৩ কার্তিক ১৪১৮ শুক্রবার ২১ অক্টোবর ২০১১





পুরনো কথা




মার ঠিক মনে পড়ছে না, কে যেন বলেছিলেন: স্মৃতি জিনিসটা গায়ের চামড়ার মতন, অবসরে আড়ালে জামাজোব্বা খুললেই নিজের চোখে পড়ে। কথাটা আমার নিজের বরাবরই বেশ পছন্দ। এর সঙ্গে বরং আমি আরও একটু যোগ করতে চাই: গায়ের চামড়ায় যেমন আচিলটাচিল! জড়ুল, বড়সড় তিল বা কাটাকুটির দাগ সেইরকম স্মৃতির মধ্যেও কোনো কোনো ‘বিশেষ’ স্মৃতি থাকে, কখনও তা ফিকে দাগের মতন, কখনও বা গভীর চিহ্নের মতন। আমাদের কোনো পুজোপার্বণ, সামাজিক অনুষ্ঠান, এমনকি শোকতাপ এলেও কেমন করে না জানি পুরোনো আনুষঙ্গিক স্মৃতিটা ভেসে ওঠে। যেমন দুর্গাপুজোর সময় নিজেদের বাল্য-কৈশোরের পুজোর দিনের স্মৃতি মনে না এসে যায় না। সেকালের প্রতি আমাদের এইটুকু দুর্বলতা স্বাভাবিক, কোনো কোনো সময় সান্ত্বনারও।

কালীপুজো এবং দেওয়ালীর প্রসঙ্গ এলেও আমার কিছু বাল্য-কৈশোর স্মৃতি এবং যৌবনের স্মৃতিও ভেসে ওঠে। বাল্যকালের কথাটাই আগে বলি। তখন আমরা তাকাতাম বিহারের বড়সড় এক রেল শহরে, বাঙলা দেশ থেকে তার দূরত্ব যৎসামান্য মাত্র। তখন এইসব শহরটহরে বাঙালীদের প্রধান্য ছিল খুব। বাঙালীরা যেসব পূজাআর্চা করেন, অনুষ্ঠান করেন, যেসব সামাজিকতা রক্ষা করেন তার চলও ছিল যথেষ্ট। আমাদের এই রেলশহরে কালীপূজা হত যথেষ্ট। আমাদের সেই রেলশহরে কালীপুজো হত তিনটে, তার মধ্যে একটি ছিল বারমেসে কালী, বাজারের কালী-বাড়িতে তার পুজো হত এখনও হয়, শুনেছি। অন্য দুটো কালীপুজোই ছিল রেলবাবুদের। একটা হাত একপ্রান্তে, অন্যটা আমাদের রেল কোয়াটার্সের দিকে তেঁতুলপাড়ায়। আমাদেরটাই ছিল নতুন, কারণ আমাদের রেলপাড়াটা তখন গড়ে উঠছে আস্তে আস্তে, জোড়া ফটক, বরফকল আর সাহেবদের কারখানার গা ঘেঁষে।

কালীপুজোটাকে আমরা আমাদের বাড়ির পুজো বলেই মনে করতাম এবং বুড়োবুড়ি থেকে শুরু করে আমরা বাচ্চাকাচ্চার দল পর্যন্ত দিন কয়েক বোধহয় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে থাকতাম। পুজোটাও হত সেইরকম: ডোমপাড়ার মাঠ পরিস্কার করে মস্ত তেণতুলতলার পাশে কালীর মণ্ডপ তৈরি হত। রেল কোম্পানীর যত তেরপল, টিন, খুঁটি, রেলের স্লিপার সব জমা হত মণ্ডপের কাছে, বিশ ত্রিশজম রেলকুলি আসত, আর রেল-বাবুদের মধ্যে কয়েকজন কর্তাব্যক্তি দিবারাত্র পুজোর মণ্ডপ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। আমাদেরমানে বাচ্চাদের ওপর বার ছিল দুটি জিনিসের, লাল, নীল, হলুদ কাগজের পতাকা আর শিকলি তৈরি করা, আর পুজোর দিন রাস্তার গাছ থেকে দেবদারু পাতা এনে ফটক সাজানো। আজকাল বিজলা-বাতির কল্যাণে কাগজের সাজসজ্জা উঠে গেছে, তখন বিজলীবাতি সুলভ ছিল না, ব্যবস্থাও ছিল না বড়, কাজেই কাগজটাগজ, গাছের পাতা, ফুলটুলই ছিল আমাদের ঠাকুর সাজানোর উপকরণ। যতদূর মনে পড়ছেপ্রতিমার মণ্ডপেও বিজলীবাতি প্রথম প্রথম জোটেনি, পেট্রোম্যাক্স আর হ্যাজাকই ছিল আমাদের সম্বল। গোর অমাবস্যার অন্ধকার এতে কতটুকু দূর হত জানি না, তবে কালীর প্রতিমাটি হ্যাজাকের আলোয় উজ্জ্বল কালো হয়ে উঠত। আমাদের বাড়িতে বাড়িতে জ্বলত দেওয়ালির বাতি। মাটির প্রদীপ যে কত শত জ্বলত তার হিসেব নেই। রেল কোয়াটার্সের মাথা থেকে পাঁচিল, জানলা, সদরসর্বত্র আলোর শিখা কেঁপে কেঁপে আশ্চর্য সুন্দর এক আলোর মালা গেঁথে তুলত। প্রদীপ জ্বালানো এবং সাজানো আমাদের বালখিল্যদের, সবচেয়ে উদ্দীপনাপূর্ণ কর্ম ছিল। বাড়ির মেয়েদের কাজ ছিল সলতে তৈরি করা। আমাদের বাল্যসখীদের মধ্যে একজন তুলো দিয়ে একরকম করে সলতে পাকাত, বলত তার সলতে বেশিক্ষণ জ্বলে। আমরা সেটা কোনোকালে পরখ করে দেখিনি, কিন্তু তার হাতের কদর দিয়েছি। ফলে দেওয়ালীর আগে তার পা ভরি হত, চোখের চাউনি বদলে যেত। তবু একটা ফুলঝুরির বদলে তার কাছ থেকে আট দশটা সলতে পাওয়া যেত। এর সঙ্গে আমাদের ছিল বাজি পোড়ানোর ধূম। ফুলঝুরি, রংমশাল, তুবড়ি, চিনে পটকা, ছুঁচো বাজিএরাই ছিল বাজির বাজারে বালক-প্রিয়, মাঝে মাঝে দু-চারটে হাউইও এসে জুটত হাতে। অবশ্য বড়দের কেউ বোমাটোমা ছাড়াও অন্য রকম বাজি পোড়াতেন। তার মধ্যে তুবড়ি রকমারি ছিল। তবে একজন, নিজে মস্ত একজন সমজদার ছিলেন বাজির। তিনি অদ্ভুত অদ্ভূত বাজি পোড়ানো দেখাতেন। তার মধ্যে একটা বাজির কথা আমাদের মনে আছে: অন্ধকারে মস্ত এক আলোর বিশাল প্রজাপতি একবার জ্বলে উঠে ছাই হয়ে গিয়েছিল।

আমার বাবার কিছু শৌখিন শিল্পচর্চা ছিল: তার মধ্যে একটা ছিল দেওয়ালীর সময়ে চীনে লণ্ঠন তৈরি করা। আমরা বলতাম ফানুস। বাবা দেখেছি রঙীন কাগজ, কঞ্চি, আঠা, পেস্টবোর্ড আর টিনের অল্প-স্বল্প পাত নিয়ে ফানুস তৈরী করতে বসতেন, আট দশটা তৈরীও করতেন, ভেতরে মোমবাতি দিয়ে জ্বালাতাম।

তখন দেখেছি, আমাদের ওদিকে দেওয়ালীর দিন নানান রকম চিনির রঙীন মণ্ডা বাজারে মেলার মতন সাজিয়ে বিক্রী করা হত। সেই সঙ্গে মাটির রঙীন পুতুল, ছোট ছোট হাঁড়িকুড়ি, নানান ধরণের খেলনা। বেহারীদের মধ্যে এ-সবের খুব চল ছিল।

কালীপুজো আর দেওয়ালীতেই আমাদের পাড়ায় যাত্রার আসর বসত। কোনো কোনোবার দেরীও হত। যাত্রার আসরটি আমাদের ওখানে এমন সুন্দর করে সাজানো হত যে মনে হত রাজবাড়ির চাঁদোয়ার তলায় বসে আছি। শীত পড়ে আসছে বলে মাথার ওপর সামিয়ানা, তেরপল ইত্যাদি এমন পরিপাটি করে টাঙানো হত যাতে বাড়ির মেয়ে বউ, বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়োদের কারও না ঠান্ডা লাগে, হিম লাগে। মেয়েদের বসার জায়গায় চিক থাকত। যাত্রা আমাদের নাওয়া-খাওয়া কেড়ে নিত। ভাল ভাল পালাও দেখেছি সে সময়, ‘শ্রীচরণ ভাণ্ডারী’, ‘গণেশ অপেরা’র তখন প্রচণ্ড নামডাক, দুই ফণীবাবু, উপেন পাণ্ডাএঁদের অভিনয়ও দেখেছি। সেদিন এসব ছিল কত আনন্দের আজ বোঝানো মুশকিল। একমাত্র দুঃখ ছিল কালীপুজোর পর পরই অ্যানুয়েল পরীক্ষা আসত। সেই ভয়টা সবসময় বুকের কাছে দুলত যেন।

রেলশহরের এই কালীপুজো আর দেওয়ালীর পর দেখেছি কোলিয়ারীর কালীপুজো। কয়লাকুঠিতে কালীপুজোর আলাদা একটা চেহাড়া আছে। ভয়ভক্তি অবশ্যই এখানে দেখেছি, তবে এই পুজো অনেকটা খাদ্যমদ্যপ্রধান আর যাত্রাথিয়েটারের সঙ্গে জড়ানো। কয়লাকুঠির কালীপুজোয় পয়সার অভাব হয় না, কোম্পানী দেয়, বাবুরা দেয়, কাজেই পুজোটা হয় জমজমাট। অর্থাৎ উপচারের অভাব হয় না, আলো-টালো চোখ ধাঁধিঁয়ে দেয়, মণ্ডপের চেহারাটাও হয় বিয়ের আসরের মতন। কিন্তু আমি যেটুকু দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে লুচিমাংস মদ্য এবং যাত্রার আসরে হুল্লোড়টাই এখানে বেশী। অবশ্য কয়লাকুঠির জীবনে এ-রকম রাজসিক ভাব তখন স্বাভাবিক ছিল।

আর দেওয়ালী দেখেছি বেনারসে। বাঙলা দেশের দেওয়ালী ঠিক দেওয়ালী নয়, তাকে কালীপুজো বলাই ভাল, দেওয়ালী বাঙলার বাইরেউত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এইসব জায়গায়। কাশীতে থাকার সময় দেওয়ালী দেখে আমার মনে হয়েছে, এই উৎসবটা এদের মধ্যে রীতিমত বড়, আমাদের কাছে যেমন দুর্গোৎসব। দেখতে বেশ লাগে। সত্যি, সাজসজ্জায়, আলোকে, জমকে এমন দেওয়ালী বাঙলা দেশে বড় দেখা যায় না। যতদূর শুনেছি, দেওয়ালীতে এঁদের কিছু কিছু সামাজিক আচার পালন করা হয়। আমার অফিসের দুই অবাঙালী বন্ধু আমাকে একবার দেওয়ালীর দিন এক জায়গায় ধরে বেঁধে নিয়ে যায়, নিয়ে গিয়ে জুয়া খেলতে বসিয়ে দেয়। একেবারে সর্বসান্ত হয়ে যখন কাঁদো কাঁদো মুখ করে উঠে পড়ছি বন্ধু শ্রীবাস্তব হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে বলল, “আরে ইয়ারা, ভাগো মাত্, সিট ডাউন্।” বলে সে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে সান্ত্বনা দিল, দেওয়ালীতে যে জুয়ো খেলে না সে লছমীর কৃপা পায় না।….. তা শ্রীবাস্তব ঠাট্টাই করে থাক আর যাই করে থাক দেওয়ালীর দিনে জুয়ো খেলার খুব দাপট দেখতাম। রাস্তাঘাটেও চলত নাকি। শুনেছি, এইদিন কোতোয়ালির পুলিশ জুয়াড়ীদের ধরে না, বাড়িতে মেয়ে-বউরাও আচার হিসেবে দুহাত জুয়া খেলে নেয়। তা মোটামুটিভাবে দেখেছি, দেওয়ালীর বেশ একটা জমক আছে এদিকে।

কলকাতা শহরের কালীপুজো আর দেওয়ালীর কথা না বললাম, কলকাতাবাসী মাত্রই জানেন।

এ-সবের মধ্যে একজনের কথা আমার মনে পড়ে। আমাদের সেই ছেলেবেলার রেল-শহরে এক প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন, ধর্মভীরু, মুখে মস্ত দাড়ি ছিল, আমরা বরাবর তাঁকে ‘দাদু’ বলে এসেছি। ইনি খুব ভাল ধর্ম-সঙ্গীত গাইতে পারতেন, বিশেষ করে শ্যামাসঙ্গীত। রামপ্রসাদের গান তাঁর গলায় প্রায় লেগেই থাকত। তিনি থাকতেন তাঁর ছেলের কাছে। থাকতেন বলা অবশ্য ভুল হল, মাঝে মাঝে থাকতেন, মাঝে মাঝে কোথায় যেন চলে যেতেন, অনেকদিন তাঁর খবর পাওয়া যেত না। আবার হঠাৎ ফিরে আসতেন। আমাদের খুব ভালোবাসতেন।

একবার কালীপুজোর সময় দাদু ছিলেন। পুজোর দিন তাঁকে মণ্ডপেও আমরা দেখেছি। কালী-সাধক দাদু, পুজোপাঠ সাঙ্গ হবার পরও তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন শেষ রাতে। তারপর ভোর রাতে গায়ে মোটা চাদর জড়িয়ে পায়ের খড়মে শব্দ তুলে আপনমনে গান গাইতে গাইতে তিনি গৃহত্যাগ করেন।

পরেরদিন মাঠের দিকে ছোট রেল-লাইনে দাদুর ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া যায়, রেলে কাটা পড়েছেন। তাঁর পায়ের দিকটা নাকি সবটাই কাটা গিয়েছিলমুখ মাথা অক্ষত ছিল, পাথরের আঁচড়ে যেটুকু লাগার সেটুকু অবশ্য বাদ দিয়ে।

কে একজন তখন বললেন যে, ভোর রাতে দাদু যখন চলে যাচ্ছিলেনতখন তিনি নাকি গাইছিলেন:
‘‘আমার মন ঘুমাল মায়া ঘুমে,
বলো কিসে চেতন করি...’’


দাদু যে কাকে মায়া ঘুম বলেছিলেন তখন আমাদের বোঝার বয়স নয়, বোঝার চেষ্টাও করিনি। আজও যে বুঝি তাও হয়ত নয় তবু কালীপুজো আর দেওয়ালীর স্মৃতির সঙ্গে দাদুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে।




ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.