আমি আদতে একজন শহরের মানুষ। যে শহরের নাম কলকাতা। পুজোতে অনেক দিন পর্যন্ত কলকাতা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারতাম না। তাই কাজের খাতিরে যেখানেই থাকি না কেন, পুজোর সময় কলকাতায় ফিরতেই হয়েছে।
পুজোর কলকাতার দু’রকম স্মৃতি— এক, ‘পাড়ার পুজো’ যা প্রায় বাড়ির পুজোর মতোই। আর দুই, কলকাতার ‘বড় পুজো’ যার আকর্ষণ একেবারে আলাদা রকমের। অনেক ছোটবেলায় ‘বড় পুজো’ মানে উত্তর কলকাতার বাগবাজার-কুমোরটুলি-শোভাবাজার কিম্বা দক্ষিণের সঙ্ঘশ্রী-সঙ্ঘমিত্র-সম্মিলনী। তা বাদে ছিল ছড়ানো ছিটানো একডালিয়া এভারগ্রিন-সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যার-চালতাবাগান। এ সব পুজো দেখতে বাবা মায়ের সঙ্গে দোতলা বাসে চেপে বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়তাম। পরে কলকাতায় ‘বড় পুজো’র সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। আর তার সঙ্গে বাড়ছিল থিম পুজোর রমরমা। বড় পুজোর তালিকায় যোগ দিচ্ছিল বেহালা, দমদম পার্ক, বোসপুকুর। খেই হারিয়ে ফেলছিলাম— মাত্র পাঁচটা দিন! কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব?
ইতিমধ্যে আমাদের বাড়ি বদল হয়েছে। মানিকতলা থেকে সল্টলেক। সেখানকার ছোট ব্লকে আমাদের ছোট একতলা বাড়ি। বিদ্বজ্জনেরা আমাদের প্রতিবেশী। এক দিন সেখানেও শুরু হল দুর্গাপুজো। মানিকতলায় যা ‘পাড়ার পুজো’ ছিল, সল্টলেকে সেটাই হয়ে গেল ‘ব্লকের পুজো’। এ যেন সত্যি সত্যি নিজেদের বাড়ির পুজো। আস্তে আস্তে ব্লকের পুজোর সঙ্গে একাত্মতা বেড়েছে, বেড়েছে দায়িত্বও। আর জীবন থেকে ‘বড় পুজোর’ গুরুত্ব কমেছে একটু একটু করে।
এর পর এসেছে পরবর্তী প্রজন্ম, বেড়েছে মিডিয়ার দাপট। তাদের কাছে ব্লকের পুজোই সব হলেও স্বাদ বদলানোর জন্য তিন প্রজন্মের নিকট আত্মীয়েরা সবাই মিলে গাড়ি করে মাঝ রাত্রে শিবমন্দির কিম্বা মুদিয়ালির ‘বড় পুজো’র শিল্পময় থিম দেখতে গিয়েছি। মন্দ লাগেনি! ছোটদের সঙ্গে ফিরে এসেছে শৈশবের ঠাকুর দেখার স্মৃতি। কিন্তু দশমীর দিন ঠাকুর বিসর্জন হয়ে গেলে শেষ হয়ে যাওয়া ‘ব্লকের পুজো’র জন্য মন বিষাদে ভরে গিয়েছে। সেই বিষাদ ভুলতে কাজে নিমগ্ন হয়েছি নিজের মতন করে।
আজ প্রায় ছ’ বছর ধরে বদলির সূত্রে উত্তর-পশ্চিম আমদাবাদের ‘চাঁদখেডা বেঙ্গল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন (সিবিসিএ)-এর দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত। পুজোর সময় মেয়ের ছুটি না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও কলকাতা যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কাজেই সিবিসিএ-র পুজো ‘ব্লকের পুজো’র বিকল্প হয়ে উঠেছে। এখানেও দশমীর দিন ঠাকুর বিসর্জন হয়ে গেলে শেষ হয়ে যাওয়া পুজোর জন্য মন বিষাদে ভরে যায়। আজও কাজে নিমগ্ন হয়ে নিজের মতন করে সেই বিষাদ ভোলার চেষ্টা করি।
ছোটবেলা কলকাতা শহরে কাটলেও, কর্মসূত্রে বর্তমানে গুজরাতে বসবাস। পেশায় ভূতাত্বিক।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.