|
আজ শ্যামাপূজার পূণ্যতিথি। দীপমালা জ্বলিয়া যাঁহার আগমনী সম্বর্ধনা জানাইয়াছি, যাঁহার পূণ্য আবির্ভাবে শারদোৎসবে মাতিয়াছি, সেই মা-ই আজ ভীষণ-সুন্দর মূর্তিতে সন্তান কোলে নিতে আসিতেছেন, মার্তৃমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ সাধক অমানিশার গাঢ় তমিস্রার অন্তরালে তাই মাতৃ-প্রতীক্ষায় আকুল।
‘নৈষা তর্কেণ মতিরাপনেয়া’।
মায়ের আজকের মূর্তি অনন্য সাধারণ। যে স্থান কাল ও পাত্রের পটভূমিতে সাধক মা-কে প্রতিফলিত করিয়াছে তাহা সত্যই অপূর্ব! পরস্পর বিরুদ্ধ সমাবেশের অভূতপূর্ব একাত্মতা চিত্তকে উদ্বেলিত করিয়া তোলে।
মায়ের পূজার কাল অমাবস্যার মহানিশা, স্থান প্রজ্জ্বলিত মহাশ্মশান। সাধারণের বোধগম্য যাহা কিছু ভয়ঙ্কর সবই যেন মাতৃপীঠের পটে সমাহৃত। এই পটভূমিকার সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়াই মায়ের মূর্তিতে ভীষণতার সমাবেশ করা হইয়াছে। শ্যামা করালবদনা ঘোরকৃষ্ণ আলুলায়িত-কুন্তলা দিগবসনা নরমুন্ড-মালিনী, তাহার কর্ণ-ভূষণ শিশুশবন্বর, কটিহার নরহস্ত, রুধিরপানে লালায়িত জিহ্বা সর্বদাই লক্লক্ করিতেছে, মুখনিঃসৃত আরাবে শশ্মানভূমি প্রকম্পিত, ঘোর গর্জন অমানিশার অন্ধকারকে আরও ভীষন করিয়া তুলিয়াছে, মা আমার শবরূপী মৃত্যুঞ্জয় মহাকালের বক্ষে নৃত্যপরায়না, চতুদিকে শ্মশাণ-সহচর শিবা-শকুনি প্রভৃতি দাহবিশিষ্ঠ নরমাংস ভক্ষণে রত। ভয়ঙ্কর সমাবেশে এ এক অপূর্ব কল্পনা, সাধারণ যাহাকে দূর হইতে কল্পনা করিতে অসমর্থ, সাধক তাহাকেই মা বলিয়া আহ্বান করিয়াছেন, ভীষনের মধ্যে অনন্ত সুন্দরের সমাধান পাইয়াছেন।
মাতৃভাবে সাধনার প্রথম বীজ ঋগ্বেদের দেবীসূত্রে দেখিতে পাওয়া যায়। তারপর অথর্ব বেদ এবং উপনিষদের যুগে সে বীজ অঙ্কুরিত হয়, তন্ত্রশাস্ত্রে ইহা পূর্ণতালাভ করিয়া বিরাট মহীরূহে প্রকটিত। তন্ত্রই এ সাধনার ধারক ও বাহক।
পূজোর স্থান
পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি দেশ ও কাল এমন ভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করিয়াছে, যাহাতে শুধু আবেষ্টনীর মধ্যেই মায়ের পূর্বক্তো রূপ ধ্যানীর সমাহিত চিত্তে ফুটিয়া উঠিতে পারে।
কালী শ্মশানবাসিনী। শ্মশানই জীবের শেষ আশ্রয়। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণে পরব্রহ্মেই মা সম্যসীনা তাই প্রলয়েও প্রলয়রূপিনীর ব্রাহ্মস্থিতি-লয়ের কারণে পরব্রহ্মেই মা সম্যসীনা তাই প্রলয়েও প্রলয়রূপিণার ব্রাহ্মিস্থতি। ব্রহ্মময়ী মায়ের আলোয়ও তাই শ্মশান। পুরাণে বলা হইয়াছে-
মহান্তপি চ ভূতানি প্রলয়ে
সমুপস্থিতে।
শেরতেছত্র শবংভূত্বা শ্মশানস্তু ততোভাবেৎ।
পূজার কাল
অমানিশার গাঢ় অন্ধকার, শ্মশান এবং কালীর মহামেঘ অর্থাৎ প্রলয়ঙ্কর বর্ষোণন্মুখ মেঘের ন্যায় প্রভাসমন্বিত রুপ- এই তিনের সংমিশ্রণ এক মহারহস্যের ইঙ্গিত। বেদে ও উপনিষদে সৃষ্টির পূর্বাবস্থা বর্ণনায় বলা হইয়াছে।‘ন সদাসীল্লাসদাসীত্তদানীং
কিং তম আসীং’
-ঋগ্বেদ
‘আসীদিদং তমসা গূঢ়মগ্রে।’
‘অসদেবেদমগ্র আসীৎ।’
‘আসীদিদং তমোভূতং
অপ্রজ্ঞাতমলক্ষম্।’
-উপনিষদ
সৃষ্টির পূর্বে এই জগৎ সৎ ছিল না, অসৎ ছিল না কিন্তু অন্ধকার দ্বারা আবৃত্ত ছিল।
এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে তমের দ্বারা গুপ্ত ছিল। এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অন্ধকারাচ্ছন্ন, অজ্ঞাত এবং লক্ষণশূন্য ছিল।
অমানিশার অন্ধকার ঐ সৃষ্টির পূর্বাবস্থার তমসাচ্ছন্ন ভাবের দ্যোতক। পূর্বেই বলিয়াছি ধ্বংস বা লয় শুধু নাশই নহে ইহা সৃষ্টিরও কারণ, কালীর এই পটভূমিকা মহানিশার শেষ অর্থাৎ প্রলয়ের শেষ এবং সৃষ্টির অন্তরালবর্তী অবস্থাতেই পরিস্ফুট করিয়াছে। ইহার পরই আরম্ভ হইবে নূতনতর সৃষ্টি। তাই মা আমার শুধু অন্তকারিণীই নহেন তিনি সৃষ্টিকার্যেরও জননী। চান্দ্রমাস গণনার অমাবস্যাই মাসের শেষ তিথি। ইহা দ্বারাও প্রলয়ের শেষ অবস্থার কথা বলা হইয়াছে। ধ্বংসের বুকে দাঁড়াইয়া প্রলয়নৃত্যের তালে তালে মা আমার নবসৃষ্টির উন্মাদনায় কম্পমানা। ‘এজতি’ শব্দ দ্বারা উপনিষদে এই অবস্থারই ইঙ্গিত করা হইয়াছে। সৃষ্টির আদিক্রিয়া গতি-শীতলতার তত্ত্বও এখানেই সমাহিত। স্থানকালের পরিবেশে মায়ের মূর্তিটিও কম্পিত হইয়াছে। ইহা পূর্বেই বলিয়াছি। ঐ রূপতত্ত্বের আলোচনায় প্রথমেই দেখি মায়ের কালো রূপ দেবী পক্ষের ঊষার মাকে একরূপে ঘর আলোময় করিতে দেখিয়াছি-আজ আবার অনারূপে তাঁহাকে দেখিতেছি। এই কালো রূপ সর্ববর্ণেরই লয়স্থান এবং স্থিতিস্থান; বর্ণসমাবেশে যাঁহারা দক্ষ তাঁহারাই জানেন কালো রংএর উপর সব রংই ফুটিয়া উঠিতে পারে, সুতরাং কালো রংকে সব রংএর ধ্বংস ও উৎপত্তি স্থান বলা অন্যায় নহে।
‘সাধক’ যখন রূপাতীত অবস্থায় পৌঁছেন, তখনই মায়ের ঐ রূপাতীত রূপ দর্শন করিতে পারেন। মা আবার দিগ্বসনা, বস্ত্রমাত্রই আবরক বা আচ্ছাদক, জগতে এমন কোন কিছুই নাই যাহা মাকে আবৃত করিতে পারে। মা বিশ্বসংহারিণী বিশ্বসৃষ্টিপালনকারিণী সুতরাং তিনি বিশ্বাতীতা। আকাশই জগতের আবরণ-আকাশই বিভিন্ন ভাবে বস্তুর আত্মপ্রতিষ্ঠার একমাত্র কারণ। ইহা সর্বব্যাপী সুতরাং সর্বব্যাপিনী মা ঐ আকাশকেই আবরণস্বরূপ কল্পনা করিয়াছেন।
মা আলুলায়িতকুন্তলা রন্ধনহীনা। সাধকের কর্মবন্ধ বিনাশ হইলেই তবে মাকে পাওয়ার যোগ্যতা আসে, উপনিষদেও উক্ত হইয়াছে:
‘ভিদ্যন্তে হৃদয় গ্রন্থিশ্ছিন্দন্তে সর্বসংশয়াঃ
ক্ষীয়ন্তে তস্য কর্মাণি
তস্মিন দৃষ্টে পরাবরে।’
ঐ বন্ধনহীনতাও আবার মায়ের অনুগ্রহেই ঘটে। করালবদনা শব্দে মায়ের ধ্বংসাত্মক ভাবকেই প্রকট করা হইয়াছে। তিনি নৃমুন্ডমালিনী। ঐ মুন্ডের সংখ্যা একপঞ্চাশ, ঐ একান্ন মুন্ড আকার হইতে ক্ষকার পর্যন্ত একান্ন বর্ণমালার প্রতীক। ইহাদিগকে তন্ত্রাচার্যরা মাতৃকাবর্ণ বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন। ঐ রথমালা সৃষ্টির দ্যোতক। শব্দ আকাশের গুণ, আর আকাশই প্রথম সৃষ্ট পদার্থ।
সুতরাং ব্রহাময়ীর বর্ণরূপিণীরূপে কল্পনা সঙ্গতই হইয়াছে, তিনি একাধারে বর্ণময়ী এবং বর্ণরূপিণী। কটিবন্ধ নরহস্ত, হস্ত এখানে সমস্ত কর্মেন্দ্রিয়ের প্রতীক, যখন কর্ম শুধু মায়ের উদ্দেশ্যেই প্রযুক্ত হইবে তখনই কর্ম আর বন্ধন জন্মাইতে পারে না। ইহাকে লক্ষ্য করিয়াই গীতায় ‘অকর্মণি চ কর্ম যঃ’ বলা হইয়াছে, এইরূপ সাধকই মায়ের পূজার উপযুক্ত-ইহাই ছিন্নহস্ত ধারণের তাৎপর্য। মায়ের পদ-তলে শবরূপী কাল। এই কালই জগতের ধ্বংসকারী কালকে যিনি পদানত করিয়াছেন, যিনি জয় করিয়াছেন তিনিই কালী। মা নৃত্যপরায়ণা ইহা সৃষ্টিছন্দের প্রতীক। জগতের প্রতিটি অণুপরমাণু এই ছন্দে ছন্দে গতিশীল, গতিশীলতাই প্রাণক্রিয়া বা জীবনের লক্ষণ। ত্রিনয়ন তাঁহার ভূত ভবিষ্যত, বর্তমান এই ত্রিকাল দর্শনের দ্যোতক। অথবা নয়ন তিনটি চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নিরুপ জ্যোতির প্রতীক। আমরা জাগতিক জ্যোতির আধার বলিয়া যাহাদের জানি তাহারা সকলেই মায়ের নেত্রস্বরূপ। তিনিই জ্যোতির আধার।
কালীর দুই বাম হস্তে খড়্গ ও মুন্ড এবং দক্ষিণ হস্তে অভয় ও বরমুদ্রা। খড়্গ ও মুন্ড দুষ্টজননাশের প্রতীক। আর তিনি যে শুধু দুষ্টের দমনকারিণী মহাশক্তি তাহা নহে, শিষ্টের পালনকারিণীও তিনিই; ইহাও বরাভয় ধারণের দ্বারা প্রকাশিত হইয়াছে। সর্বোপরি তিনি শ্যামা নয়ন-মন স্নিগ্ধকারিণী।
শক্তিমান সাধক ব্যতীত কেহই এমন মূর্তি কল্পনা করিতে পারে না। ভীষণ ও সুন্দর, প্রলয় ও সুষ্টি, তাড়ন ও রক্ষণের এমন অপূর্ব সমাবেশ শ্যামা ভিন্ন আর অন্য কোন মূর্তিতে দেখা যায় না, এ মূর্তি শুধু ‘যোগীনাং যোগগম্যঃ।’
যোগের সাধনায় তাঁহাকে জানা যায়। যদি কোন শুভ মুহূর্তে এই ধারণা আমাদের জন্মে যে, আমরা এই মহাশক্তির সন্তান-তখনই সব জড়তা দুর হইবে, আমরা সাধকের মত বলিতে পারব:
‘আয় মা সাধন সমরে
দেখি মা হারে কি পুত্র হারে।’
|
|