যুগ থেকে যুগান্তরে প্রতি বছর এই সন্ধ্যায় এ দীপ জ্বলে, চিরকাল জ্বলে আসছে। এমন কী সুদূর একাদশ শতকে সুলতান মামুদ যেদিন সোমনাথ মন্দির লুঠ করেছিলেন সেদিনও আলবেরুণী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন রক্তস্নাত ভারত সহসা কোন যাদুবলে আলোয় আলোময়। সুতরাং আজও জ্বলবে। পূবে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে, হিমালয়ের কোলে অগ্নিময় গাগুল্যের কুটিরে কুটিরে, দক্ষিণের সমুদ্রকূলে, সমতলের প্রতিটি ঘরে অফুরন্ত প্রাণৈশ্চর্যের ভাণ্ডার ভারত আজও আলোয় সাজবে। তার মাটিতে আকাশে দেওয়ালী হবে। কিন্তু কেন?দেওয়ালী কিসের উৎসব। সে কী শুধুই তিথি পালন? অজ্ঞাত যুগের আনন্দ-আমোদের অন্ধ অনুকরণ?
উৎস ভুলে, উৎসবের আত্মাকে ভুলে ক্রমে বহিরঙ্গের জলুস বাড়ছে বলেইআজ দরকার হয়ে পড়েছে প্রতিটি ভারত সন্তানের দৃষ্টি একবার পেছনে ফেরাবার। নয়ত, যখন সীমান্তে আমাদেরই জোয়ানেরা হানাদারের সঙ্গে লড়ছে তখন আমাদের এই আলো আর হাউই আজকের আলবেরুণীদের বিস্মিত করবে মাত্র। করতে বাধ্য। সেদিনের মত আজও কোন কৈফিয়ত রেখে যেতে পারবনা আমরা ইতিহাসের হাতে।
বাঙ্গালীর দেওয়ালী শুধু আলোর উৎসব নয়, অমাবস্যার অন্ধকারে তান্ত্রিক বাঙ্গালীর কাছে এ মাতৃ-সাধনার, শক্তি সাধনার পরম লগ্ন। তার দীপান্বিতও শাস্ত্রীয়। বাংলার মতই ভারতের কোন কোন অঞ্চলে আজ লক্ষ্মীপুজো, কোথাও গণেশপুজোখাতা বদল, কোথাও জামাই আপ্যায়ণ। তার সবই ধর্মীয় অথবা সামাজিক আচার সংক্রান্ত। দেওয়ালীর আলোয় বন্যায় সে দীপ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে বটে, কিন্তু হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী গোটা ভারতের সবচেয়ে লোকপ্রিয় উৎসব দেওয়ালীর আদি সম্পূর্ণ অন্য, স্বতন্ত্র। কথায়-উপকথায়, পুরানে-লোকগাথায় এ উৎসব অনিবার্যভাবেই বিজোৎসব। দেওয়ালী সেই কালের উৎসব ভারত যেদিন পরাজয়ের অর্থ জানত। বিজয়ের প্রতীক্ষায় সেদিন সে প্রদীপে তেল নিয়ে অপেক্ষা করত, প্রাণের নায়র ঘরে ফিরলে মুহূর্তে আলোয় আলোয় মুখ তার উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। যেমন উঠেছিল একদা গোয়ালিয়র, মহারাষ্ট্রতথা সমগ্র পশ্চিম ও মধ্য ভারত।
প্রজারঞ্জক রাজা ছিলেন মহাবলী। শক্তিমানও বটে। তাঁর ভয়ে দেবতাও শঙ্কিত। কিন্তু প্রজারা তাঁকে ভালোবাসে। সুতরাং দেবতা বিষ্ণুর শরনাপন্ন হলেন। বিষ্ণু কার্যসিদ্ধির জন্য বামন বেশে মহাবলীর সামনে এসে হাজির হলেন। প্রার্থনা, তিনি যদি অনুগ্রহ করে তাঁকে কিছু ভূমি দান করতেন! মহাবলী জানতে চাইলেনকত? উত্তর হলমাত্র তিন পা। উদার মহাবলী তৎক্ষনাৎ সম্মত হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণু নিজ মূর্তি ধারণ করলেন। একপায়ে তিনি সমগ্র পৃথিবী অধিকার করলেন, দ্বিতীয় পদক্ষেপে স্বর্গ অধিকৃত হল। কিন্তু তৃতীয় পদক্ষেপ? হয়ত নিছক ব্যঙ্গের সুরেই বলেছিলেন, হয়ত নিজের ওপর অত্যধিক আস্থাবশত, মহাবলী বললেনআর এক পা আমার মাথায় রাখুন। বিষ্ণু সেই সুযোগই খুঁজছিলেন। তাঁর পদভারে মহাবলী রসাতলে প্রেরিত হলেন।
প্রজারা কান্নাকাটি শুরু করল। তাদের দাবির চাপে দেবলোক মহাবলীকে প্রতিবছর একদিনের জন্য নিজ রাজধানীতে ফেরবার অনুমতি দিলেন। সেদিনই ভারতে প্রথম দেওয়ালী! মনে রাখতে হবে দেবতারা বিজয়ী হলেও দেওয়ালী তাঁদের বিজয়োৎসব নয়বিজোৎসব তাঁরই স্মৃতিতে যিনি ছিলেন মাটির পৃথিবীর রাজা, নিজেদের মানুষ। ভারত সেদিন হানাদারের ভূমিকায় পেলে স্বয়ং বিষ্ণুকেও ক্ষমা করতে জানতনা।
উত্তর ভারতে দেওয়ালীর গায়ক মহাবলী নন, নরকাসুর বিজয়া শ্রীকৃষ্ণ। নরকাসুরের উৎপীড়নে সমস্ত ভারত ছারখার হয়ে যাচ্ছে, প্রজারা উৎপীড়িত। শ্রীকৃষ্ণ দানব দমনে বের হলেন। নরকাসুরের নিবাস ছিল প্রাকজ্যোতিষপুরে, ভারতের উত্তর পূর্ব সীমানন্তে। তাঁর অন্তঃপুর ষোলশ’ লুণ্ঠিত নারীর জন্য তৈরি হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। প্রথমে আলাপ আলোচনা, তারপর তর্কাতর্কি, পারস্পরিক গালমন্দ, অবশেষে যুদ্ধ। শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ী হলেন। ঘরে ঘরে আলো জ্বলল। ভারতে দেওয়ালী হল। তারপরও কী বলা চলেদেওয়ালী অর্থহীন আলো, কেবলই তেল পোড়াবার উৎসব।
যাঁরা পুরাণের সব কথা জানেন না তাঁরাও আকাশে আকাশে অহেতুক হাউই পাঠাচ্ছেন একথা মানবেন না। কারও কাছে দেওয়ালীতে তামাম ভারতে আলো জ্বলে, কারণ রাবণ বধের পালা চুকিয়ে রামচন্দ্র সেদিন তাঁর রাজধানীতে পৌঁছেছিলেন। কেউ কেউ বলেনমহামায়া দূর্গা এদিনেই অসুর বধ করে ত্রিলোকে নিশ্চিন্তে আলো জ্বালাতে দিয়েছিলেন। কারও কারও মতেপবিত্র ভারতভূমি থেকে হানাদার শকদের বিতাড়িত করে বিক্রমাদিত্য এদিনেই নতুন করে উৎসব সহকারে
|