“তাঁহার (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ) শ্রীমুখে শুনিয়াছি, এই সময়ে একদিন তিনি জগদম্বাকে গাম শুনাইতেছিলেন, এবং তাঁহার দর্শনলাভের জন্য নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া প্রার্থনা ও ক্রন্দন করিতেছিলেন। বলিতেছিলেন, “মা এত যে ডাকছি, তার কিছুই তুই কি শুনছিস না? রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, আমাকে কি দেখা দিবি না?” তিনি বলিতেন ‘মার দেখা পাইলাম না বলিয়া তখন হৃদয়ে অসহ্য যন্ত্রণা। জলশূন্য করিবার জন্য লোকে যেমন সজোরে গামছা নিঙড়াইয়া থাকে, মনে হইল হৃদয়টাকে ধরিয়া কে যেন তদ্রূপ করিতেছে। মার দেখা বোধহয় কোন-কালেই পাইব না ভাবিয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিতে লাগিলাম। অস্থির হইয়া ভাবিলাম, তবে আর এ-জীবনে আবশ্যক নাই। মার ঘরে যে অসি ছিল দৃষ্টি সহসা তাহার উপর পড়িল। এই দন্ডেই জীবনের অবসান করিব ভাবিয়া উন্মত্তপ্রায় ছুটিয়া উহা ধরিতেছি এমন সময়ে সহসা মা’র অদ্ভুত দর্শন পাইলাম ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম। তাহার পর বাহিরে কী যে হইয়াছে, কোন্দিক দিয়া সেদিন ও তৎপর দিন গিয়াছে তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই। অন্তরে কিন্তু অননুভূতপূর্ব জমাট-বাধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত ছিল, এবং মার সাক্ষাৎ প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছিলাম।
পূর্বোক্ত অদ্ভুত দর্শনের কথা ঠাকুর অন্য একদিন আমাদিগকে এইরূপে বিবৃত করিয়া বলেন ‘ঘর , দ্বার, মন্দির সব যেন কোথায় লুপ্ত হইল কোথাও যেন আর কিছুই নাই। আর দেখিতেছি কি, এক অসীম অনন্ত চেতন জ্যোতি সমুদ্র! যেদিকে যতদূর দেখি চারদিক হইতে তার উজ্জ্বল উর্মিমালা তর্জন-গর্জন করিয়া গ্রাস করিবার জন্য মহাবেগে অগ্রসর হইতেছে। দেখিতে দেখিতে উহারা আমার উপর নিপতিত হইল এবং আমাকে এককালে কোথায় তলাইয়া দিল। হাঁপাইয়া, হাবুডুবু খাইয়া সংজ্ঞাশুন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম।’
এইরূপ প্রথম দর্শনকালে তিনি চেতন জ্যোতি-সমুদ্রের দর্শনলাভের কথা আমাদিগকে বলিয়াছিলেন। কিন্তু চৈতন্যঘন জগদম্বার বরাভয়করা মূর্তি? ঠাকুর কি এখন তাঁহারও দর্শন এই জ্যোতিসমুদ্রের মধ্যে পাইয়াছিলেন? পাইয়াছিলেন বলিয়াই বোধ হয় কারণ শুনিয়াছি, প্রথম দর্শনের সময়ে তাঁহার কিছুমাত্র সংজ্ঞা যখন হইয়াছিল তখন তিনি কাতর কন্ঠে ‘মা, মা’ শব্দ উচ্চারণ করিয়াছিলেন।’
|