|
শাক্ত-মতবাদ অতি প্রাচীন ও ব্যাপক। এই মতবাদের প্রথম কথা শক্তিই ব্রহ্মব্রহ্ম হল সমগ্র বিশ্বের পরম ও চরম তত্ত্ব। সেই ব্রহ্ম থেকেই জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়। তৈত্তিরিয়া উপনিষদ-এ এ কথা স্পষ্ট বলা আছে। এই অনন্ত বৈচিত্রময় দৃশ্যমান জগতের উৎপত্তি কোথা থেকে এবং পরিণামই বা কিএ প্রশ্ন দর্শণ বিজ্ঞান জগতের একটি মৌল সমস্যা। শাক্তবাদে এর সমাধান পাওয়া যায়। এক মহীয়সী-শক্তি এই জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারকারিণী। ঋগ্বেদের দেবীসুক্ত, উরনিষদ, পুরান ও তন্ত্রসব শাস্ত্রেই এই মহাশক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে যেরূপ ব্রহ্ম লক্ষণ দিয়েছেন ঐ সব গ্রন্থে সেইরূপ লক্ষণের দ্বারাই ভগবতীর মহাশক্তির স্বরূপ নির্ণীত হয়েছে।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে দেখা যায়, ব্রহ্মরাদিগণ ধ্যানযোগে দেবশক্তিকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এই বিরাট বিশ্বের কারণ রূপে। সেই দ্যুতিশীল আত্মশক্তি সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের দ্বারা নিগুঢ়। এ-থেকেই বোঝা যায় চিৎ ও অচিৎ উভয় ব্যাপিনী এক মহতী শক্তি এই বিশ্বের বিধাত্রী রূপে বিরাজিতা।
অধুনা আবিস্কৃত মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ থেকে শাক্তবাদের বহু প্রাচীন চিহ্ন পাওয়া যায়। ভারতীয় সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে সেখানেও শাক্তবাদের উল্লেখ দেখা যায়। শৈব ও শাক্তবাদ একই চিন্তাধারা প্রসূতযেখানেই শিবলিঙ্গ ও শিবমন্দির সেখানেই শক্তি-পীঠ ও শক্তি-মন্দির প্রভৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়। শিব-শক্তির সম্বন্ধ দুভাবে প্রকটিতকোথায়ও শিব প্রধান শক্তিরূপে আবার কোথায়ও বা শক্তিপ্রধান শিবরূপে দেখা যায়। শক্তির বিভিন্ন প্রতীকোপাসনা সাধারণ শ্রেণীর জন্য সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। এমনকি শক্তি সম্প্রদায়ের দশনামী সন্ন্যাসীগণও শ্রীচক্রের পূজা করে থাকেন। ‘শ্রীচক্র’ ত্রিপুরা সুন্দরীদের যন্ত্রবিশেষ। কাশ্মীর থেকে মাদুরা, আর গুজরাট থেকে গৌহাটি অবধিভারতের সর্বত্রই শক্তিপীঠগুলির শাক্তবাদের প্রাচীনতা ও ব্যাপকতার সাক্ষ্য বহন করে নিয়ে চলেছে।
শক্তিবাদের প্রাচীনতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হল এবার শক্তির প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
পরাহস্য শক্তি বহুধাপি শ্রুরতে,
স্বাভাবিকী জ্ঞান, কলা, ক্রিয়া চ।
পরাশক্তি বহুবিধএই শক্তি কারণ
জগতে দেবতাদের মধ্যে, তৈজস বিশ্ব-নিয়ন্তাদের মধ্যে ও স্থূল বিশ্বে অনু-পরমানুদের মধ্যে অনন্ত শক্তি সঞ্চারিত করে চলেছে। কারণ ক্ষেত্রে ইচ্ছা, জ্ঞান ও ক্রিয়ারূপ শক্তি রঃ সত্ত্ব ও তমোগুণকে আশ্রয় করে আছে। গুণাতীতে সেই শক্তিগুলির বিশেষ বিশেষ গুণগুলি লুপ্ত হয়ে এক পরা চিতি শক্তিতে পর্যবসিত হয়।
দাবীসুক্তের আলোচ্য বিষয় পরমাত্মা-সচ্চিদানন্দ বিভব, দেবা মাহাত্ম্যে সেই পরমাত্মাই মহামায়ারূপে বর্ণিত হয়েছে। পরমাত্মা ও মহামায়া অভিন্ন। তত্ত্বের দিক থেকে মায়া ও আত্মা ভিন্ন পদার্থ রূপে আলোচিত হয়। দেবীসুক্তে শক্তির স্বরূপ সম্পর্কে বলা আছে, আমি জগৎ পিতাকে প্রসব করি, ইহার উপরিভাগ আনন্দময় কোষের মধ্যে বিজ্ঞানময় কোষে আমার কারণ শরীর অবস্থিত। আমি সমগ্র ভুবনে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছি। দূরবর্তী স্বর্গলোককেও আমি স্পর্শ করিয়া আছি। যখন আমি বায়ুর ন্যায় প্রবাহিত হই, তখন এই সমগ্র ভুবনের সৃষ্টি হয়। স্বর্গ মর্তের পরেও আমি বিদ্যমান। ইহাই আমার মহিমা।
সেই মহাকালের যিনি সঞ্চালিকা, কালকে যিনি কলন করেন তিনিই কালী নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। ইনি আদ্যাশক্তি সমস্ত অভিব্যক্তির আদিতে ইনি বিদ্যমান। মহানির্বাণ তন্ত্রের চতুর্থোল্লাসে শ্রীশ্রীসদাশিবের উক্তিতে দেখা যায়
‘কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকাল প্রকীর্তিতঃ
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকাপরা।’
মায়ের রং কালো, কিন্তু বস্তুত তিনি অরূপসমস্ত রূপের আশ্রয়স্থলসমস্ত আকারের আকার তাই তিনি নিরাকার। তিনি রহস্যময়ী, তিনি অনন্যা। ব্যবহার ভূমিতে তিনি সৃষ্টি, স্থিতি, সংহারকর্ত্রীমহাকালের সঙ্গে অবিনাভাবী আবার জগৎ ঊর্ধ্বে তিনি শিব সীমান্তিনী হয়েও শিবের সঙ্গে একাত্ম। শক্তিবিহীন শিব শবেরই নামান্তর। শিব চিতি শক্তিরূপে সারা বিশ্বময় ব্যপ্ত হয়ে আছেন। ব্যক্তি ও সমষ্টি মনে সেই শক্তিই সক্রিয়। মায়ের নয়ন তিনটিপ্রথম ও দ্বিতীয় নয়নের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির উদয় নিলয়ের লীলা চলছে, মায়ের তৃতীয় নয়ন সমস্ত উদয় নিলয়ের ঊর্ধ্বেইহা শান্ত অপচল প্রকাশের সঙ্গে একাত্ম। মায়ের চারি হস্ত বামদিকের দুহাতে অজ্ঞান-নাশিনী খড়্গ ও নরমুণ্ডমায়ের করাল রূপআর দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে জপরতা নিশ্চল বরাভয়।
|
|