্থাগার গড়ে উঠুক। উৎসাহের কোনও অভাব ছিল না, শুধু অকুলান ছিল অর্থের। গৌরহরি সেন, কুঞ্জবিহারী দত্ত, নিতাইচাঁদ দত্ত, হরলাল শেঠ ও রঙ্গলাল বসাক গড়ে তুললেন চৈতন্য লাইব্রেরি, অর্থ সাহায্য করলেন তাঁদের ধনী প্রতিবেশী গঙ্গানারায়ণ দত্ত। ৮৩ বিডন স্ট্রিটে গঙ্গানারায়ণের বাড়ির একাংশেই প্রথম লাইব্রেরি স্থাপিত হল, ১৮৮৯-এর ৫ ফেব্রুয়ারি (১২৯৫ বঙ্গাব্দের ২৪ মাঘ, মঙ্গলবার)। পাদ্রি রেভারেন্ড অ্যালেক্স টমরিও এই উদ্যোগে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। উত্তরের আরও দু’টি বিখ্যাত লাইব্রেরির পূর্বসূরি চৈতন্য লাইব্রেরি, কারণ অ্যালবার্ট লাইব্রেরি (পরে ভারতী পরিষদ) ১৮৯০-এ, এবং হিরণ লাইব্রেরি ও বয়েজ ওন লাইব্রেরি তৈরি হয় ১৯০৯-এ।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ (১৮৯৩) যেমন অনেক বড় আকারে, বিস্তারিত সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পরিকল্পনা নিয়ে গড়ে উঠেছিল, সাধারণ ভাবে বিভিন্ন পাড়ার এই সব গ্রন্থাগারের তেমন কোনও ‘অ্যাজেন্ডা’ ছিল না। এক দিকে সেখানে ছিল বই ও পত্রপত্রিকা সহজে পড়তে পাওয়ার জন্য নব্যশিক্ষিত যুবসমাজের আগ্রহ, গ্রন্থাগারের মাধ্যমে এলাকায় সংস্কৃতিচর্চার একটি কেন্দ্র গড়ে তোলা, আর গল্প-উপন্যাস পড়ার সাধারণ পারিবারিক উৎসাহ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানগুলির ইতিহাসের সহিত এ যুগের বাঙ্গালা তথা ভারতবর্ষের মানসিক প্রগতির ইতিহাস অন্তরঙ্গভাবে জড়িত হইয়া আছে। এইগুলি একাধারে বাঙ্গালীর মানসিক স্ফূর্তির এবং কর্মের উৎস ও প্রকাশভূমি। এগুলির পূর্বকথা ভুলিলে চলিবে না, যদিও সাধারণ বাঙ্গালী শিক্ষিত জন এগুলির কথা ভুলিতে আরম্ভ করিয়াছে।’ আবার আশাপূর্ণা দেবীর লেখায় পাই, ‘চৈতন্য লাইব্রেরির সঙ্গে আমার বাল্যস্মৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। আমার মা এই লাইব্রেরি থেকে বরাবর বই আনিয়ে পড়তেন। তখনকার দিনে অবশ্য মেয়েদের পক্ষে নিজে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নির্বাচন করে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। ক্যাটালগ থেকে নাম নিয়ে বাড়ির ছেলেদের দিয়ে বই আনিয়ে নেওয়া হত। মায়ের দৌলতে আমরাও চৈতন্য লাইব্রেরির বই-এর পাঠিকা ছিলাম।’ বিশ শতকের গোড়ার দিকের বাঙালি সমাজের চমৎকার ছবি ফুটে ওঠে এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে।

চৈতন্য লাইব্রেরি যেমন স্থানিক গ্রন্থাগারের অভাব পূর্ণ করেছিল, তেমনই হয়ে উঠেছিল একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বস্তুত এর পুরো নাম ছিল চৈতন্য লাইব্রেরি ও বিডন স্কোয়্যার লিটারারি ক্লাব। গৌরহরি সেন সম্পাদক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে সক্রিয় ছিলেন। গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার এক বছর পর থেকেই নিয়মিত দেশবিদেশের মনীষীদের বক্তৃতার ব্যবস্থা করা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অ্যালেক্স টমরি, ভাইসরয়ের কাউন্সিলের সদস্য স্যর আলেকজান্ডার মিলার, ফাদার লাফোঁ, সি ভি রামন প্রমুখও বিভিন্ন সময় বক্তৃতা দিয়েছেন। নিজস্ব সভাঘর না থাকায় শহরের বিভিন্ন সভাকক্ষে এই সব অধিবেশন হত। সদস্য ছাড়াও বহু মানুষ আসতেন, এমনকী সেই সব পঠিত প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হত, সমাজে আলোড়ন হত অনেক সময়েই। যেমন চৈতন্য লাইব্রেরির অধিবেশন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ৩ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দে ওভারটুন হলে ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’ নামে যে প্রবন্ধ পাঠ করেন, তা নিয়ে সমকালীন সংবাদপত্রে রীতিমতো বাদ-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রথমে এটি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, এবং কিছু দিনের মধ্যেই যদুনাথ সরকার লেখাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় ছাপলে বৃহত্তর পাঠকসমাজের দৃষ্টি এটির উপর পড়ে। বক্তৃতাসভা ছাড়া উনিশ শতক থেকেই চৈতন্য লাইব্রেরিতে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত, সেখানে পরীক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন সময় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, চন্দ্রনাথ বসু, আশুতোষ চৌধুরী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রমুখ।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মতোই চৈতন্য লাইব্রেরির সম্পর্ক খুবই ভাল ছিল, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। চৈতন্য লাইব্রেরির অধিবেশনে বহু বার বক্তৃতা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। গৌতম নিয়োগীর ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ও চৈতন্য লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে (সারস্বত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি) চৈতন্য লাইব্রেরির সম্পাদক গৌরহরি সেনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং এই গ্রন্থাগারের উদ্যোগে বহু প্রবন্ধ পাঠের অনুষ্ঠানের কথা আলোচিত হয়েছে। ১৮৯১-এ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘একদিন চৈতন্য লাইব্রেরিতে একজন কাব্যরসসন্দিগ্ধ ব্যক্তি আমায় প্রশ্ন করিয়াছিলেন ‘আচ্ছা মহাশয়, বসন্তকালে, বা জ্যোৎস্নারাত্রে লোকের মনে বিরহের ভাব কেন উদয় হইবে আমি ত কিছু বুঝিতে পারি না।’ প্রবন্ধপাঠের অনুষ্ঠান যে হেতু অন্যত্রই হত, তাই এই মন্তব্য থেকে মনে হয়, শুধু প্রবন্ধ পাঠ নয়, গ্রন্থাগারে সাধারণ ভাবে রবীন্দ্রনাথের যাতায়াত ছিল। তবে এই ১৮৯১-এর ১১ মার্চ জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশনে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন তাঁর য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-র ‘ভূমিকা’। এটি ছিল চৈতন্য লাইব্রেরির ১৮তম সাধারণ সভা। প্রবন্ধ পাঠে সময় লেগেছিল দু’ঘণ্টা, শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবকৃষ্ণ ঘোষ, মহারাজকুমার বিনয়কৃষ্ণ দেববাহাদুর, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, আশুতোষ চৌধুরী, নবগোপাল মিত্র, অ্যালেক্স টমরি প্রমুখ। রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের নেতারা রবীন্দ্রনাথের অনেক মন্তব্য মেনে নিতে পারেননি। আবার একই জায়গায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’। এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে প্রমথ চৌধুরীকে লিখেছেন, ‘চৈতন্য লাইব্রেরির সম্পাদকের অবিশ্রাম উত্তেজনায় এই অসমসাহসিক কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম, নইলে পাব্লিকের কাছে ঘেঁষতে আমার আর বড় ইচ্ছা করে না।’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলা ভাষা প্রবর্তন করা উচিত কি না, এ বিষয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। চৈতন্য লাইব্রেরিও এ নিয়ে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক সভার আয়োজন করেছিল, যেখানে প্রস্তাবের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ ও রজনীকান্ত গুপ্ত, আর বিপক্ষে নগেন্দ্রনাথ ঘোষের বলার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিত সভাটি অবশ্য অনুষ্ঠিত হয়নি।

স্বদেশি আন্দোলনের পর্বে, বিশ শতকের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ ও চৈতন্য লাইব্রেরির যোগসূত্র অক্ষুণ্ণই দেখতে পাই। লাইব্রেরির উৎসাহী সম্পাদকের আগ্রহে ২২ জুলাই ১৯০৪ রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন ‘স্বদেশী সমাজ’। মিনার্ভা রঙ্গমঞ্চে এই সভায় সভাপতিত্ব করেন রমেশচন্দ্র দত্ত। গৌরহরি সেনের মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ সভাপতিকে ধুতি পরে আসতে অনুরোধ করেছিলেন, যদিও রমেশচন্দ্র তা মানেননি। বহু বিশিষ্টজন সভায় ছিলেন, এত ভিড় ছিল যে অনেকেই বক্তৃতা ভাল করে শুনতে পাননি। সভায় গোলমালও হয়েছিল। তাই পরে আবার হ্যারিসন রোডের কার্জন রঙ্গমঞ্চে (৩১ জুলাই) হীরেন্দ্রনাথ দত্তের সভাপতিত্বে রবীন্দ্রনাথ একই প্রবন্ধ পাঠ করেন। টিকিট কাটতে হয়েছিল, ১২০০ টিকিট চার ঘণ্টায় নিঃশেষ হয়ে যায়। এই বিতর্কে চৈতন্য লাইব্রেরি দমে যায়নি, বরং ২৩ ডিসেম্বর ১৯০৫ ই বি হ্যাভেল প্রমুখের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকেও লাইব্রেরির সম্মানিত সদস্য নির্বাচিত করা হয়। এমনকী গৌরহরি একবার জোড়াসাঁকোয় গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গোপালকৃষ্ণ গোখলের ‘প্রাইমারি এডুকেশন বিল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এর ফলে রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধ লেখেন এবং চৈতন্য লাইব্রেরির উদ্যোগেই তা রিপন কলেজে পড়া হয়। এমনকী অমল হোম প্রবন্ধটি ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে পড়ার অনুরোধ করলেও রবীন্দ্রনাথ রাজি হননি।

এ থেকেই বোঝা যায়, শুধু গ্রন্থাগারের পরিপুষ্টি নয়, সমাজের বৌদ্ধিক পুষ্টিতেও চৈতন্য লাইব্রেরি কতটা মনোযোগ দিয়েছিল। এমন নজির খুব বেশি মিলবে না। আজ চৈতন্য লাইব্রেরির সে দিন নেই। দুর্লভ বইপত্রের রক্ষণাবেক্ষণ অর্থাভাবে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। এখনও কয়েকজন মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে কোনও রকমে তা চলছে, তবে কত দিন সেই অস্তিত্ব টিকে থাকবে বলা কঠিন।


—নিজস্ব চিত্র্র
 
 


 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.