|
হিন্দী ‘দিয়া’ শব্দের অর্থ দীপ। ‘দিয়া ও ওয়ালী’ শব্দ একসঙ্গে মিলে ‘দীপাবলী’ (দীপ+আবলী) শব্দের অপভ্রংশ, ‘দীপান্বিতা’ বা ‘দীপমুক্তা’ অর্থ বোঝাতে ‘দিওয়ালী’ এবং তা থেকে রুপান্তরিত আকারে নিস্পন্ন হয়েছে ‘দেওয়ালী’। যে পূজা-উৎসব উপলক্ষে গৃহাদি আলোকমালায় সজ্জিত করা হয়, তাকে বলা হয় ‘দেওয়ালী’। তন্ত্র প্রভাবিত বাঙ্গলাদেশে এই উৎসবের অধিদেবতা কালী বা শ্যামা। সমগ্র পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে এই উৎসব উপলক্ষে পূজিতা হন সম্পদ ও সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষী। অবশ্য, এইদিন বাঙ্গলা দেশের অনেক স্থানে লক্ষ্মীপুজাও করা হয়। কিন্তু দীপাবলী উৎসবের সঙ্গে তার কোনই সম্পর্ক নাই।
উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দেওয়ালী
উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দেওয়ালী উৎসবের সময় যে লক্ষ্মীদেবী অর্চিতা হয়ে থাকেন তিনি সাধারণতঃ বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আরাধ্যা দেবী। কিন্তু লৌকিক লক্ষ্মীদেবী মূলতঃ কৃষককুলের কৌম-দেবতা। ঘটলক্ষ্মী এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাদ্রলক্ষ্মী ও পৌষলক্ষ্মীই তার প্রমাণ। চিত্রাঙ্কিত ঘটের মধ্যে ধানের ছড়া স্থাপন করে ঘটলক্ষ্মীর পুজো করার বিধি। ভাদ্র ও পৌষ মাসে নূতন ধান দিয়ে ভাদ্রলক্ষ্মী ও পৌষলক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
সামান্য রকমফের ছাড়া উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে দেওয়ালী উৎসবের প্রধান অঙ্গ হলেও এই উৎসবের কার্যতঃ সূত্রপাত হয় চতুর্দশী থেকে এবং সমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয়ায়। এই চতুর্দশীকে বলা হয় নরক চতুর্দশী। যত রকমের উৎকৃষ্ট ভোজ্যবস্তুই প্রস্তুত করা হোক না কেন, নরক-চতুর্দশীতে ‘চৌদ্দশাক’ ভাজা খাওয়ার রীতির বেশ মিল আছে। নরকাসূরকে শ্রীকৃষ্ণ চতুর্দশীর দিন বধ করেছিলেন। কথিত আছে নরকাসুর অসুর হলেও ধর্ম পরায়ণ ছিল এবং শ্রীকৃষ্ণ তাকে এই বর দিয়েছিলেন যে, ভোজের ঘটা ও আনন্দৎসব করে তার মৃত্যুর দিনটি স্মরণ করা হবে। লোকের বিশ্বাস এই যে, নরকাসুরকে শ্রীকৃষ্ণের এই বরদান থেকেই এই বাজি পোড়াবার এবং আন্দোৎসব করার রীতির উৎপত্তি হয়েছে। অমাবস্যার দিন প্রধান উৎসব লক্ষ্মীপূজা। তার পরের দু’দিন হচ্ছে ‘বলি-প্রতিপদ’ ও ‘যম-দ্বিতীয়া’। ‘যম-দ্বিতীয়া’ বাঙ্গলাদেশের ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। এই দিনের অনুষ্ঠানও উভয় ক্ষেত্রে কতকটা এক। উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে এই দিন ভাইদের কপালে ফোঁটা না দেওয়া হলেও ভাইয়েরা বোনেদের নানারকমের উপহার দেয়। তাছাড়া পিতৃকৃতাও এইদিনের একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এইদিন একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এইদিন পরলোকগত পিতৃপুরুষগণের আত্মার কল্যাণ কামনা করা হয়।
‘ছোট দেওয়ালী’
দেওয়ালীর প্রধান উৎসব লক্ষ্মী পূজার দিনে প্রাথমিক আয়োজনকে সাধারণতঃ বলা হয় ‘ছোট দেওয়ালী’। এই দিন সূর্যোদয়ের আগে স্নান করে পবিত্র হয়ে নূতন কাপড়-চোপড় পরে উৎসবের প্রস্তুতিপর্বের যে সূচনা করা হয় তাকে বলা হয় ‘ছোট দেওয়ালী’। বাড়ীতে লোক বেশী থাকলে রাত্রি তিনটা থেকে স্নান আরাম্ভ করা হয়। স্নানের আগে সুগন্ধী চামেলী তেল রগড়ে রগড়ে গায়ে মাখা হয়। বাড়ীর কর্তাকেই আগে এই সুগন্ধী তেল মাখানো হয় এবং তিনি সকলের আগে স্নান সেরে নেন। এই ভাবে স্নানের ফলে সারা বছরের পাপ থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র হওয়া যায় বলে বিশ্বাস প্রচলিত আছে।
দেওয়ালীর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গয়না দোকানে ভিড় লেগে যায়। আর্থিক সামর্থ্য অনুসারে স্ত্রীলোকেরা পুরাতন গয়না ভেঙ্গে নূতন করে তৈরি করায় এবং দেওয়ালী উপলক্ষে সেগুলি পরে। নূতন বস্ত্রালঙ্কারকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়।
ব্যবসায়ীরা পুরানো হিসাবের খাতা সিঁদুর ও চন্দনলিপ্ত করে পূজা করেন। এইদিন নূতন খাতাও খোলা হয়।
লূপ্ত প্রথা-পদ্ধতি
দেশের নানা স্থানে এক সময়ে প্রচলিত দেওয়ালী সংক্রান্ত কতকগুলি প্রাচীন প্রথা পদ্ধতি ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই সমস্ত রীতির মধ্যে একটি হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে তাড়ি ও মদ্যপান, অপরটি হচ্ছে জুয়াখেলা।
বাঙ্গলাদেশে বিশেষভাবে পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুদের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার রাত্রিতে জাগরণ ও নারিকেলসহ চিপিটক ভক্ষণম্-এর সঙ্গে দূত্যক্রিড়ার বিধানের মত উত্তর ও পশ্চিম ভারতেও এক সময় জুয়াখেলা পবিত্র কর্ম বলে পরিগণিত হত এবং লোকের এই ধারণা ছিল যে দেওয়ালীর সময় কোন-না-কোন প্রকারের জুয়া না খেললে পরজন্মে ছুঁচো হয়ে জন্মগ্রহন করতে হয়। মদ্যপান ও জুয়াখেলার এই ক্রমবিলুপ্তি সুস্থ ও সামাজিক চেতনার লক্ষণ বলেই মনে করতে হবে।
এক সময় সেূতায় গাঁথা বাতাসা ও চিনির তৈরী খেলনার আকারের নানা ধরণের মিষ্টদ্রব্য ছোট ছেলেমেয়েদের উপহার দেবার রীতি ছিল। এ রীতিও ক্রমশঃ উঠে যাচ্ছে। এখন তার স্থলে বহু ব্যয়সাধ্য রীতির প্রচলন হয়েছে। এখন বড় বড় শহরে অনেকে সন্দেশের তৈরী মোটর গাড়ী, ইমারত ইত্যাদির আকারে উপহার দিয়ে থাকেন।
দক্ষিণ ভারতে দেওয়ালী
দক্ষিণ ভারতে দেওয়ালীর অনুষ্ঠান উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মতোই। আলোকসজ্জা, লক্ষ্মীপূজা, আনন্দোৎসব-সব কিছুই উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সঙ্গে অভিন্ন। তবে উপহার দানের ব্যাপারে কিছুটা বৈচিত্র্য আছে।
দক্ষিণ ভারতে দেওয়ালী উপলক্ষ্যে নববিবাহিত জামাতারাই সর্বাপেক্ষা ভাগ্যবান। তবে এই অনুষ্ঠান অনেক বেশী জমকালো। কতকটা বাঙ্গলা দেশের জামাইষষ্ঠীর মত কন্যা ও জামাতাকে পাশাপাশি আসনে বসিয়ে, প্রদীপ জ্বেলে, শাঁখ বাজিয়ে ফুল মালা ও চন্দন দিয়ে জামাইকে অভর্থনা করা হয়। স্ত্রী লোকেদের মধ্যেও পান, সিঁদুর ও নানা রকম ফলের উপহার বিনিময়ের রীতি আছে।
দেওয়ালিতে আলোকসজ্জা ও তার কারণ
দেওয়ালি বা দীপাবলী কথাটির মধ্যেই এই দিন আলেকসজ্জা করার বিধান আছে।এই দিন রাত্রিতে বাসভবনসমূহে অল্পবিস্তর আলোক সজ্জা করা হলেও, কলিকাতায় ও ভারতের অন্যান্য বড় বড় শহরে বিশেষভাবে বোম্বোতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান-ভবন আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয়ে দর্শণীয় আকার ধারণ করে।
সাধারণত এইরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে যে, লক্ষ্মীদেবী পেচক-বাহনে আরোহণ করে পৃথিবীর উপর দিয়ে ভ্রমন করেন এবং যে গৃহে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল আলোকমালা উদ্ভাসিত দেখতে পান, সেই গৃহে প্রবেশ করেন। এই কাহিনী এই রাত্রিতে আলোকসজ্জার প্রেরণা যুগিয়েছে বলে মনে হয়।
সৌভাগ্যলক্ষ্মী যে বর্তমান কৃষক-কৌম্য অপেক্ষা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কেই অধিকতর করুণা দান করেছেন, শহরের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের শ্রীবৃদ্ধি এবং দেওয়ালীর সর্বাধিক জাঁকজমক তার নিদর্শন।
|
|