৩ কার্তিক ১৪১৮ শুক্রবার ২১ অক্টোবর ২০১১





দেওয়ালি মানে ‘বাজিমাৎ’ নয়




অবসিত শরৎ আর সমাগত হেমন্তের সন্ধিলগ্নে ভূত-চর্তুদশীর তমসাকীর্ণ রাত। নিরন্ধ্র অন্ধকারে পৃথিবী অবলিপ্ত। অকস্মাৎ সেই অন্ধকারের কঠিন বুকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল একটি স্বর্ণদূত্যি আলের কোরক। জনশ্রুতি বলে-ঐ বিশেষ তিথিতেই রাক্ষস বংশের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রাম শেষ করে রামচন্দ্র অযোধ্যায় এসে পৌঁছান। সীতার জীবনে মহা অমানিশার অবসান হল এক অসিতকায় অমাবস্যার রাতে ; তারই আনন্দে তিনি অন্ধকারের বুকে স্থাপন করলেন একটি সুরচিত স্বর্ণ শিখা দীপ। অযোধ্যার জনপদ বধূরা সীতার আনন্দে অংশভাগিনী হলেন: প্রতিটি গৃহশীর্ষে, প্রতিটি প্রান্তে প্রান্তরে সেদিন আলোকমালার আনন্দিত প্রজ্বলন। সেই আনন্দের স্মৃতি বহন করেই ভারতবাসীর জীবনে কার্তিক মাসের কৃষ্ণকায়া রাত্রি হয়ে উঠলো আলোরশরীরিণী-তমস্বিনী হল দীপান্বিতা।
পরিবর্তমানতাই সময়ের স্বভাব। সচল সময় উৎসবের আদলেও পরিবর্তণের স্পর্শ দিয়ে যায়। পৌরাণিক দীপান্বিতার সঙ্গে আধুনিক দেওয়ালীর ব্যবধান সত্যই দুস্তর। আজকের দিনে বাজির আগুনে অসংযত উল্লাসে, শঙ্কা জাগানো শব্দের তান্ডবে দীপান্বিতা তাই অনেকক্ষেত্রেই আলেক-সাধনা না হয়ে আগুন-মত্ততায় পর্যবসিত হয়।

প্রাচীন উৎসবের যুগোপযোগী নবায়ন স্বীকার্য, কিন্তু রূপান্তরের তাড়নায় উৎসবের প্রাণসত্তাকে বিনষ্ট করা কাজের কথা নয়। দীপান্বিতায় কেন ভারতের ঘরে ঘরে আলো জ্বালা হয় তার ব্যাখ্যা কেবল রামচন্দ্রের যুদ্ধ জয়ের কিংবদন্তীতেই নয়, আরও নানা কাহিনীতে ছড়িয়ে আছে। অনেকের বিশ্বাস-ঐ তিথিতে বালক শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে পৃথিবীকে ত্রাসমুক্ত করেছিলেন বলে ব্রজধামের ঘরে ঘরে দীপমালার সজ্জা রচিত হয়েছিল-দীপান্বিতা থারই অনুবৃত্তি। অনামতে, এই দিনে এই দিনেই রাজা বিক্রমাদিত্যের হাতে দেশবৈরী শকদের চূড়ান্ত পরাজয়ের সংবাদ উজ্জয়িনীতে পৌঁছায়, এ দীপশিখায় সেই আনন্দের স্বাক্ষর। আরও নানা কাহিনী জনরব দীপান্বিতা উৎসবের সঙ্গে অনুলিপ্ত হয়ে আছে।

বাংলাদেশের দীপান্বিতার তাৎপর্য আরও গভীর। এ দীপান্বিতা শুধু আলোর-ফুলঝুরি ছড়ানো নয়, দেওয়ালী আর কালীপূজার যুগ্ম অনুষ্ঠান। মৃত্যুর মধ্যে যে অমৃতের উদ্বোধন, সত্যের মধ্যে যে অসত্যের অভিভব-দেবী কালিকা তারই প্রতীক। বাঙ্গালী জনমানসে কালী চিরদিনই শক্তির দেবী। কালীসাধনার ভিন্ন নাম তাই শক্তিসাধনা। দীপান্বিতার তাৎপর্য আর কালীপূজার অভিপ্সা-এ দুইয়ের সম্মেলন সত্যিই সুন্দর। কিন্তু উৎসবের বাহ্য প্রকরণকে জনপ্রিয় আড়ম্বরকে অতি মাত্রায় আশ্রয় করলে দীপান্বিতা উৎসবের গূঢ় তাৎপর্য হয়ত পুরো-পুরিই ভুলে যাবো। অসংবত উল্লাসে বাজি পুড়িয়ে আমেদ করাই দীপান্বিতা নয়-দীপান্বিতা আপন শক্তির আলোকময় উজ্জীবনের সাধনা, বাইরের এবং অন্তরের সকল শত্রুকে নির্মুল করার কঠিন প্রস্তুতির লগ্ন-এ সত্য আর একবার স্মরণ করা দরকার।




ফিরে দেখা...

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.