|
অমাবস্যা। অন্ধকার রাত। চারদিক নিষুতি। আজ যেখানে চিৎপুর, ওখানে তখন গভীর জঙ্গল। কোল দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। সন্ধ্যা হতে না হতেই শেয়ালের ডাকে গা ছমছম করে। সেবার চিতে ডাকাতের দল মায়ের পূজা করছে। চিত্রেশ্বরীর মন্দিরে। চারদিকে মশাল। মশালের আলোয় কামারের হাতের খাঁড়া ঝকমক করছে। আর প্রেতের মত দীর্ঘ ছায়া কাঁপছে দেওয়ালে। একটি মানুষকে তারা বেঁধে রেখে দিয়েছে হাড়কাঠের কাছে। নরবলি হবে। গঙ্গাতে তখন ভরা জোয়ার। তীব্র কলধ্বনি। চারদিকের পরিবেশ ভয়ঙ্কর।
কলকাতায় কালী-চর্চার এইদিন প্রথম পর্ব। কলকাতাওয়ালীর এই ছিল আরাধনা। তখনো ঠনঠনের জন্ম হয়নি। আর ফিরিঙ্গী কালীর কথা না তোলাই ভালো। তবে সিদ্ধেশ্বরী হয়ত ছিলেন। আর প্রকৃত কলকাতার অধিষ্ঠাত্রী যিনি, তিনি যে ছিলেন তার প্রমান আছে, ইনি যে সে নন, কালীঘাটের কালী। এঁর নামেই কলকাতা। প্রকৃত কলকাতাওয়ালী ইনিই।
চিত্রেশ্বরীর মন্দিরের কোল দিয়ে একটি সরু রাস্তা বরাবর চলে গিয়েছিল দক্ষিণের দিকে। লাল দীঘি পেরোলেই ছিল গহন বন। সেখানে ভীষণ ডাকাতের ভয়। আর তার থেকেও ভয় বাঘের। ডিহি কলকাতা ছাড়িয়ে সে পথ গিয়েছিল কালীঘাট পর্যন্ত। দুশ বছর আগেও এ পথ ছিল। হলওয়েল সাহেব দেখেছিলেন এটি। এ পথের কথায় তিনি লিখেছিলেন‘দি রোড লিডিং টু কালীঘাট অ্যাণ্ড ডিহি ক্যালকাটা।’দিনের বেলা সে পথে যেতে লোকের গা ছমছম করত। আর রাতে তো কথাই নেই। পালকিওয়ালারাও সওয়ারা নিতে সাহস করত না। আর যদি বা নিত, অনেক লোক-লস্কর যোগাড় করতে হত তাদের। মশাল হাতে আগে আগে দৌড়ত মশালচীরা। সঙ্গে থাকত পাইক বরকন্দাজ। মোটকথা, সে অনেক খরচ। কলকাতাওয়ালীর মোকামে যাওয়া কি সোজা কথা।
তবে তাঁর মোকাম হয়ত একেবারে প্রথমে ওখানে ছিল না। সত্যি সত্যিই তিনি যে কলকাতার দেবী, তার প্রমান আছে একটি কিংবদন্তীতে। সেদিন তিনি চিত্রেশ্বরীর কাছাকাছিই ছিলেন। গঙ্গার ওপরেই ছিল মন্দির। জঙ্গলে ঘেরা। মন্দিরের কোনে একটি দেওয়াল। পোস্তা বাঁধান। পাছে পড়ে যায় তাই মজবুত করা। ভক্ত ও দর্শনার্থীদের দল আসত মাঝে মাঝে। বাঁধানো পোস্তার ওপর বসত। এরপরে এখানে বসে বসে কেনাবেচাও আরম্ভ হয়ে গেল। বসল হাট। পরে হাটটাই উঠল জোরালো হয়ে। দেবী হারিয়ে গেলেন। দেখতে দেখতে একদিন পড়ে গেল মন্দির। পোস্তার হাটে যে মায়ের মন্দির ছিল সকলে তা ভুলেই গেল।
ভুলল না কেবল একদল কাপালিক। হঠাৎ একদিন তারা এসে হাজির। ভাঙ্গা মন্দির হাঁটকে তারা দেবীর মুখ প্রস্তরটি খুঁজে বের করল। তারপর সেটি নিয়ে তারা চলে গেল দক্ষিণের জঙ্গলে।
সেই সময়ে এক সন্ন্যাসী ছিলেন জঙ্গলের ভেতর। তাঁর নাম জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী। আজকের চৌরঙ্গী তাঁর নামের স্মৃতিই বহন করছে। কেউ বলেন ঐ সন্ন্যাসী ছিলেন শৈব। কেউ বলেন তান্ত্রিক। জঙ্গলের ভেতর হঠাৎ একদিন তাঁর কাছে একটি অদ্ভূত দৃশ্য ধরা দিল। সবিস্ময়ে একদিন তিনি দেখলেন যে একটি গরু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মাটির ওপর অজস্র ধারায় দুধ দিচ্ছে। ঐ অভাবিত দৃশ্য দেখে সন্ন্যাসীর মনে কৌতুহল জাগল। তিনি দুধে ভেজা জায়গাটি খুঁড়ে ফেললেন। আর মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কাপালিকদের লুকনো মায়ের মুখ প্রস্তর। সন্ন্যাসী পূজা করলেন মাকে। তারপর জঙ্গলগিরি চলে যান গঙ্গাসাগর। যাবার সময় এক শিষ্যের ওপর পুজোর ভার দিয়ে গেলেন।
এর পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত।
বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীরা আবিস্কার করলেন কলকাতাওয়ালীকে। এককালে তাঁদের ছিল শ্যামরায়। এখন এলেন শ্যামা। আবীরের আভায় দোলের দিন শ্যামের উৎসবে দীঘির জল উঠত লাল হয়ে। তা থেকে একালের লালদীঘি। এখন শ্যামার পূজায় পাঁঠার রক্তে কালীঘাটের পথ পিচ্ছিল হয়ে উঠল। সাবর্ণ চৌধুরীরা জাঁকজমকে মায়ের পূজা আরম্ভ করে দিলেন। পুজোর দায়িত্ব নিল হালদার পুরোহিত। কলকাতার অধিষ্ঠাত্রী স্থায়ী হয়ে বসলেন কালীঘাটে। কলকাতার যত বাড়-বাড়ন্ত হয়, মায়ের মহিমাও দিনে দিনে বিকশিত হয়।
কলকাতার বাবুরাও গাঁটছড়া বাঁধলেন সাহেবদের সঙ্গে। বিলাসিতায় গা ভাসালেন, সময়মত তাঁরা এসে মায়ের কাছে প্রণাম জানাতে ভুলতেন না। বড়িশা থেকে সাবর্ণ চৌধুরীদের যে নিয়মিত পুজো আসত তার কথা না হয় ছেড়ে দেওয়া হল। কিন্তু পাইক-পাড়ার রাজবাড়ির কথা ভোলা যায় কেমন করে। কালীর আমিষ ভোগের নিত্য ব্যয় রাজা ইন্দ্রসিংহ বরাবর বহন করতেন। তাঁর দেওয়া পশু সকলের আগে বলি দেওয়া হত। মায়ের সোনার জিহ্বা তাঁরই দেওয়া। রাজা নবকৃষ্ণ আসতেন পুজো দিতে। সোনার মুণ্ডমালা তিনি গড়িয়ে দিলেন মাকে। না কেবল কলকাতা নয়, সুদূর নেপাল থেকেও সেদিন পুজো আসত। মায়ের মাথায় সোনার ছাতা তুলে ধরেছিলেন অন্য কেউ নয়, নেপালের প্রধান সেনাপতি।
মোটকথা, এই হল মায়ের ঠাঁই। পীঠস্থান। নিত্য পুজো। নিত্য নাটক।
|
|