এ সব কত দূর খাঁটি কলকাত্তাইয়া রান্না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু এর জন্মের পিছনে কলকাতার ভূমিকা কে অস্বীকার করবে! বিক্ষিপ্ত ভাবে কোনও না কোনও সময়ে এ শহরের কোনও না কোনও রেস্তোরাঁর মেনুতে এর খোঁজ মিলেছে। খানিকটা বিজাতীয় প্রভাব, খানিকটা মৌলিক স্বাক্ষর। বিচিত্র নিরীক্ষার হাত ধরে এই নির্মাণে শেষমেশ কলকাতার রসিক মনটাই বড় হয়ে উঠেছে।
ডাব দিয়ে মাংসের স্টু (দু’জনের জন্য)
এ মাংসের প্রাণভোমরা স্রেফ ডাবের জল। রোববার দুপুরে যে মাংসের ঝোল-ভাত খেতে খেতেই পরম কাঙ্ক্ষিত নিটোল ঘুমের জন্য দু’চোখ বুজে আসে, ডাবের সঙ্গে ভাব-সাবে সেই চেনা মাংসেই বিচিত্র ভাবের সৃষ্টি।
ডাব বস্তুটি অবশ্য এখন স্রেফ তৃষ্ণার শান্তি নয়, সৃষ্টির আধারও বটে। ডাবের খোলে লালিত চিংড়ির কথা আমাদের পূর্বপুরুষদের ক’জন জানতেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু ওই ডাব চিংড়িই কালে-কালে ঘোর বাঙালি সাব্যস্ত হয়েছে। তবে শোনা যায় চাটগাঁয়ে উপকূলবর্তী এলাকায় এই ধরনের কিছুর চল ছিল। দুপুরে ডুব দেওয়ার আগে মশলামাখা চিংড়ি নারকোলের মালায় পুরে মুখটা বন্ধ করে উনুনের নিভু-নিভু আঁচে ফেলে যেতেন বুদ্ধিমান রন্ধনকারী। রান্নায় সময়ও বাঁচত, স্বাদটাও হত খোলতাই। কারও কারও মত, আজকের ডাব-চিংড়ি, এই সেকেলে সৃষ্টিরই উত্তরসূরি। ডাবের জলযোগে মাংস রান্নার শিকড়ের খোঁজে এমন কোনও গাল-গল্প জানা নেই। তবে ওহ্ ক্যালকাটা রেস্তোরাঁয় এই পদটি খেয়ে চমৎকৃত না হয়ে উপায় ছিল না। আজকের বাঙালি ডাবের শাঁস সমৃদ্ধ ভাপা সন্দেশ বা ডাবের খেয়ালি কোর্মাতেও অভ্যস্ত। কিন্তু এই বিশেষ মাংসে দরকার শুধু ডাবের জলটুকু। মাংসের নির্যাস-স্নিগ্ধ বাঙালির নিরাভরণ ঝোলের সঙ্গতে ডাবের জল যে এমন রাজযোটক তা না খেলে বোঝা যাবে না।
উপকরণ
পরিমাণ
• ডাব
চারটে
• তেজপাতা
দু’টো
• দারচিনির টুকরো
দু’ইঞ্চি
• গোলমরিচ
১ চা-চামচ
• খাসির মাংস (২৫০ গ্রাম মতো)
পাঁচ টুকরো
• নারকোলের দুধ
আধ কাপ
• পেঁয়াজ কুচি
৫০ গ্রাম
• আদাবাটা
আধ চা-চামচ
• রসুনবাটা ও হলুদ
সিকি চা-চামচ করে
• নুন-চিনি
স্বাদমতো
• গাজর, বিন ও ফুলকপি
আন্দাজমতো
প্রণালী
• ডাবের জল বার করে নিন।
• আনাজগুলো ছোট ছোট করে কুটে ভাল ভাবে ধুয়ে রাখুন।
• ডেকচিতে ডাবের জল, গোলমরিচ, গরম জল দিয়ে ফোটান।
• এ বার কুচোন পেঁয়াজ, আদা-রসুনবাটা,
নুন, হলুদ গুঁড়ো ও মাংস দিন।
• মাংস সিকিভাগ সেদ্ধ হলে আনাজ দিন।
• ঢিমে আঁচে নারকোলের দুধযোগে রাঁধুন।
• ভাতের সঙ্গে উপাদেয়।
স্টারফ্রায়েড ওয়াটারমেলন রিন্ড (চারজনের জন্য)
তরমুজ বস্তুটিকে নিয়ে বাঙালি অহেতুক ঠাট্টা-তামাশা করেছে। উপযুক্ত মর্যাদা দেয়নি। বাইরে সবুজ, ভেতরে লাল এই ফলটির সঙ্গে তলে তলে এক প্রকারের বাম-ঘেঁষা রাজনীতিকের সাদৃশ্যটুকুই সব নয়। তরমুজকে হেঁসেলে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে, তা থেকে অনেক ধুন্ধুমার কাণ্ডই ঘটতে পারে।
পার্ক হোটেলের এগজিকিউটিভ শেফ শরদ দিওয়ানের কল্যাণে এমন অনেক নমুনা টের পেয়েছি। যেমন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্টাইলে কর্নফ্লাওয়ার-ডিমের ব্যাটারে মোড়া কচকচে মিষ্টি-মিষ্টি ওয়াটারমেলন টফি। কিম্বা তরমুজ প্রয়োগে রকমারি স্যালাড। কিন্তু তরমুজের সবুজ ও লালের মাঝখানে সাদা অংশটি যে এ ভাবে শেফকে প্রেরণা জোগাতে পারে, তা সত্যিই ভাবতে পারিনি। শরদের দাবি, এও আদতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রান্না। কিন্তু দীর্ঘ কলকাতাবাস ও বাঙালির হেঁশেলের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুবাদেই শরদ এই সৃষ্টি খুঁজে পেয়েছেন।
ঘরোয়া লাউচিংড়ির কথা আর নতুন করে কীই বা বলার! এ হল তরমুজ চিংড়ি। শরদ বোঝালেন, তরমুজও নাকি লাউ ফ্যামিলির একজন! হবে বা! কিন্তু অল্প তেলে ভাজা তরমুজের সাদা অংশ, যেমন স্বাদু তেমনই স্বাস্থ্যকর। নিরিমিষখোররা শুধু শুধু চচ্চড়ি বানিয়েও খেতে পারে। আবার চিংড়ির বদলে চিকেনও এ বস্তুর সঙ্গে জমবে।
উপকরণ
পরিমাণ
• একটা তরমুজের বাইরের সবুজ আর ভিতরের লালের মাঝখানের সাদা অংশ পাতলা ফালি ফালি করে কাটা
• অলিভ অয়েল
এক টেবিল চামচ
• সাদা পেঁয়াজ পাতলা ফালি করে কাটা
দু’টো
• লাল-হলুদ ক্যাপসিকাম কুচোনো
১০০ গ্রাম
• কাঁচা লঙ্কা ও লাল লঙ্কার কুচি
আধ টেবিল চামচ
• রসুনকুচি
এক টেবিলচামচ
• চিনি
এক চা-চামচ
• রাম (না-দিতেও পারেন)
দু’টেবিল চামচ
প্রণালী
• কড়ায় অল্প তেল দিয়ে আঁচ বাড়িয়ে
রসুন ও পেঁয়াজকুচি নাড়তে থাকুন।
• ক্যাপসিকাম ও লঙ্কা ছেড়ে দিন।
• এ বার তরমুজ ও চিনি দিন।
• রান্না হওয়া অবধি দ্রুত নেড়ে-চেড়ে নিন।
• একটু ধনেপাতা ছড়িয়ে গরম-গরম পরিবেশন করুন।
টিপস্
লাউচিংড়ির আদলে এই রান্নাটা আমিষও রাঁধা যায়। চিকেন, মাছ বা চিংড়ির সঙ্গেও ভাল খেতে হবে।
হিং ভাপা মাংস (আট জনের জন্য)
বাঙালি রান্না বরাবরের অন্তঃপুর-লক্ষ্মী। বড়জোর পাইস হোটেলে দুভার্গা প্রবাসী বা পরিবারহীন একাকীদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নিয়ে তাকে ভাবতে হয়েছে। রেস্তোরাঁয় বাঙালি শেফরা সারা দুনিয়ার খানা রেঁধে তারিফ কুড়োলেও এই সে দিন পর্যন্ত নিজের ঘরোয়া স্বাদ-গন্ধকে নিয়ে ভাবনাচিন্তার ধার ধারেনি।
হালে রেস্তোরাঁয় বাঙালি রান্নার চর্চা কিন্তু বেশ কিছু নতুন পদের জন্ম দিয়েছে। তারই একটি এই হিং ভাপা মাংস। ভাতের মধ্যে টিফিন কেরিয়ারে ভরে মশলা-মাখা মাছ ভাপানো ছাড়া বাঙালি ভাপার চর্চার দৌড় এ যাবৎ সীমিত। পুরনো লোকেরা পাতুরিকেও ঠিক ভাপা বলে ধরতে চান না। কলাপাতায় মোড়া পাতুরি নাকি ভাপা নয়, আদতে পোড়া। রেস্তোরাঁর হেঁশেলে প্রযুক্তির প্রয়োগে সম্প্রতি ভাপা স্বাদে বাঙালির বিশেষ দক্ষতার পরিচয় মিলেছে।
তবে মাছ বা চিকেন ভাপানো তুলনায় সহজ। কিন্তু বাঙালিয়ানার উৎকর্ষ মিশিয়ে স্বাদিস্ট পশু মাংসকে ভাপিয়ে বশ করা চাট্টিখানি কথা ছিল না। বোহেমিয়ান রেস্তোরাঁর কর্তা-কাম-শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, হাই প্রেশার স্টিমার ছাড়া অন্য ভাবে এই রান্না সোজা কাজ নয়। সাধারণত, পুজোর ভোগের পেঁয়াজ-রসুনহীন মাংসে হিংয়ের মহিমার প্রকাশ ঘটে। এই নিরাভরণ ভাপা মাংসেও হিংয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেকে থালার উপরে কলাপাতার খামে এ বস্তুটি পরিবেশন করেন। তাতে কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে। বাটিতে খামে-ভরা মাংসখণ্ড দিলে তার শরীর থেকে বিচ্ছুরিত ঝোলটা চুমুক মেরে নিঃশেষ করা আনন্দ। আসলে শুধু মাংস নয়, মাংসের নির্যাসমাখা হিংগন্ধী ঝোলটাও মোটে কম যায় না।
উপকরণ
পরিমাণ
• মাটনকুচি বা কিমা
২০০ গ্রাম
• পেঁপেবাটা
সিকি চা-চামচ
• আদা ও রসুনবাটা
আধ চা-চামচ করে
• লাল লঙ্কার গুঁড়ো
সিকি চা-চামচ
• গরম মশলা
ছিটেফোঁটা
• হিং
এক চা-চামচ
• পেঁয়াজকুচি
২০ গ্রাম
• নুন
স্বাদমতো
• কলাপাতা
-
প্রণালী
• পেঁয়াজ ছাড়া বাকি সব উপকরণ মাংসকুচির
সঙ্গে
মাখিয়ে আধ ঘণ্টা ফ্রিজে রাখুন।
• কলাপাতা চার ইঞ্চির চৌকো আকারে কাটুন।
• পেঁয়াজকুচি ও মাংসকুচি মিশিয়ে সমান
মাপে আট ভাগ করে গোল্লা পাকান।
• গোল্লাগুলো কলাপাতায় মুড়ে ১০ মিনিট স্টিমারে ভাপান।
• গরম-গরম পরিবেশন করুন।
টিপস্
• এক ডেকচি ফুটন্ত জলের উপরে সাদা কাপড় পেতে
গোল্লাগুলো তাতে বসিয়েও ভাপানো যেতে পারে।
• উপরে ডেকচির থেকে বড় কোনও পাত্র চাপা দিতে হবে।
চিংড়ি ভর্তা (চার জনের জন্য)
ভর্তা হল, মাছ-তরকারি ইত্যাদি সেদ্ধ করে কাঁচা তেল, আদা, পেঁয়াজ, লঙ্কাযোগে চটকিয়ে প্রস্তুত খাদ্য। কামিনীকুমার ঘোষের লৌকিক শব্দকোষে এ ডেফিনিশন মিলবে। ভর্তার জন্মস্থান হিসেবে উত্তর ও পূর্ববঙ্গের কথাই বলা আছে। কিন্তু কলকাতা এ রসে একেবারে বঞ্চিত তা বলা যায় না। থাকলে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের কস্তুরী-প্রিন্সে এ বস্তুটির এত সমাদর দেখা যেত না।
ভর্তাকে এই বাংলার ভদ্রমণ্ডলীর সামনে পেশ করার পিছনে কস্তুরীর গোপাল সাহা ওরফে বাবলুবাবু কার্যত ভগীরথের ভূমিকায়। এক বার বেঙ্গল ক্লাবের এক লাঞ্চের বরাতেও চিংড়ি ভর্তায় তাঁরা তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পাতি মশলাযোগে সর্ষের তেলে চিংড়ি-মাখা। স্রেফ এই দিয়েই বেড়াল ডিঙোনো ভাত খেয়ে ওঠা যায়।
বাংলার আবহমান কালের ফার্স্ট ফ্যামিলি ঠাকুরবাড়ির রন্ধনপটিয়সী কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীদেবীও ফলাও করে ভর্তার সুখ্যাতি গেয়ে গিয়েছেন। এই বাংলায় যাকে ভাতে বলে, ও পারে সেটাই ভর্তা। গুচ্ছের মাখনের শ্রাদ্ধ করে গরম মশলার সুরভি মেশানো পঞ্জাবি ভর্তার সঙ্গে বাঙালির কীর্তির মিল নেই। এ স্রেফ সর্ষের তেল, লঙ্কার মাখো-মাখো প্রেম। প্রজ্ঞার নিজেরও ভর্তার একটি সংজ্ঞা রয়েছে— ভাতে কর সিদ্ধ, আগুনে পোড়াও
ঝাল-টক মেখে রুচি করে খাও!
ও পার বাংলায় এখনও আলু-ডাল-বেগুন তো বটেই ঢ্যাঁড়শ, মিষ্টি কুমড়ো, বাঁধাকপি, আম, জাম, জাম্বুরা (বাতাবিলেবু)-র ভর্তাও আকছার মেলে। একুশ শতকের কলকাতার দৌড় কস্তুরী অবধিই। কস্তুরীর পরামর্শ, চিংড়িটা মশলায় কষিয়ে শিলে থেতো করে নিলে নিখুঁত হয়। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পাশাপাশি, কস্তুরী এখন বালিগঞ্জেও পাড়ি দিয়েছে। অবিশ্যি সেখানে ফি-দুপুরে ভর্তার দেখা মেলে কি না, খোঁজ নিয়ে দেখা হয়নি।
উপকরণ
পরিমাণ
• কুচো চিংড়ি
২৫০ গ্রাম
• শুকনো লঙ্কা
৪-৫টা
• কালো জিরে
১৫ গ্রাম
• কুচোন রসুন
৫০ গ্রাম
• সর্ষের তেল
১০ গ্রাম
• ধনেপাতা কুচি
তিন চা-চামচ
প্রণালী
• চিংড়ির মাথা ও ল্যাজ ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নুন মাখিয়ে নিন।
• কড়ায় অল্প আঁচে শুকনো লঙ্কা ও কালো জিরে ভাজুন।
• এ বার কুচোন রসুন দিয়ে একটু ভেজে নুন-মাখা চিংড়ি দিন।
• মাছটা লাল হয়ে গেলে
পাঁচ গ্রাম সর্ষের তেল ছড়িয়ে নাড়াচাড়া করুন।
• মাছটা নামিয়ে এ বার শিলে পিষতে হবে।
• স্বাদমতো নুন, বাকি সর্ষের তেল ও ধনেপাতাকুচি দিয়ে মাছটা মাখুন।
• গরম ভাতের সঙ্গে খেতে খুবই ভালো লাগে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.