দেবব্রত রায় অপু (লেখক বাংলাদেশি, ২০১১ সালে কলকাতার দুর্গাপুজো দেখার অভিজ্ঞতা জানাতেই ধরেছেন কলম)
(অন্ধের হস্তিদর্শনের গল্প শুনেছেন নিশ্চয়ই। প্রথম বার কলকাতার পুজোয় গিয়ে খান পঁচিশেক ঠাকুর দেখে নোট লেখা অনেকটাই সে রকম ব্যাপার। কলকাতার বন্ধুরা এই লেখাকে কী ভাবে নেবেন জানি না, তবে একজন বাংলাদেশি— যে ছোটবেলা থেকে থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় মার্কা প্রতিমা আর তথৈবচ মণ্ডপসজ্জা দেখে অভ্যস্ত, তার কাছে কলকাতার দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখা কুয়োর ব্যাঙের সমুদ্রদর্শনের কাছাকাছি!)
বাংলাদেশের যে জেলা-শহরে আমি বড় হয়েছি, সেখানে সাকুল্যে ত্রিশখানা পুজো হয়। আমার পাড়ার ঠাকুরটি শহরের বিশিষ কয়েকটির একটি। এ নিয়ে আমার গর্বের অন্ত নেই! তবে গত পঁচিশ বছর ধরে দেখে আসছি, আমাদের প্রতিমার রং অফ-হোয়াইট। পঁচিশ বছরে পালমশাইয়ের চেহারায় কিছু বয়সোচিত পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু ঠাকুরের চেহারা, সাজ অপরিবর্তনীয়। ইংরেজিতে বোধহয় একেই বলে ‘কনসিসটেন্সি’! এই করে করেই এঁরা প্রতি বছর প্রথম-দ্বিতীয় হন! আহারে, অভাগা বিচারকবৃন্দ! কী দরকার প্রতি বছর মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখার? কী দরকার একই প্রতিমা প্রতি বার নতুন করে গড়ার? ভাল করে ‘এয়ার টাইট’ প্যাকেটে মুড়ে রেখে পরের বছর পুজোর সময় বের করে ঝেড়েঝুড়ে নিলেই তো হয়!
বলতে পারেন এ হেন কূপমণ্ডূক— আমি, যখন কলকাতার পুজোর মহাসাগরে গিয়ে পড়ব, স্বাভাবিক ভাবেই মুগ্ধতা মাত্রা ছাড়াবেই! কিন্তু আসলে কি তাই? কলকাতায় ঠাকুর কি নতুন নতুন অবতার নিয়ে তাঁর পুত্র-কন্যাদের সামনে প্রতি বছর আবির্ভূতা হচ্ছেন না? তাদের বহুদর্শী চক্ষুকে মুগ্ধতার মায়াঞ্জন পরিয়ে দিচ্ছেন না? এই লেখায় সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।
দেখতে হবে, নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে
সে দিন অষ্টমী। তখন বিকেল সাড়ে চারটে। হঠাৎ করেই হা-রে-রে-রে-রে-রে করে ধেয়ে এল অসুর-বৃষ্টি। উত্তর থেকে দক্ষিণ এলোমেলো হয়ে গেল ভিড়। কিন্তু কত ক্ষণ? একে পুজো, তায় অষ্টমী। মানুষের উৎসাহ দেখে মানে মানে পিঠটান দিল কালো মেঘ। শহরের গলি থেকে রাজপথ তত ক্ষণে আবার জনতার দখলে। শুধু সার সার কালো (কিছু সাদা) মাথা। রাত যত বেড়েছে, জোড়া-পাগুলি আরও ক্লান্তিহীন হয়েছে। রাতভর হাজারো সৃষ্টিশীলতার তারিফ করেও আশ মেটেনি শহরবাসী আর শহরে আগতদের।
কেন পুজো মোটে চার দিন?
এই হাহাকার আরও জোরালো হয়েছে নবমী-দশমীতে। সেই জন্যই বোধহয় বাঙালি পথে নেমেছে পঞ্চমীর দিন থেকেই। চারকে ছয় করা গেল! দমবন্ধ ভিড় এড়িয়ে দূরের পুজোগুলোও আগেভাগেই দেখে নেওয়া হল। কিন্তু সবার ভাবনায় ‘ঐকতান’ হয়ে গেলেই তো মুশকিল! তাই পঞ্চমী-ষষ্ঠীতেই পথঘাট জনসমুদ্র। পরের দিনের পত্রিকায় দেখেছি প্রশাসন তথা পুলিশ আর মেট্রোকে গালমন্দ। কেন আগে থেকে মাঠে নামা হয়নি? কেন ভোগান্তি এড়াতে নেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা? তবে পরের দিকে এসে আর কোনও বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। খুব শক্ত কিন্তু নম্র ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে সব কিছু। না লাঠিপেটা, না গালমন্দ, আর না কোনও বিষাদ!
ঠাকুর আর মণ্ডপের পাশাপাশি মানুষ দেখারও আনন্দ কম নয়— নানা বর্ণের, সংস্কৃতির, বয়সের মানুষ। কারও পরনে সাবেকি জামাকাপড়। কারও হাল ফ্যাশনের সাজ। কিন্তু ঠাকুর দেখার উৎসাহে সবাই ষোলো আনা বাঙালি। ষষ্ঠীতে দক্ষিণ কলকাতা, সপ্তমীতে বেহালা, অষ্টমীতে হাওড়া, নবমীতে উত্তর ও মধ্য কলকাতা— এমনি কত্ত প্ল্যান! কত বিন্যাস আর সমাবেশ! কখনও বন্ধুর সঙ্গে, কখনও আত্মীয়দের সঙ্গে। কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বাসে, ট্রেনে, কখনও গাড়ি-ট্যাক্সি চেপে। উদ্দেশ্য একটাই— ঠাকুর দেখা। দেখতে হবে, নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে যে!
থিম তুমি কী?
কোথাও খাস শহরের বুকে উঠে এসেছে এক টুকরো গ্রাম। কখনও চিরচেনা শহরের অচেনা রূপ। কোথাও শান্তিনিকেতন। কোথাও নাগাল্যান্ড বা কাশ্মীর। কোনও মণ্ডপের থিমে শোনা যাচ্ছে পৌরাণিক কাহিনি। কোথাও কল্পনার জগৎ। প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ থেকে শুরু করে বিশ্ব উষ্ণায়ণ— থিমের পুজোর ভাবনায় সেজে উঠেছিল শহরের বেশ কিছু পুজোমণ্ডপ। পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে ও পরিবেশ নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়াতে বার্তা দিয়ে সচেতন করা নয়— এই ভাবনার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছিল মণ্ডপগুলির নান্দনিক দিকও।
অনেকের কাছে থিম হল পুজো ঘিরে শিল্পীর ‘সুররিয়ালিস্টিক’ বা পরাবাস্তব ভাবনার প্রকাশ। সেই ভাবনা পাখা মেলেছে প্রতিমা নির্মাণে, মণ্ডপের সাজে, আলোক প্রক্ষেপণে বা থিম সঙ্গীতের মুর্ছনায়।
থিম-শিল্পীদের চুম্বকের টানেই যানজটে গলদঘর্ম হয়ে লোক থই থই বরাহনগর থেকে বেহালা। আবার থিম ছাপিয়ে ঠাকুর দেখার সনাতনী আবেগও কিন্তু পুজোর কলকাতায় ফিরে ফিরে আসে।
মণ্ডপ পরিক্রমা সপ্তমীর সন্ধ্যায় ঘণ্টা দেড়েক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর কোনও অগ্রগতি হচ্ছে না দেখে দাদা বলল, ‘‘দাঁড়া, আমি একটু সামনে এগিয়ে দেখে আসি।’’ মিনিট পনেরো পর ফিরে এসে বলল, ‘‘চল বাড়ি চল।’’ আমি স্বভাবতই খুব একটা খুশি না এই প্রস্তাবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কেন?’’ দাদা যা বলল, তার মানে হচ্ছে, সামনে লাইন যেটি গিয়েছে সেটি আসলে খুব সহজ-সরল নয়। অবস্থা যা তাতে আগামী ২ ঘণ্টাতেও মণ্ডপ পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে না।
এখানে একটি কথা বলি, পুজোয় লাখো দর্শনার্থীর চাপ সামলাতে বিখ্যাত মণ্ডপগুলোতে বিশাল লাইনে তাদের বিন্যস্ত করেছে। কিন্তু কোথাও কোথাও লাইন অহেতুক সরু এবং লম্বা করে লাইনের আকৃতি বিশাল দেখানোও যে কারও কারও অভিপ্রায় নয়, এটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ লাইনে মানুষের সংখ্যা নিয়ে আনন্দবাজারের করা ‘টপ টেন’-এ জায়গা পাওয়া যেমন গৌরবের তেমনি পরের দিনগুলোতে লোক টানারও একটা মোক্ষম অস্ত্র। যাই হোক, ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হল। তবে পরের দিন গেলাম সক্কাল-সক্কাল। দিনের আলোতে গ্ল্যামার কিছুটা কম হলেও, অনেক কাছ থেকে দেখা গেল প্রতিমা ও মণ্ডপের কাজ। এবং এত ভিড়ের কারণও বোঝা গেল। এই পুজোর থিম ছিল ‘পেতল আর মেহগিনি, রূপ নিল মা ত্রিনয়নী’। শিল্পী ভবতোষ সূতার দু’টি আলাদা শিল্প মাধ্যম— কাঠ এবং পেতলকে চমৎকার শিল্পিত উপায়ে সন্নিবিষ্ট করেছেন। মণ্ডপটি নির্মিত হয়েছে একটি উড়ন্ত পাখির আদলে, যেটি মানব মন ও আত্মার উড়ানকেই নির্দেশ করে।
আরও যে ঠাকুর দেখার সুযোগ হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
বোসপুকুর শীতলামন্দির ও তালবাগান,
হরিদেবপুর অজেয় সংহতি, বিবেকানন্দ পার্ক ও ৪১ পল্লি,
রামলালবাজার, শিবমন্দির, নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘ, মুদিয়ালি ক্লাব, পূর্বাচল জাগরী সঙ্ঘ, একডালিয়া এভারগ্রিন, বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘ, ত্রিধারা সম্মিলনী, মনোহরপুকুর সর্বজনীন, অবসরিকা, সেলিমপুর পল্লি, বাবুবাগান, কিশোর বাহিনী অ্যাথলেটিক ক্লাব, হিন্দুস্থান পার্ক ‘কাচের স্বর্গ’, পাটুলি অধিবাসীবৃন্দ, পাটুলি সর্বজনীন, কালিতলা সর্বজনীন, গড়িয়া পঞ্চদুর্গা ও নবদুর্গা, সিংহী পার্ক, রাজডাঙা নব উদয়, চেতলা অগ্রণী, পূর্বাচল শক্তিসঙ্ঘ।
দেখার সুযোগ হয়নি, তবে পত্রপত্রিকায় বা মানুষের মুখে শুনেছি আরও অনেক মণ্ডপের কথা।
আবাসনের পুজো
এই ফাঁকে আবাসনের পুজোর কথাও বলে নেই। বড়-ছোট আবাসন বা অ্যাপার্টমেন্টগুলোও আয়োজন করে পুজোর। পুজোয় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরার আনন্দের থেকে সরাসরি পুজো আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারার আনন্দ অনেক বেশি। আয়োজনের পাশাপাশি উৎসবের দিনগুলোয় একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, শঙ্খ বাজানো আর ধুনুচি নাচের মতো প্রতিযোগিতা দেখা যায় সব জায়গাতেই। সেই সঙ্গে চলে জমিয়ে আড্ডা, থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এর পাশাপাশি বনেদিবাড়ির বিখ্যাত পুজো তো রয়েছেই। কালের আবর্তনে চাকচিক্য হারালেও ঐতিহ্য আর স্মৃতিমেদুরতা ঘিরে রয়েছে বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরিদের পুজো বা দক্ষিণ কলকাতার রানি রাসমণির বাড়ির পুজোতে।
থিম নেই
থিমের সঙ্গে দুর্গাপুজোর কী সম্পর্ক? আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কী? উত্তরের খোঁজে মাথা ঘামাচ্ছে কলকাতা। একটি ব্লগে লেখা হয়েছে, উদ্যোক্তারা নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সত্যি চমকে দেওয়ার মতো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চমকের থেকে হোঁচট লাগছে বেশি। এ বারে যেমন লাগছে কলকাতার কিছু বিখ্যাত থিম পুজোর প্রতিমা দেখে। মা দুর্গা বলতে যে জগজ্জননী, রণরঙ্গিণী দেবিপ্রতিমার কথা মনে ভেসে ওঠে, তা কই? প্রশ্ন উঠছে, থিমের পরিসরে শিল্পীরা স্বাধীন ভাবে কাজের সুযোগ পেলেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে কি পুজোর মূল বিষয়টাই গৌণ হয়ে যাচ্ছে না?
তবে একসঙ্গে থিম ও পুজো রক্ষা করতে রকমারি কৌশলের ছড়াছড়ি পুজোর কলকাতা জুড়ে। অনেক মণ্ডপেই একসঙ্গে দু’টি প্রতিমা। পুরোভাগে থিমের প্রতিমা। একপাশে ছোট পুজোর-প্রতিমা রাখা।
শারদ সম্মান নামের আড়ালে স্বীকৃতি বা পুরস্কারের জন্য যে প্রতিযোগিতা, তা যেমন এক দিকে সৃজনশীলতাকে উৎসাহ যোগাচ্ছে, অন্য দিকে উস্কে দিচ্ছে রেষারেষিকে। যেমনটি কাগজে পড়েছি— বহু অর্থ-শ্রম-মেধার ব্যয়ে তৈরি পুজো কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক বড় পুজোকর্তা। যাদের মাথার উপরে নেতা-মন্ত্রী নেই, পুঁজিও সামান্য, থিমের লড়াইয়ে টিকে থাকাটা তাদের জন্য ক্রমশ অসম যুদ্ধ হয়ে উঠছে।
গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ
এক জায়গায় দেখেছি লেখা হয়েছে ‘দুর্গাপূজা হল বাঙালির গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। নিঃসন্দেহে কথাটি সত্যি। অনেকে দুর্গাপুজোকে ধর্মের আবরণে দেখতে ভালবাসেন। তাদেরও বলি, আর কোনও ধর্মে এমনটি হয় কি? দলবেঁধে মণ্ডপে যাও আর নিখরচায় শিল্পকীর্তি দেখো, প্রসাদ খাও। ইউরোপে ক্রিসমাস উদযাপন দেখেছি। দোকানে-বাজারে সেল দেওয়া হয়, মেলাটেলাও বসে। আইস স্কেটিং, রোলার কোস্টার আসে। বসে বিয়ার কোম্পানির স্টল। কিন্তু সে তো হল ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল’! তার মধ্যে শিল্প কই? বৌদ্ধধর্ম তো পুরোটাই গাম্ভীর্যের চাদরে মোড়া। আর ঈদ!— দুর্গাপুজোর বিশেষত্ব এই জায়গায়!
শুধু সৌন্দর্য, আনন্দ বা উৎসবমুখীনতাই নয়, দুর্গাপুজোর আর একটি বড় দিক হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি ও পেশাভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায়। শিল্পের সব মাধ্যমগুলোর উপস্থিতির পাশাপাশি সকল পেশাজীবীর সক্রিয় অংশগ্রহণও দুর্গাপুজোয় উল্লেখ করার মতো ব্যাপার। মাটি, খড়, বাঁশ, কাঠ, ফুল, শোলা, ধাতু, আলো, শব্দ, বাদ্য, বস্ত্র, শঙ্খ, গাছ, চিত্র নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের সকলের ডাক পড়ে এই সময়। সারা বছর ধরে এই ক’টি দিনের দিকেই তাদের তাকিয়ে থাকতে হয় জীবন ধারণের জন্য।
গানের পুজো, পুজোর গান
পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত পুজোসংখ্যা আর পুজোর গান। এক সময় সারা বছর ধরে অপেক্ষা থাকত এর জন্য। কিশোর-মান্না-লতা-আশার পুজোর ক্যাসেট চালিয়ে ছুটির দুপুরে পুজোসংখ্যার পাতা ওল্টানোর আভিজাত্য বা বিলাসিতা শুধু বাঙালিকেই মানায়। এখন অবশ্য প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা অনুপস্থিত। পুজোয় এ বার কাদের অ্যালবাম বের হল জানি না। অন্তত কোনও মণ্ডপেই নতুন গান বাজতে শুনিনি। বরং শোনা গেছে মহালয়া অথবা সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, অর্ঘ্য সেন, ইন্দ্রাণী সেন প্রমুখের কণ্ঠে রবি ঠাকুরের গান। অথবা থিম পুজোর কল্যাণে মানানসই সঙ্গীত। যেমন নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘের মণ্ডপে কাশ্মীরি লোকশিল্পীদের লাইভ শো-র ফাঁকে বেজেছে পুজোর থিম সং। কাশ্মীরের হিমবাহে উষ্ণায়ণ ও দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বাঁধা গানে সুরকার জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কাশ্মীরি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছেন। বড়িশা ক্লাবের পুজোতেও আদিবাসীদের দুর্লভ বাদ্যযন্ত্র বানামের সুরটাই থিম। ভাওয়াইয়ার সুরে লোপামুদ্রা মিত্রের গান গোটা পরিবেশটাকে যেন পূর্ণতা দিয়েছে। চেতলা অগ্রণীর পুজোতে শাঁখ-কাঁসরের সঙ্গে আজানের সুরের মন্তাজ। কসবার রামলাল বাজারের পুজোয় মৌলিক গানে গাছ বাঁচানোর ডাক।
বিসর্জনের উদ্দাম নাচ শুরুর আগে পর্যন্ত অন্তত কোথাও হিন্দি গান শুনিনি— অল্প স্বল্প কিশোরকুমার শুনেছি, মান্না কিম্বা রাহুল দেববর্মণ মায় কুমার শানুও শুনেছি।
কে তুমি নন্দিনী
কলকাতার বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে বঙ্গতনয়ার সৌন্দর্যের জন্য। এর সঙ্গে যুক্ত হবে তাদের সাজসজ্জা, চলনবলন। বেশি কথা না বলে এটুকু বলি যে, মণ্ডপের যে নট-নড়নচড়ন দেবীমূর্তি, তার পাশাপাশি মণ্ডপের বাইরের এই জীবন্ত দেবীরা কলকাতায় পুজো দেখার আকর্ষণ অনেকটাই বাড়িয়ে দেন!
পেটপুজো
এই ক’টা দিন সারা শহর জুড়েই সারা দিনমান উদরপূর্তির আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। নামি দোকানগুলোতে ছিল ঠাসা ভিড়। এমনকী মিষ্টান্নের দোকানগুলোতে পর্যন্ত শোনা গিয়েছে ‘নেই, ফুরিয়ে গেছে’। আর ভ্রাম্যমান ফুচকা, রোল, বিরিয়ানি, শরবতের দোকানগুলো মানুষের পেটের আগুন নেভাতে মণ্ডপের আশেপাশে ছিলই। কোন ঠাকুর দেখতে গিয়ে কোথায় খাওয়া যেতে পারে তার উপর একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজারে।
আর যা কিছু ভাল কলকাতায় পুজো দেখে মনে হয়েছে পরিবেশ সচেতনতা বা নিরাপত্তা নিয়ে দায়বদ্ধতার দিক দিয়েও এটি ব্যতিক্রমী। পত্রিকায় পড়েছি শহর ও শহরতলির হাজার চারেক পুজো এ বার প্রতিমায় সিসাবিহীন রং ব্যবহার করেছে। শহরের পুজো কমিটিগুলির সম্মিলিত মঞ্চও এ বার পরিবেশবিধি মানার বিষয়ে জোর দিচ্ছে। পুজোমণ্ডপের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে লোহার মণ্ডপ গড়ার বিষয়েও বেশ কয়েকটি পুজো ভূমিকা রেখেছে। এই মণ্ডপের খরচা খানিকটা বেশি হলেও পরের বারও কাঠামোটার ব্যবহার করা যাবে। আর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি— সব মণ্ডপেই আগুন নেভানোর সরঞ্জাম ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে।
করে শুধু মিছে কোলাহল এ বার একটু অন্য কথা বলি। যারা হৈ-হট্টগোল-ভিড় ভালবাসেন না, তাঁদের জন্য পুজোর ক’টা দিন যন্ত্রণাকর। যন্ত্রণা উচ্চশব্দের জন্য, যন্ত্রণা দুর্গম পথঘাটের জন্য। বড় মণ্ডপের কাছাকাছি যাঁরা থাকেন তাদের ভোগান্তি মাত্রাহীন। অসুস্থ হলে তো কথাই নেই। এ বার ভিড় বা শব্দ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
আবার আসিব আমি কলকাতায় এই প্রথম আসা নয়। এসেছি, আনন্দ করেছি, ফিরে এসেছি। কখনওই খারাপ লাগেনি। এ বার কি হল জানি না! দশমীর পর দিন থেকেই মন খারাপ। শুধু মনে হচ্ছিল কী যেন নেই! বুঝলাম কলকাতাবাসী কোটি বাঙালির সঙ্গে আমিও আক্রান্ত হয়েছি। এত অসহ্য লাগছিল কী বলব! এত বিবর্ণ আর নিঃস্ব এই শহরকে আর কখনও লাগেনি।
আবার আসব পুজোয়। কলকাতায়।
জন্ম বাংলাদেশের বরিশালে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনো এখানেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিএসসি, তার পর স্নাতকোত্তর পড়াশোনা স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি থেকে। এক দশকের প্রকৌশল পেশাজীবন। অধুনা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উর্ধ্বতন ব্যাবস্থাপক পদে কর্মরত।
লেখালেখির শুরু শৈশবে। ছড়া, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ— সবই লেখেন।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.