৩ কার্তিক ১৪১৮ শুক্রবার ২১ অক্টোবর ২০১১





বাংলার কালী-আরাধনার দুই রূপ




“আমার কালী-মা কোথায় গেলে গো”রামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর শিশুর মত কেঁদে উঠলেন সারদামণি। কালী আর রামকৃষ্ণ তাঁর কাছে অভিন্ন। কালী কালী অজপার মধ্য দিয়ে রামকৃষ্ণ কালী হয়ে উঠলেন। ইষ্ট আর ভক্ত এক। সন্তানের বশীভূত জননী। মায়ের সঙ্গে কখনো মান-অভিমানের পালা, কখনো বা নিঃশেষ আত্ম-সমর্পণের শান্ত মূহুর্ত, কখনো রাগ, কখনো রফা, কখনো কান্না, কখনো জবরদস্তি, কখনো দীনতা, কখনো অহঙ্কার, কখনো দাস্য, কখনো প্রভুত্ব। ভক্তির কাছে জননীর বশ্যতা স্বীকার। সন্তানকে চোখে-চোখে রাখা, ঘিরে থাকা। ভক্তের আবদার রাখতে গিয়ে অঘটনপটীয়সীর নানা খেলা।

রামপ্রসাদের বেড়া বেঁধে দিয়ে গেলেন কালী। মায়ে-ছেলের লুকোচুরি খেলা। মা ছাড়া আর কিছু নেই ছেলের কাছে। যত ওজর-আপত্তি-নালিশ সব মায়ের কাছে। আবার অভিযোগ, প্রচণ্ড অভিমানদ্বারে দ্বারে যাব ভিক্ষা মাগি খাব, মা মলে কি তার সন্তান বাঁচে না।” মন্ত্র নয়, আচার-অনুষ্ঠান নয়, যাগ-যজ্ঞ কিছুই নয়শুধু মাকে মায়ের মত করে পাওয়ার ব্যকুলতা, মুখে শুধু ‘মা’ ‘মা’। মাতৃসাধনার এই গোড়াপত্তন প্রথম দেখি কমলাকান্তে। রামপ্রসাদের মধ্যে দেখি এই সহজ সরল দিব্যসাধনার পরিপূর্ণ রূপে।
মায়ে পোয়ে মোকদ্দমা,
ধূম হবে রামপ্রসাদ বলে।
আমি ক্ষান্ত হব যখন আমায়
শান্ত করে লবে কোলে।
কালীভাবনায় সারা দেশ ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন রামপ্রসাদ। ক্ষেত্র বুঝি তৈরি হল। রামকৃষ্ণ এলেন। অবতার আসবার আগে যেমন আসেন পূর্বসাধক, ভবিষ্যৎ আধ্যাত্মিক বিপ্লবের জীবন্ত ভূমিকা হয়ে। কমলাকান্ত ও রামপ্রসাদের কালী করালী নন, করুণাময়ী। রামকৃষ্ণের কালী ভবতারিণী। তাঁর তপস্যার মধ্য দিয়ে বাঙালী কালীসাধনার অভিনব বেদ রচিত হল।

রামকৃষ্ণ কালীময়। তাঁর শক্তির আধার বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দের সাধনার ভিতর দিয়ে ভবতারিণী বাংলার অসংখ্য বীর বিপ্লবী তরুণের মনে প্রলয়ঙ্করী মহাকালী রূপে আবির্ভূতা হলেন। বিবেকানন্দের বাণীতে তাঁরা উদ্দীপ্ত“মাকে বুকের রক্ত দিয়ে পুজো করতে হয়, তবে যদি তিনি প্রসন্না হন। মার ছেলে বীর হবে, মহাবীর হবে। নিরানন্দে দুঃখে মহালয়ে মায়ের ছেলে নির্ভীক হয়ে থাকবে।

তরুণ হৃদয়ে সাধনার ধারা পালটে গেল। বাংলায় কালীশক্তি জাগ্রত হল। কী সেই শক্তির প্রকৃতি?

শ্রীঅরবিন্দের ভাষায় “ক্ষিপ্র, ঋজু, অকপট যে সকল প্রেরণা, অকুণ্ঠ অব্যভিচারী যেসব গতিধারা, অগ্নিশিখায় ঊর্ধ্বগামী যে অভীপ্সাতাই মহাকালীর পদক্ষেপ। অদম্য তাঁর প্রবৃত্তি, তাঁর দৃষ্টি, তাঁক সংকল্প শ্যেনপক্ষীর ব্যোমবিহারের মত উত্তুঙ্গ দূরপ্রসারী, ঊর্ধ্বপ্রসারিত পথে ক্ষিপ্র তাঁর গতি, হস্ত তাঁর প্রসারিত দণ্ডবিধানের জন্যঅভয়প্রদানের জন্য। কারণ তিনিও মাতাঁর স্নেহ তাঁর ক্রোধেরই মত তীব্র, তাঁর কারুণ্য সুগভীর, আবেগ-আপ্লুত। আপন শক্তিতে তিনি যদি নেমে আসতে পারেন, তবে যেসব বাধা আমাদের চলৎশক্তিহীন করে রাখে, দস্যু যারা অন্বেষুকে আক্রমণ করে, তারা সংহতি-বিহীন বস্তুর মত এক মূহুর্তে চূর্ণ হয়ে যায়।

বাংলার রক্তক্ষরা বিপ্লব ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হয়ে উঠলেন মহাকালী। তাঁর সমগ্র ভাগবতী প্রকৃতি ঝঞ্ঝারুদ্র কর্মের প্রভায় প্রস্ফুরিত, তিনি রয়েছেন ক্ষিপ্রতার জন্য আশফুলদায়ী প্রক্রিয়ার জন্য, সাক্ষাৎ সঘন আঘাতে সব পরাভূত করে সম্মুখ আক্রমণের জন্য (শ্রীঅরবিন্দ)। অভয়ের ভগবতী মূর্তি রূপে মহাকালী বাংলার যুবসমাজের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেন। কালী অনুধ্যান কালানলের মত জ্বলে উঠল। বাংলার কালীসাধনার নতুন মহিমা প্রকাশ পেল। আদ্যাশক্তি মহামায়া বীর সন্তানের কাছেও ধরা দিলেন। বাংলার এই বীরভাবের সাধনার রূপটি বিবেকানন্দের কথায় ফুটে উঠেছে— “যাঁরা প্রকৃত মায়ের ভক্ত, তাঁরা পাথরের মত শক্ত, সিংহের মত নির্ভীক। মাকে তোমার কথা শুনতে বাধ্য কর। তাঁর কাছে খোসামোদ কি? জবরদস্তি। তিনি সব করতে পারেন।” বীরসাধনার অন্য পরিচয় দেখি বিবেকানন্দের কবিতায়
রে উন্মাদ, আপনা ভুলাও, ফিরে নাহি
চাও, পাছে দেখ ভয়ঙ্করা।
দুখ চাও, সুখ হবে বলে, ভক্তিপূজাছলে
স্বার্থ-সিদ্ধি মনে ভরা।
ছাগকণ্ঠ রুধিরের ধার, ভয়ের সঞ্চার
দেখে তোর হিয়া কাঁপে
কাপুরুষ! দয়ার আধার! ধন্য ব্যবহার
মর্মকথা বলি কাকে?


বাংলার কালী মমতাময়ী, মুণ্ডমালিনী। স্নেহময়ী, ভয়ঙ্করী। প্রসন্না, ভ্রকুটিকুটিলা। সন্তানবৎসলা, বীরের আরাধ্যা অসুরদলনী।




ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.