|
ওঁ সৃষ্টি-স্থিতি বিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।
গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোহস্তুতে॥
কাল+ স্ত্রিয়ামীপ্ প্রত্যয় করিলে হয় কালী। অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্টা নারী অথবা কালভয়বিনাশিনী জগন্মাতা কালী।
মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে আমরা দেখতে পাই তুমিই হিমালয়-শীর্ষে দেবী কৌশিকীর শরীর থেকে কৃষ্ণবর্ণ ধারণপূর্বক বহির্গত হয়ে “কালিকা” নাম নিয়েছিলে এবং অসুরকূল ধ্বংস করেছিলে। পরে তুমিই আবার অসাধারণ বিক্রম, অদ্ভূত কৌশল ও রোষ-কষায়িত নেত্রে ভীষণাতিভীষণ ধূম্রলোচন ও চণ্ডমুণ্ডাদির বধ সাধন করেছিলে এবং “চামুণ্ডা” এই আখ্যা প্রাপ্ত হয়েছিলে। ক্রমশো যথাঃ তস্যাং বিনির্গতায়ান্তু কৃষ্ণাভূৎ সাপি পার্বতী।
কালিকেতি সমাখ্যাতা হিমাচল কৃতাশ্রয়া॥
যস্মাচ্চণ্ডঞ্চ মুণ্ডঞ্চ গৃহীত্বা ত্বমুপাগতায়।
চামুণ্ডেতি ততো লোকে খ্যাতা দেবি ভবিষ্যসি॥
পরে তুমিই আবার রক্তবীজাসুর-সন্ত্রস্ত দেবদেবীগণের কাতর প্রার্থনা ও সনির্বন্ধানুরোধে মুখবিস্তারপূর্বক স্বানুরূপ শত শত জনজন্যমান রক্তবীজের শোনিত পান করে সমূলে সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ অসুরকে নিহত করেছিলে। যথাঃ ইত্যুক্ত্বা তাং ততো দেবী শূলেনাভিজঘান তম্।
মুখেন কালী জগৃহে রক্তবীজস্য শোণিতম্॥
মা দানবকূলহন্ত্রি! শুম্ভ-নিশম্ভ-মথনেও তোমার বিক্রমের তুলনা নাই। অতএব মা করালবদনা! তোমার সেই বিভীষণ মূর্তি স্মরণ করলেও শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে এবং তোমার অলৌকিক মাহাত্ম্যাদির বিষয় ধারণা করলেও দেহ-মন ভাবে বিভোর হ’য়ে যায়।
মা কালীর রূপ আমরা পুরাণ ও তন্ত্রাদিতে দেখতে পাই— এ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাম্
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্॥
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথাচৈব দিগম্বরীম্॥
ইত্যাদি মা কালীর রূপ অতি ভয়ঙ্কর ও বিস্ময়প্রদ। তিনি ভয়ঙ্কর বদন-বিশিষ্টা, মুক্তকেশী, দিগ্বসনাবিশ্ব-প্রকৃতিবিশিষ্টা যিনি, যিনি সর্বদাই প্রসবকার্যে ব্যাপৃতাতাঁর অঙ্গে কোন বস্ত্রাবরণ থাকতে পারে না বা থাকবার কোন প্রয়োজনও হয় না। ভীষণ কাল্-মেঘের ন্যায় তাঁর গাত্রবর্ণ, শ্মশানে শবসমূহের উপর তিনি অবস্থান করছেন, শবমালায় বিভূষিত তাঁর দেহ, অসুর-গণের রক্তপান করবার জন্য সর্বদাই তাঁর রসনা লক্ লক্ করছে এবং তিনি মহাকালের সঙ্গে অনবরত আনন্দোরসোপভোগে উন্মত্তা। এম্ববিধ অদ্ভূত রূপ তাঁর। চামুণ্ডারূপে তাঁর রূপ আরও ভীষণ এবং কার্যাদিও অত্যদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর।
অমানিশার ঘোর অন্ধকারময় নিশীথে তাঁর অর্চনা নিয়মানুগ ও প্রশস্ত। কর্মকর্তা ও সাধকের সংযম ও একাগ্রতার অভাবে ইঁহার আরাধনায় অনেক সময়ে অনেক বিঘ্ন ঘটে। সুতরাং কর্মকর্তা ও সাধক এই উভয়েরই এ বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত।
যখন যখনই পৃথিবী পাপ-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে এবং দুর্জন-গণের বৈরাচার ও দুর্ব্যবহারে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে তখন তখনই দেব-দেবীগণ স্বীয় ঐশী শক্তি নিয়ে যথাস্থানে অবতীর্ণা হয়েছেন এবং দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের রক্ষণ বিদান করেছেন। আমরা দেখতে পাইগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥
এ স্থানেও সেইরূপদুর্গারূপিনী জগদম্বা মা কালী স্বৈরাচারপ্রবণ, দুর্জর, দুষ্ট দানবগণের প্রবল নিষ্পীড়ন থেকে রক্ষা করবার জন্য দেবগণকে আশ্বাস দিয়েছেন। যথা—
ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোদ্ধা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবর্তীর্ষ্যাহং করিষ্যাম্যরি-সংক্ষয়ম্॥
এই আশ্বাসবাণী অনুযায়ী কাজও অভয়দাত্রী মা কালী অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন। আমরাও তদ্রুপ আমাদের জীবনসংগ্রামে, বর্তমান দুর্দিনে এবং এই বিপদসঙ্কুল সময়ে আমাদের ঐকান্তিক আরাধ্যা দেবী, পরমব্রহ্মস্বরূপিণী জগজ্জননীর নিকট আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনামা! তুমি আমাদের অজ্ঞানতা নাশ কর। পাশব-প্রবৃত্তি যেন কখনও না জাগে আমাদের মধ্যে। আর আমাদের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করে দিয়ে তুমি আমাদের অভয় দাও।
আকাঙ্খিত বরদানে আমাদের উৎসাদিত কর এবং শত্রুনিধনে সোৎসাহে আমাদিগকে যথোপযুক্ত শক্তি দাও।
|
|