ঝুলন্ত বাসে চড়ার মজাই আলাদা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অভিনেত্রী ও নাট্যব্যক্তিত্ব
আমার ছোটবেলা কেটেছে ইলাহাবাদে। কিন্তু মাঝে মধ্যেই কলকাতাতে আসতাম বালিগঞ্জে। সত্যি বলছি, সেই থেকে আমি কলকাতার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। যখনই আসতাম নিয়ম করে ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিকে যেতাম। নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। আবার কখনও যেতাম ধর্মতলায় যমুনা সিনেমার কাছে একটি দোকানে। সেই দোকানে মিউজিক্যাল সিস্টেমের সব সরঞ্জাম পাওয়া যেত। ক্ল্যাসিকাল ওয়েস্টার্ন মিউজিকের নানা রকম সরঞ্জাম কিনে ভাইদের উপহার দিতাম। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে প্রচুর ফুচকা খেতাম। তার পর ট্রাম ধরে সোজা বালিগঞ্জ। সব ট্রামে উঠতাম না। কারণ জানালার ধারে আলাদা সিট না পেলে সেই ট্রাম বাতিল। ময়দানের বুক চিরে ট্রাম যখন ছুটত, মনে হত সবুজের বুক চিরে ফুরফুরে হাওয়ায় আমি কোনও অজানা দেশে পাড়ি দিয়েছি। কী অপূর্ব অনুভূতি। ইলাহাবাদে গিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করতাম আর বলতাম, “আমি বড় হয়ে ঠিক কলকাতাতে চলে যাব।” সব ফেলে এক দিন সত্যিই চলে এসেছিলাম।
একদম পাকাপাকি ভাবে। জীবন যুদ্ধের সেই তো শুরু। চলছি তো চলছিই। এই শহরকে নিয়ে কত ক্ষোভ, মান-অভিমান, হতাশা ও দুঃখ। কিন্তু এখন এই শহর ছেড়ে এক দিনের জন্যেও বাইরে কোথাও ভাল লাগে না। ইদানীং রাস্তাঘাটে এত জ্যাম যে খুব বিরক্ত লাগে। জরুরি কাজে বাধা পড়ে। কলকাতা মনে হয় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো এখন উত্তর কলকাতায় থাকি। এখানকার পরিবেশ একটু অন্য রকমের। সব ভাল। কিন্তু কেউ কেউ মনে হয় বড্ড বেশি পরনিন্দা পরচর্চা করেন। যেটা দক্ষিণ কলকাতার চেয়ে বেশি। আমাকে নিয়েও কম হয়নি। কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি।
নাটকের মহড়ায় বেহালা বাজাচ্ছেন শিল্পী
এখন আমার জগৎ শুধু থিয়েটার। নান্দীকার একটি বড় পরিবার। সবাইকে নিয়ে দারুণ কাটে দিনগুলি। নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা, রিহার্সাল, স্টেজ শো— ব্যস্ততা শুধু ব্যস্ততা। তারই ফাঁকে চলে যাই নিউ মার্কেটে। সেই ছোটবেলা থেকেই নিউ মার্কেট আমাকে নেশার মতো টানে। সামান্য একটি জিনিস কিনতেও এখনও নিউ মার্কেটে যাই। তবে একা। বেশ কিছু ক্ষণ এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করি। দরদাম করি। তার পর কিনি। বেশ মজা লাগে। সঙ্গে কাউকে নিলেই তাড়া দেবে। এত হাঁটাহাঁটিও করবে না। তবে, সিনেমা দেখতে গেলে আমার সঙ্গী হয় আমার মেয়ে, সোহিনি। আমি যেমন সিনেমা দেখতে ভালবাসি, সোহিনিও তাই। মাঝে মধ্যে বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে আমরা দু’জনে সল্টলেকে গিয়ে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরি। কখনও আমরা দু’জনে চলে যাই ক্যামাক স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয়। চাইনিজ খাই। তবে বছরে এক বার পরিবারের সবাই ওখানেই খেতে যাই।
যদি না হেসে ফেলেন, তবে একটা মজার কথা বলছি। জানেন তো, কলকাতার বাদুড়ঝোলা বাসে অন্যদের মতো আমিও ঝুলতাম। কলকাতায় এসে শুধু মনে হত, ওরা যখন ঝুলে ঝুলে যায়, আমিও কেন যাব না? উঠে পড়তাম। পাদানিতে কোনও রকমে পা দিয়ে জানালার রড ধরে তিন চারটি স্টপেজ বেশ চলে যেতাম। বেশি দূর যাওয়া হত না। অন্যরা হৈ হৈ করে আমাকে উপরে তুলে নিত। কেন জানি না, এই শহরের মানুষেরা মেয়েদের ভীষণ সম্মান বা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আর কোনও শহরে এতটা দেখা যায় না। ঝুলন্ত বাসে চড়ার মজাই আলাদা। তাই না?
এখন তো সেই সব স্মৃতি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে নিজের গাড়ি হাঁকিয়ে যেন যন্ত্রের মতো ছুটছি। তবুও কোথাও কোথাও ভিড়ের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তখন হয়তো কেউ কেউ চিনে ফেলে বলে ওঠেন, ‘‘আপনি স্বাতীলেখা নন?” গর্ব হয়, মজাও হয়। আমিও তো এই শহরের মেয়ে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.