কলকাতায় পুলিশের গুলিতে ১৩ জনের মৃত্যুর পরে ঝড় সামলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। আক্রমণাত্মক হয়ে।
নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর পরে সরকার বাঁচাতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রক্ষণাত্মক হয়েও।
দু’টো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত আলাদা। তবু সিপিএমের অন্দরে এই দুই ঘটনা মোকাবিলার কৌশল বহুচর্চিত। দলের মধ্যেই বসু এবং বুদ্ধবাবুর দুই শিবিরের কথাও সুবিদিত। কিন্তু তদন্ত কমিশনের মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত ২১শে জুলাইয়ের ঘটনায় প্রয়াত বসুর পথেই হাঁটলেন বুদ্ধবাবু। যুব কংগ্রেসের ‘মহাকরণ অভিযানে’র নামে ২১ বছর আগের সেই দিন কলকাতা শহরে বড় আকারের হিংসা ছড়িয়েছিল, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবুর এই তত্ত্বই বুধবার তদন্ত কমিশনের সামনে পেশ করেছেন বুদ্ধবাবু। সে দিন আসলে মহাকরণ দখল নেওয়ার লক্ষ্য ছিল আন্দোলনকারীদের এবং সেই পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি চালানো এড়াতে পারেনি, জ্যোতিবাবুর আমলের সেই সরকারি ব্যাখ্যাও কমিশনের কাঠগড়ায় বসে
শুনিয়েছেন বুদ্ধবাবু। এবং যথেষ্ট আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে!
বাম জমানার শুরু থেকেই মন্ত্রী বুদ্ধবাবুর এই ধরনের কমিশনের কাছে হাজিরা দেওয়া এই প্রথম। বিতর্ক এড়াতে এবং শাসক দলের হাতে প্রচারের অস্ত্র তুলে না দেওয়ার লক্ষ্যেই তদন্ত কমিশনের ডাকে তাঁর সাড়া দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছিল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী। তার জন্য দফায় দফায় আইনি শলা এবং পর্যাপ্ত হোমওয়ার্কও করা হয়েছিল। তবু দলের একাংশের মধ্যেই চোরা উৎকণ্ঠা রয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক কালের একাধিক ঘটনায় তাঁর নিজের মূল্যায়নের কথা বলতে গিয়ে ভুল কবুল করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং তা নিয়ে বিতর্কও বেধেছে। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ নেতাই। যদিও নেতাই-কাণ্ডে ঠিক কথা বলেও দলের চাপে তাঁকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে বলে মনে করে দলের একাংশই। তবুও বিতর্কের প্রেক্ষিতেই এ বার আলোচনা করে কমিশনে যাওয়ার পরেও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সংবেদনশীলতা চিন্তায় রেখেছিল দলের একাংশকে। বিশেষ করে, লোকসভা ভোট যখন দোরগোড়ায়। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু হোমওয়ার্ক থেকে একেবারেই নড়েননি সিপিএমের বর্ষীয়ান পলিটব্যুরো সদস্য। বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে ৪৭ মিনিটের ঝোড়ো ইনিংসে বুদ্ধবাবু তাঁর পূর্বসূরিকে রক্ষা করার কাজ করে দেখিয়েছেন বলেই সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন।
দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “জ্যোতিবাবু এবং বুদ্ধবাবুকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। কিন্তু জ্যোতিবাবুই হাতে ধরে ওঁকে প্রশাসনিক কাজ শিখিয়েছিলেন। সে কথা বুদ্ধবাবুও মানেন। ২১ জুলাইয়ের ওই ঘটনার দিন মহাকরণে বসেই তিনি দেখেছিলেন, জ্যোতিবাবু কী ভাবে সামলাচ্ছেন। পুরনো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আলোচনা করেই ঠিক হয়েছিল কী ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে এবং তখন কী বলা যেতে পারে।” দলের অন্দরে বুদ্ধবাবুরও মত, সে দিনের ঘটনায় তাঁর সরাসরি বিশেষ ভূমিকা ছিল না। তবু তৃণমূল সরকারের বসানো তদন্ত কমিশনের কাজে তাঁরা যে অসহযোগিতা করছেন না, এ দিনের সাক্ষ্য থেকে সেটা বোঝানো গিয়েছে। এর পরে রিপোর্ট কেমন হবে, তা কমিশনের উপরেই নির্ভর করছে।
বস্তুত, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপরে পুলিশ গুলি চালাবে না, বামপন্থী সরকারের এই নীতির কথা বলে গিয়েছিলেন জ্যোতিবাবুই। কিন্তু ২১ জুলাইয়ের ঘটনাকে সেই মাপকাঠিতে তিনি ফেলেননি। আবার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বুদ্ধবাবুও নন্দীগ্রামের গুলিচালনার জন্য দায় মাথা পেতে নিয়েছেন। বলেছেন, গুলি চালাতে হবে জানলে পুলিশ পাঠাতেনই না। সেই প্রেক্ষিতেই এ দিনের সাক্ষ্যে বুদ্ধবাবুর দিকে নন্দীগ্রামের বল প্রায় আসতে চলেছিল! কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপরে গুলি চালানোর প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। কিন্তু মুহূর্তে সজাগ বুদ্ধবাবু ঢাল নামিয়ে দিয়েছেন! তাঁর যু্ক্তি, আন্দোলন মানেই গণতান্ত্রিক নয় এবং পুলিশের পদক্ষেপ মানেই অন্যায় নয়। কোন পরিস্থিতিতে পুলিশ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা মাথায় রাখতে হবে। পরিস্থিতির ফারাক বোঝানোর জন্যই পুস্তকপ্রেমী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ব্যবহার করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ। বলেছেন, “১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ডানজিগ (পোলান্ড) আক্রমণ করেছিলেন হিটলার। আবার ১৯৪৫ সালে বার্লিন আক্রমণ করেছিল ইঙ্গ-মার্কিন-রুশ বাহিনী। দু’টোই আক্রমণ। কিন্তু একটা অন্যায়, আর একটা ন্যায্য!” ঘটনার প্রাথমিক প্রশাসনিক রিপোর্টের ভিত্তিতে নীতিগত ভাবেই বাম সরকার ২১ জুলাইয়ের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের কথা ভাবেনি এবং এখনও তিনি একই মত বহাল রাখছেন, এ-ও বলেছেন বুদ্ধবাবু।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় আছে আরও একটি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এই কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিতে এসেই সে দিনের ঘটনার থেকে ‘দূরত্ব’ বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি তখন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বা বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন না। ঘটনার দিন কলকাতাতেও ছিলেন না। তাই বিশেষ কিছু জানেন না। একই সুযোগ বুদ্ধবাবুর সামনেও ছিল। তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসাবে তিনি কমিশনের সামনে পুলিশি ভূমিকার থেকে দূরত্ব দেখাতে পারতেন। কিন্তু সে পথে না হেঁটে সরাসরিই তিনি প্রয়াত বসুর হয়ে ব্যাট ধরেছেন।
বুদ্ধবাবুর সঙ্গে কমিশনে এসেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব এবং দুই আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আপাতদৃষ্টিতে এক বারই লক্ষ্মণ-রেখা পেরিয়ে যাচ্ছিলেন বুদ্ধবাবু। সে দিনের ঘটনার কোনও নথিপত্র ছাড়াই কমিশন কী ভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে, প্রশ্ন তুলছিলেন তিনি। বিকাশবাবুর সহায়তায় শেষ পর্যন্ত কমিশনের কাছে তিনি দাবি জানান, নথি হারানোর ঘটনা নিয়ে আলাদা করে তদন্ত হোক।
এইটুকুতে অবশ্য বিশেষ তাল কাটেনি বলেই মনে করছে আলিমুদ্দিন। আপাত-স্বস্তি নিয়েই তাই ফিরতে পেরেছেন বুদ্ধবাবু। সঙ্গে বাড়তি পাওনা কাঠগড়ায় ওঠার আগে কমিশনের চেয়ারম্যানের স্বাগত-বাণী “আপনি রাজ্যের আদর্শ পুরুষ। সৎ, সংস্কৃতিবান, মুক্ত চিন্তার জন্য আপনি পরিচিত। এই কমিশন আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করতে তৈরি।” স্মিত হাস্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বুদ্ধবাবু বলেছেন, তিনিও তৈরি। |