|
“আসীদিদং তমসা গূঢ়ং অগে”
সৃষ্টির পূর্বে এই পরিদৃশ্যমান জগৎ তমসার দ্বারাই আবৃত ছিল। “আসীদিদং তমোভূতং অপ্রজ্ঞাতং অলক্ষণম”
এই জগৎ পূর্বে অপ্রকাশশীল নিরাকার অবস্থায় অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। কোনও বস্তু যখন প্রকাশিত হয় এবং আকৃতিবিশিষ্ট হয় তখনই তাহা আমাদের দৃষ্টিপথে আসে। তখনই আমরা তাহাকে নাম ও রূপে অভিহিত করি। সৃষ্টির পূর্বাবস্থায় এই জগতের সমস্ত কার্যদ্রব্য স্বকারণ প্রকৃতিতে লীন অবস্থায় ছিল আবার কারণের প্রকাশশীল অবস্থায় তাহা বিভিন্ন রূপে জন্মগ্রহণ করিল মাত্র। কোন নূতন বস্তুর উদ্ভব হয় না, কারণে নিহিত শক্তিই বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়। এইরূপেই কার্য ও কারণের অভেদ এবং জগতের মূল কারণের একত্ব সমর্থিত হয়।
উপনিষদবাদী ঋষিরা ঐ কারণ অবস্থাকেই ‘তমঃ’ শব্দ দ্বারা বুঝাইতে চাহিয়াছেন। সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার এই তিন ক্রিয়ারই অব্যক্ত রূপ ঐ অন্ধকার। ঐ অন্ধকার আলোর অভাব নহে, জগতেরই অপ্রকাশিত অবস্থা। তাই সেখানে জাগতিক জ্যোতি না থাকিলেও আলোর অভাব নাই—
ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্র তারকে, নেমা বিদ্যোতে ভান্তি কুতোয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বম্
তস্য ভার্সা সর্বমিদং বিভাতি।
সেখানে সূর্য প্রকাশিত হয় না, চন্দ্র তারাও সেখানে নাই, বিদ্যুৎ অগ্নি প্রভৃতি জ্যোতিষ্মান কিছুই নাই, কিন্তু এমন এক জ্যোতি আছে যাহার প্রকাশে সূর্যচন্দ্রাদি সকলেই জ্যোতিষ্মান হয়, তাহার আলোয় সমস্ত জগৎ আলোকিত হয়। এই-ই সেই পরমজ্যোতি যাহাকে গায়ত্রী মন্ত্রে ‘তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গ’ জগৎপ্রসবিতার বরণীয় তেজ বলিয়া ঋ
ষিরা বলিয়া গিয়াছেন। ঐ তেজোময়ী শক্তিই তন্ত্রে কালীরূপে কীর্তিতা হইয়াছেন।
উপাসনার পদ্ধতি উপাসকের মানসিক অবস্থা, তাহার পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রভৃতির উপর অনেকাংশে নির্ভর করে, বাহ্যিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবজগতেও কতকটা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়ে। তাই উপাসনার বিভিন্ন পদ্ধতিতেও ইহার পরিচয় দেখিতে পাওয়া যায়। বৈদিক যাগযজ্ঞাদির মধ্যে সাধারণের কোন স্থান ছিল না।, সাধারণত ব্রাহ্মণেরাই তাহার ধারক ও বাহক ছিলেন। মুষ্টিমেয়ের সমাজে তখন বর্ণ আশ্রমের গণ্ডীর সার্থকতা ছিল। বৃত্তি-সাংকর্যের ফলে জীবিকা নির্বাহে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীতা দেখা যাহাতে না দেয় তখনকার সমাজকর্তাদের সেদিকেও জাগ্রত ছিল। তাই এই অবস্থায় কোন অসুবিধা দেখা দেয় নাই। কিন্তু কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন বিজিত জাতি ও উপধর্মের প্লাবন সে ব্যবস্থাকে তীব্র আগাত হানিল। ফলে বাধ্য হইয়াই পূর্বতন সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যাগযজ্ঞাদিও বিভিন্ন রূপে নূতনবাবে পরিবর্তিত হইতে লাগিল। ফলে বৈদিক সাধনার বিশিষ্ট অংশই পৌরাণিক ও তান্ত্রিক সাধনার রূপ পরিগ্রহ করিল। তারপর নান উপধর্মের সঙ্গে মৈত্রী এবং বিশেষ করিয়া বৌদ্ধতন্ত্রধর্মের সম্মেলনে সে সাধনার পথ সাধারণের মধ্যেও নিজেকে বিস্তৃত করিয়া দিল। বৈদিক হিমগিরি হইতে জ্ঞানসাধনার পূত জাহ্নবীধারা বিভিন্ন ধর্ম ও ব্যবহারের সংগাতে বিস্তৃতিলাভ করিয়া নদী যেমন উপ ও শাকানদীগুলিকে কুক্ষিগত করে সাগরে স্থিতিলাভ করিল। গঙ্গাসাগরসঙ্গমের গঙ্গা দেখিয়া যেমন গঙ্গোত্রীর গঙ্গার কল্পনা করা দুরূহ, তেমনি বর্তমান উপাসনা পদ্ধতির বিবর্তিত রূপ দেখিয়া বৈদিক সাধনার রূপ কল্পনা করাও সাধারণের পক্ষে অসম্ভব। পরিবর্তিত সাধনধারার মধ্যে যে ঐক্যসূত্র রহিয়াছে তাহা উহার পদ্ধতি পর্যালোচনা না করিলে কিছুতেই বুঝিতে পারা যায় না। বিশেষ করিয়া তান্ত্রিকসাধন পদ্ধতিতে উপনিষদ যুগের অদ্বৈতবাদই বিভিন্ন মূর্তিতে প্রতিভাত ও আরাধিত হয়। বিভিন্ন সাধনপদ্ধতি আলোচনা করিলে
‘রুচীনাং বৈচিত্র্যাং ঋজুকূটিল
নানাপথজুষাং
নুণামেকো গম্যাস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব’
রুচির বৈচিত্রবশত সহজ ও বহুবিঘ্ন সমন্বিত পথে যেবাবেই তোমাকে যে ডাকুক শেষ পর্যন্ত সরল ও বক্রগতি সমস্ত নদীর শেষ গতি যেমন সমুদ্র তুমিই সকলের শেষ গতি ইহাই প্রতিভাত হয়।
বৈদিক যুগের ‘তমঃ’, পৌরাণিক যুগে ‘তামসী’ এবং তন্ত্রে কালী নামে পরিবর্তিত হইয়াছেন। পুরাণের চণ্ডীতে দেখা যায়, মধুকৈটভ বধের জন্য বিষ্ণুর যোগনিদেরা ভঙ্গ করিতে ব্রহ্মা ‘তাপসী’ দেবীর আরাধনায় ব্রতী হন। সেই দেবীই মহিসাসুর ও শুম্ভনিশুম্ভের নিধন করিয়া দেবতা ও মানুষকে রক্ষা করেন। ইনি নিত্যা হইলেও দেবগণের কার্যসিদ্ধি ও সাধুদের পরিত্রাণ ও দুষ্কৃতি বিনাশের জন্য বিভিন্ন রূপে আবির্ভূতা হন। চণ্ডীতে মেধসমুনির মুখে শুনিতে পাই—
‘নিত্যৈর সা জগন্মূর্তিস্তয়া
সর্বামদং ততং
তথাপি তৎসমূৎপত্তির্বহুধা
শ্রূতয়াং মম’
এই চরাচরব্যাপিনী দেবী নিত্যা হইলেও তিনি জগৎরূপিণী হইলেও এই জগতের মধ্যেই দেবগণের কার্যসিদ্ধির জন্য আবির্ভূতা হন, তখনই তাহাকে আমরা ‘উৎপন্ন’ বলিয়া মনে করি। সেই উৎপত্তির কথাই আমি তোমাদিগকে বলিব। এই দেবীরই এক মূর্তিকে শারদীয় দুর্গারূপে পূজা করা হইয়াছে আজ তিনিই আবার কালীরূপে দীপান্বিতা-ময়ী হইয়া সন্তানের অঞ্জলী গ্রহণ করিতে আসিয়াছেন।
বৈদিক যুগে মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল না তাই দেখিতে পাই তন্ত্রে ও পুরাণে ‘সাধনাকাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা’ সাধকদের সাধনার উপযোগী বলিয়া অরূপ ব্রহ্মেরও রূপ কল্পিত হইয়াছে।
আমাদের সসীম মন অসীমের দিকে ছুটিয়া গেলেও কোন আশ্রয় না পাইয়া ফিরিয়া আসে। সে নিজের আবেষ্টনীর মধ্যেই প্রিয়কে পাইতে চায়। ‘অবাঙ্ মানসগোচরং’ বাক্য ও মনের অতীত বস্তু যাহা সম্পূর্ণ ধরা ছোঁয়ার বাহিরে তাহা নিয়ে নিয়া সে তৃপ্ত হইতে পারে না। তাই ব্রহ্মতত্ত্ব-অদ্বয়-তত্ত্বকে মনের গণ্ডীর ভিতর আনার জন্য, এমনি প্রিয়ের স্পর্শে আলাপে যে গভীর আনন্দ তাহাই উপলব্ধি করার জন্যও মূর্তিকল্পনার প্রয়োজন আছে। যে যেভাবে প্রিয়কে চায় প্রিয় সেই মূর্তিতেই তাহার নিকট আসিয়া দেখা দেয় ইহাই বিভিন্ন মূর্তি কল্পনার কারণ। প্রতি বস্তুতেই পরম্পরাসূত্রে আগত সেই মহান সত্তার প্রকাশ হয় ইহা সর্বসম্মতবাদী সিদ্ধান্ত। সুতরাং যেভাবেই যে উপাসনা করুক না কেন মনে সেই অদ্বয়তত্ত্বের লক্ষ্য থাকে, ফলে তাহার অর্ঘ্য সেই পরমপদেই স্থান লাভ করে। দেবতা ভাবময়ী। ভাব বা চিন্তাধারা গাঢ় হইলে তাহাই শরীর ধারণ করে, তখন ধোয় ও ধ্যানের দ্বৈতবোধ আর থাকে না। সাধকের মনে যে ভাবের মূর্তি প্রতিফলিত হয় সে ভাবকেই তিনি ধ্যানে রূপচিন্তায় রূপায়িত করিয়া তাহাকে উপাসনার উপদেশ দিয়া থাকেন। পথ ও মতের বিভিন্নতা থাকিলেও তাই তাহা পরস্পরের পরিপন্থী নহে, কারণ জ্ঞানীরা জানেন, ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়’ আর পথ নাই।
মাতৃভাবে সাধনই শাক্ততন্ত্রের বিশেষ প্রতিপাদ্য। মা-ই আমাদের জীবজগতে সর্বাধিক আশ্রয়, সন্তানের জন্য এত দুঃখ বেদনা সহ্য করার শক্তি আর কাহারও নাই, আবার সন্তানের প্রতি ক্রুদ্ধ হইলেও তার দুঃখে এমন দুঃখ বোধ আর কেউ করে না। যথেচ্ছচারী বিপতগামী সন্তানও যদি অনুতাপে জর্জরিত হইয়া মা মা বলিয়া কোলে ঝাঁপাইয়া পড়ে তিনি বেশীক্ষণ মুখ ফিরাইয়া থাকিতে পারেন না। সন্তানকে দুই বাহু মেলিয়া কোলে নেন উভয়ের অশ্রুজলে সে মিলন মধুময় হয়। বিরূপ মায়ের কঠোর গাম্ভীর্যের গণ্ডী ভাঙ্গিয়া মাতৃনির্ভর না হইতে পারিলে কিন্তু তাহারই আশ্রয় লাভ ঘটে না। অনুতাপ না আসিলে কিন্তু ভয়ে মায়ের কাছে আমরা ছুটিয়া যাইতে পারি না। সাহসী হই না। তাই মা-ও সাদরে কোল দিতে পারেন না। মাতৃহৃদয় স্নেহদানে উন্মুখ, তার স্তন্য বর্ষোণোন্মুখ কিন্তু তাহা লাভের জন্য যে সাহস প্রয়োজন তাহা আমাদের সহজে আসে না। ভীতির আগল না ভাঙ্গিলে ভয়হারিণীর কোল পাওয়া যায় না। কালীসাধকের হৃদয় যখন মাতৃপ্রেমে র্পূণ হয় তখনই সে আকুলভাবে তাহার দিকে ছুটিয়া যায়, অমানিশার ঘোর অন্ধকার, শ্মশান, আতঙ্কিত শিবাকূলের চিৎকার কিছুই তাহাকে বাধা দিতে পারে না, ‘কালরাত্রিমহারাত্রির্মোহ রাত্রিশ্চদারুণা’ মায়ের কোল তাহার জন্য প্রসারিত হয় সে মা বলিয়া ঝাপাইয়া মায়ের পদতলে পতিত হয়। সে বলিয়া উঠে এ অন্ধকার নয়, কালী কালো নয় এযে ‘আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ’ তমসার অন্তরালে মায়ের জ্যোতির্ময়ী মূর্তি।
|
|