|
এ প্রদীপ প্রথম কবে জ্বলেছিল, কোন্ অতীতে, কেউ তা সঠিক জানে না। কেউ আজ বলতে পারে না কোথায় জ্বলেছিল সেই প্রথম দ্বীপটি, সেকি বিন্ধ্যপর্বতের কোন অন্ধকার কুটিরে মাটির পিলসুজে, কিংবা কোন প্রাসাদে, দেউল সুবর্ণমণ্ডিত কোন সহস্রমুখ দীপদানে, অথবা আর্যাবর্তের কোন কৃষককন্যার হাতে ধীরগতি কোন নদীর ঘাটে। বিশাল ভারতের এলোমেলো স্মৃতিভাণ্ডার হাতড়ালে শুধু এইটুকুই জানা যায়এ দীপ শিখা চির-অনির্বাণ। আলোর যুগেও কৃষ্ণ-চতুদর্শীতে তা যেমন জ্বলত, তেমনি অন্ধকারের যুগেও। একাদশ শতকে সোমনাথ মন্দিরের লুণ্ঠনের সময়ে আলবেরুণী যেমন দেখেছিলেন ভারতময় এই অনির্বচনীয় আলোর উৎসব, তেমনি যুগে যুগে অন্যরাও দেখেছেন। দেওয়ালী আলো অনন্তকাল ধরে জ্বলছে।
আজও জ্বলবে। পূবে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণেহিমালয়ের কোলে গরীবদের গায়ে দক্ষিণের সমুদ্রকূলে নারকেলের বনে,ধান আর গম ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ কুটিরে গোটা ভারত আজও আলোয় আলোয় নক্ষত্রলোক সাজবে। হাউই উড়বে, পটকা ফাটবে, রংমশাল রং ছড়াবে,বালকের হাতের কাঠি খুশির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা ছিটোবে, অমাবস্যার রাত আলোয় হাসবে।
দেওয়ালী হাসির উৎসব, বিজয়ীর উৎসব। লোককথা বলে একদা এই দিনে ভারত আলো জ্বলে, উৎসবে মেতেছিল, কারণলঙ্কাকাণ্ড সমাধা করে রামচন্দ্র এই দিনেই অযোধ্যায় পৌঁছেছিলেন। শুনে প্রতিটি ভারত সন্তান শান্তির প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন, ঘরে ঘরে কোটি কোটি সীতা আনন্দে আলো জ্বেলেছিলেন। কেউ কেউ বলেন দেওয়ালীর আলো জ্বেলে আমরা আসলে নরকাসুরে জয়ের ঘটনা স্মরণ করি। এমনি এক অমাবস্যার রাতেই নাকি শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হয়েছিলেন ত্রিলোকের ত্রাস নরকাসুর। যোল-হাজার বন্দিনী নারী মুক্তি পেয়ে আবার সংসারে ফিরে এসেছিলেন, ঋ
ষিরা আবার দিনের আলো দেখতে পেলেন। কলঙ্কমুক্ত পৃথিবী তাই সেদিন আলোয় আলোয় অপরূপা সেজেছিলমর্তবাসী আনন্দে হেসেছিল। আবার কেউ কেউ বলেন ভারতের দরিদ্রতম মানুষটিও অন্ধকার রাতে আলো জ্বেলে একদিন উৎসবে মেতেছিল, কারণ সেই চতুর্দশী সন্ধ্যায়ই সংবাদ এসেছিল পরাজিত শকেরা পলায়নের পথ খুঁজছে, স্বদেশে রাজা বিক্রমাদিত্য তাদের উৎখাত করতে সমর্থ হয়েছেন। শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ভারতবর্ষ। এ আলো তারই স্মারক।
আবার অন্যরকম কাহিনীও শোনা যায়। প্রজারঞ্জক রাজা ছিলেন মহাবলী। শক্তিমানও বটে। তাঁর ভয়ে দেবতারাও শঙ্কিত। কিন্তু প্রজারা তাঁকে ভালোবাসে। ভীত দেবতাদের প্রার্থনায় বিষ্ণু বামন বেশে মহাবলীর সামনে এসে হাজির হলেন। মহাবলী জানতে চাইলেন তিনি কি চান। বামনরূপী বিষ্ণু বললেন ত্রিপাদ ভূমি। দানশীল মহাবলী তাতে আপত্তি করলেন না। তিনি বামনের প্রার্থনা মঞ্জুর করে বললেন বেশ, তাই নাও। বিষ্ণু এবার স্বরূপ ধারণ করলেন। এক পায়ে তিনি পৃথিবী অধিকার করলেন, আর এক পদক্ষেপে স্বর্গ অধিকৃত হল। বিষ্ণু বললেনতৃতীয় পদ কোথায় স্থাপন করি? মহাবলী বললেনআমার মস্তকে। বিষ্ণুর পদভারে মহাবলী রসাতলে প্রোথিত হলেন।
প্রজারা কান্নাকাটি শুরু করল। তাদের পীড়াপীড়িতে পড়ে বিষ্ণু প্রতি বছর একদিনের জন্য মহাবলীকে নিজের রাজধানীতে ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। সে দিনটিই দেওয়ালী। লোকজন নরপতিকে নিজেদের মধ্যে ফিরে পেয়েছিলেন বলেই প্রজারা সেদিন আলোর উৎসব করেছিল। কেউ কেউ এমনও বলেনমহামায়া দূর্গা এদিনেই অসুর বধ করে ত্রিলোককে নিশ্চিন্তে আলো জ্বালতে দিয়েছিলেন। শিখেরা বলেন, এ দিনেই ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ জাহাঙ্গীরের কারাগার থেকে আবার পঞ্চনদের তীরে ফিরে এসেছিলেন।
শুধু আলো আর আলো নয়, সমস্যার অন্ধকারে আলোর এই সমারোহ থেকে বোঝা যায়, দেওয়ালীর আলোতে অন্ধকারও একটা উপলক্ষ্য। জৈনরা বলেনএই দিনেই মহাবীর নির্বাণ লাভ করেছিলেন। সমগ্র ভারতে সেদিন গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছিল। দেওয়ালী প্রদীপ সেই বরণীয় আলোকপথযাত্রীরই স্মৃতি। দেওয়ালী উপলক্ষ্যে দেশের অনেক এলাকায় লক্ষ্মীপুজোর প্রচলন আছে। লোকে বলে সমুদ্রমন্থনের শেষে এদিনেই ধরা দিয়েছিলেন কমলাসনা লক্ষ্মী। দেওয়ালীর এই আলোর পেছনে তাই মন্থনের যন্ত্রনাটাও স্মরণীয়। আবার কেউ কেউ বলেন পিতার ক্রোধে দরিদ্র ব্রাহ্মণের ঘরে বিতাড়িত এক রাজকন্যা বাবার সঙ্গে শর্ত করেছিলেন সমস্ত রাজ্য এক রাত্রি আলোকহীন রাখতে। বাবার হারিয়ে যাওয়া গজমতির মালা কুড়িয়ে পেয়েছিল তাঁর এই দুঃখিনী মেয়ে, মালা ফেরত দেওয়ার আগে শর্ত দিয়েছিল সেকৃষ্ণ-চতুর্দশীতে রাজ্য আলোহীন রাখতে হবে। তাই হল। রাজার আদেশে গোটা রাজ্যে সেদিন কারোর ঘরে আলো নেই। আলো জ্বলছে, একমাত্র সেই রাজকন্যার কুটিরেই। লক্ষ্মী অতএব এসে প্রবেশ করলেন তাঁর ঘরেই। সেই থেকে দেওয়ালীর রাতে ঘরে ঘরে আলোঅনেক ঘরে লক্ষ্মীপুজো।
আলোর উৎসব দেওয়ালী কোথাও বিজয় উৎসব, কোথাও নববর্ষের উৎসব, কোথাও এদিনে লক্ষ্মীপুজো, কোথাও পূর্বপুরুষের স্মৃতিতর্পণ। বাংলাদেশে এই দেওয়ালীর দিনেই আবার কালীপুজো। কোন অঞ্চলে নববর্ষের করণীয় হিসেবে জুয়া খেলা চলছে, কোন রাজ্যে লক্ষ্মীপুজো, কোথাও বা গণেশ পুজোকেউ নাচছে, কেউ গাইছে, কেউ স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, কারও ঘরে হয়ত দেওয়ালীর আলোর সমুদ্রে নানা রঙ নানা ঢেউ। কিন্তু অমাবস্যার অন্ধকারে দণ্ডায়মান বাংলা দেশের সেই ভয়ঙ্কর মাতৃমূর্তিটির দিকে তাকালে জানা যায়, আলোর গরিমাই শেষ কথা নয়,দেওয়ালী আসলে আলোর নামে আলোর জন্য অন্ধকারেরই সাধনা!
|
|