|
|
|
|
সাক্ষাত্কার... |
|
জাতপাতের রাজনীতি ‘পশ্চাৎপদ’ নয়
জাতপাত আমাদের সমাজে আছে এবং সময় এসেছে নীচের তলার লোকগুলির
কথা শোনার, এই সরল সত্যটাকে মেনে নিয়েই এগোতে হবে। সেটাই হবে প্রকৃত
প্রগ্রেসিভ রাজনীতি ও সমাজনীতি। বলছেন নিউজিল্যান্ডে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি
অব ওয়েলিংটন-এ ইতিহাসের শিক্ষক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। শুনলেন সেমন্তী ঘোষ। |
|
১৯৮৯ সালে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন, উত্তর ভারতের রাজনীতিতে একটা যুগান্তর ঘটে গেল। ভি পি সিংহের এই সিদ্ধন্ত কি ভুল ছিল? না কি, জাতপাতভিত্তিক সংরক্ষণ ভারতীয় সমাজে অনিবার্য ছিল দেশের সামাজিক বাস্তবকে রাজনীতির কাঠামোয় এই ভাবে স্বীকার করতেই হত?
মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট অনেক দিন টেবিলে পড়েছিল। ভি পি সিংহ রাজনৈতিক কারণে এটা খুঁজে বার করলেন এবং গ্রহণ করলেন, বিজেপি’র অগ্রগতি রোধ করার জন্য, যাতে হিন্দু সমাজের মধ্যে একটা বিভাজন উসকে দেওয়া যায়। অর্থাৎ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই, এই প্রশ্নটা নিয়ে কোনও বিতর্ক ছাড়াই, শুধু রাজনীতি করার জন্যই এই রিপোর্ট বলবৎ করা হল, এর সপক্ষে কোনও সামাজিক ঐকমত্য তৈরি করার চেষ্টা হল না। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, যখন সংবিধান প্রণেতারা সংরক্ষণের নীতিকে সংবিধানের অঙ্গ করলেন, তখন এর পিছনে যুক্তিটা কী ছিল। সমগ্র জনসংখ্যার মধ্যে তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষের যা অনুপাত, ক্ষমতার বিন্যাসে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব সেই অনুপাতে ছিল না। এই অসামঞ্জস্য দূর করার জন্য অন্তত কিছু দিন তাঁদের কিছু বিশেষ সুবিধা দেওয়া দরকার। তাঁরা আশা করেছিলেন, দশ বছরের মধ্যে এই অসামঞ্জস্য দূর হবে। কিন্তু আজও তা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক নেতৃত্ব অথবা কর্পোরেট জগতে এঁদের প্রতিনিধিত্ব এখনও জনসংখ্যায় এঁদের অনুপাতের সমান হয়নি। মণ্ডল কমিশন দেখালেন যে, অন্যান্য পিছিয়ে-পড়া জাতিগুলিও এই সকল বিষয়ে পিছনে পড়ে আছেন। তাই সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে এবং আজও তা ফুরোয়নি। কিন্তু এই যুক্তিগুলি জনসাধারণকে না বুঝিয়েই নতুন সংরক্ষণের নীতি চালু করা হল। ফল যা হল, তা তো আমরা দেখেইছি।
সংরক্ষণের পিছনে আর একটা যুক্তি আছে। যে সমস্ত জনগোষ্ঠী অতীতে বহু দিন ধরে অবদমিত হয়ে এসেছে, তাদের সেই ঐতিহাসিক অবিচারের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার। এটা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। এর ফলে অবশ্য বর্ণহিন্দুদের অসুবিধা হবে, তাঁদের কিছু ছাড়তে হবে। হচ্ছেও, এবং তাই সংরক্ষণ নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের এত উষ্মা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আজ তাঁরা যে না-পাওয়ার অসুবিধা ভোগ করছেন, কয়েকশো বছর ধরে দলিত শ্রেণির মানুষেরা সেই অসুবিধা ভোগ করে এসেছেন। যাঁরা মুক্ত প্রতিযোগিতার কথা বলেন তাঁদের মনে রাখা উচিত যে, কয়েক প্রজন্ম ধরে যাঁরা বঞ্চিত হয়ে এসেছেন এবং অশিক্ষিত থেকেছেন, তাঁদের পরিবারের একটি ছেলেকে বা মেয়েকে যদি কোনও উচ্চবর্ণের ধনী উচ্চশিক্ষিত পরিবারের কোনও ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে একই প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, তবে সেটা সম-প্রতিযোগিতা হবে না। অনেকে বলতে পারেন, উচ্চবর্ণের অনেক পরিবারই তো অশিক্ষিত, সেই সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা কেন এই সুযোগ পাবে না? এখানে মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, তাদের শিক্ষিত হওয়ার পথে কোনও কাঠামোগত বাধা ছিল না, কিন্তু দলিতদের ক্ষেত্রে ছিল। আজও কোথাও কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দলিত ছাত্রদের আলাদা বসতে হয়! কাজেই ঐতিহাসিক কারণেই জাতভিত্তিক সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আছে। এটা মেনে নেওয়ার জন্য সামাজিক শিক্ষা চাই, যার দ্বারা একটা সামাজিক ঐকমত্য গড়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে শুধুই রাজনীতি করে আমরা সেই সুযোগটা হাতছাড়া করেছি।
তবে এটাও ঠিক যে, শুধু সংরক্ষণ নীতি দিয়ে পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলির সার্বিক উন্নতি করা যাবে না। এই নীতির পাশাপাশি আরও অনেক রকম উন্নয়নমূলক প্রকল্পের প্রয়োজন আছে, যার ফর্দ দিয়ে শেষ করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলি সেই সব প্রকল্পের কথা ভাবে না। সাম্প্রতিক কালে উদারপন্থী অর্থনীতির ফলে ভারতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে তফাতটা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, এ কথা আমি অনেক অর্থনীতিবিদকেই স্বীকার করতে শুনেছি। এই নীতির পাশাপাশি তাই দরিদ্রদের উন্নতির জন্য অন্যান্য নানা রকমের উন্নয়ন পরিকল্পনা চাই। সেগুলির কথা না ভেবে শুধুমাত্র সংরক্ষণ নীতিকে দায়ী করাটা আমার মনে হয় রাজনীতির কারণেই। |
|
আদিপর্ব। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ। ব্রিগেড প্যারেড
গ্রাউন্ড, কলকাতা। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯০। ছবি: রাজীব বসু। |
কংগ্রেস এবং বামপন্থী দলগুলি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ার ফলেই কি বিভিন্ন রাজ্যে ভোটে জেতার জন্য জাতভিত্তিক সামাজিক ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা আরও বেশি সহজ হয়েছে? এখানে একটা কথা মেনে নেওয়া ভাল। আমাদের সমাজে জাতপাতের বিভাজন সংরক্ষণ থাকলেও আছে, না থাকলেও থাকবে। তাই সেই ১৯৫২’র প্রথম নির্বাচন থেকেই, কংগ্রেস তো বটেই, এমনকী কমিউনিস্ট পার্টিও জাতপাতের ব্যাপারটা মাথায় রেখেই তাদের প্রার্থী নির্বাচন করেছে কেউ জানিয়ে-শুনিয়ে, কেউ চুপিসাড়ে। শুধু উত্তর নয়, পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতেও সেই প্রথম নির্বাচন থেকে একই ব্যবস্থা চলে এসেছে। এমনকী কমিউনিস্ট পার্টিও যে যে অঞ্চলে যে জাতের আধিক্য বেশি সেখানে সেই জাতের ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছে, যার খবর আমরা মণিকুন্তলা সেনের আত্মজীবনীতে পাই। আর অন্য দিকে, এই দলগুলির শীর্ষ নেতৃত্ব সব সময়েই উঁচু জাতের বর্ণহিন্দুদের কুক্ষিগত থেকেছে এবং, আমার ধারণা, আজও তা-ই আছে। অর্থাৎ জাতপাতের রাজনীতি আজ কিছু নতুন ঘটছে না, তবে আজ আর রাখঢাকটা নেই, কারণ যাঁরা এত দিন পিছিয়ে ছিলেন তাঁরা আজ বুঝতে পেরেছেন যে, তাঁরা নিজেরা সংগঠিত না হলে বা সরব না হলে কেউ তাঁদের কথা শুনবে না।
আসলে সমস্যা হল, ১৯৫০-এর ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপ্ল অ্যাক্ট’ ভারতীয়দের ব্যক্তিনাগরিক বা ‘ইন্ডিভিজুয়াল সিটিজেন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই ব্যক্তিনাগরিক প্রার্থীদের নীতিগুলিকে যুক্তির ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে তাঁর ভোট দেবেন। ইলেকশন কমিশন যে নিয়মকানুন জারি করল তা-ও এই ব্যক্তিনাগরিকের ধারণাটিকে মাথায় রেখে। কিন্তু ভারতীয়েরা সামাজিক ভাবে কখনওই শুধুমাত্র ব্যক্তি-কেন্দ্রিক নয় আমরা সমষ্টির অঙ্গ। এই সমষ্টির প্রতি আনুগত্য থেকে বেরিয়ে এসে শুধুমাত্র নিজের বিচার-বুদ্ধি-যুক্তির ভিত্তিতে ভোট দেওয়া বেশির ভাগ ভারতীয়েরই চিন্তার মধ্যে ছিল না। তাই জাতপাত বা ধর্মীয় আনুগত্য বরাবরই নির্বাচনে কাজ করেছে কমবেশি, এবং আজ তা খানিকটা রাখঢাক ছেড়ে সোজাসুজি হচ্ছে। তার কারণ, এক দিকে যেমন হিন্দুত্বের রাজনীতি মান্যতা অর্জন করেছে, তেমনই অন্য দিকে পিছিয়ে-পড়া গোষ্ঠীগুলি এত দিনের চেষ্টাতেও ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে না পেরে খোলাখুলি জাতের আনুগত্যকে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করছে। এটা না করলে মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির ভিতর দিয়ে এ-সব জাতের নেতারা কোনও দিন মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন কি না সন্দেহ।
তা হলে কি এই জাতভিত্তিক রাজনীতি থেকে এখনও একটা নিষ্ক্রমণের রাস্তা খোঁজা যায় সুপরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষ, অগ্রবর্তী, দরিদ্রবান্ধব একটা বৃহত্তর রাজনীতির রাস্তা? এই আধুনিক জাতপাতের রাজনীতিকে পশ্চাৎপদ বলে চিহ্নিত করে এর থেকে বেরনোর রাস্তা খোঁজা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। ‘এথনিক লবি’ তো সব পশ্চিমী গণতন্ত্রেই কাজ করে। মার্কিন নির্বাচনে আফ্রো-আমেরিকান বা হিস্পানিক ভোটব্যাঙ্কের কথাও আমরা জানি। তাকে তো পশ্চাৎপদ রাজনীতি বলি না! তবে দলিত বা যাদব রাজনীতিকেই বা কোন যুক্তিতে পশ্চাৎপদ রাজনীতি বলব? হিন্দুত্বের রাজনীতিকে তো আমরা ঠেকাতে পারি না। এই সব ধরনের রাজনীতি তো আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচিতির রাজনীতির সঙ্গে যৃুক্ত। আর এই পরিচিতির রাজনীতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে না, এর সঙ্গে স্বীকৃতির একটা প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। গরিব ব্রাহ্মণের জাত্যভিমান একটি সাংস্কৃতিক পুঁজি, যা দলিতদের নেই। অন্য দিকে, এক জন দলিত ছাত্র পড়াশুনো করে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হলেও জাতের কারণে তাকে নানা রকম তির্যক মন্তব্য ও অপমান সহ্য করতে হয়। এই অস্বীকৃতি বা অপমানটা তার মনে বাজে। এর ফলেই পরিচিতির রাজনীতি বেঁচে থাকে। তাই শুধু দারিদ্র দূর করলেই হবে না, জাতপাতের কারণে কিছু লোককে যে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে হয়, এ কথা মেনে নিয়ে জনশিক্ষার মাধ্যমে সেটা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনও উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক নেতার উৎসাহ থাকবে বলে মনে হয় না, কারণ এতে তাঁর ভোট বাড়বে না, বরং কমবে। যাঁরা ভুক্তভোগী, এতে একমাত্র তাঁদেরই উৎসাহ থাকতে পারে।
কী মনে হয়, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে মণ্ডলায়নের আদি পর্বে ভারতীয় রাজনীতিতে জাতপাতের যে ভূমিকা ছিল, আজও কি তা-ই আছে? না কি, জাতপাতের রাজনীতির চেহারা চরিত্র বদলে গেছে? আজ যে সি পি আই এমের মধ্যে থেকেও আবদুর রেজ্জাক মোল্লা সামাজিক সুবিচার মঞ্চের দাবি তুলছেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বে দলিত ও সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের কথা বলছেন তার কারণ, গত ছয় দশকেরও বেশি সময়ে সেটা ঘটেনি। এই কারণেই মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট। তার কুড়ি বছর বাদেও যে একই দাবি উঠছে তার কারণ, অবস্থা একই রয়েছে। তবে পরিবর্তন অবশ্যই দেখা যাচ্ছে পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতে কিছু বেশি। পশ্চিমবঙ্গে সেই অম্বেডকর-পরবর্তী সামাজিক সচেতনতা সবে দেখা দিতে শুরু করেছে। পরিবর্তন যেটা লক্ষ করা যাচ্ছে সেটা হল, দলিত ও অন্যান্য পিছিয়ে-পড়া জাতিগোষ্ঠীগুলি এখন অনেক বেশি সংগঠিত হয়েছে। কিছু রাজ্যে তারা ক্ষমতাতেও এসেছে। সরকার চালাতে গিয়ে তারা এটাও বুঝেছে যে ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে অন্যান্য জাত ও দলের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে হবে। আর সেই সমঝোতাটা তখনই সমানে সমানে হবে যখন তারা নিজস্ব সংগঠনের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে দর কষাকষিটা করতে পারবে। আমার ধারণা সেটাই এখন হচ্ছে, আর আমরা, বর্ণহিন্দু আধুনিকতাবাদীরা অস্বস্তিতে পড়েছি, কারণ এই লোকগুলির সঙ্গে সমঝোতা করার অভ্যেস ও মানসিকতা আমাদের কোনও দিন ছিল না বা এখনও তৈরি হয়নি। জাতপাত আমাদের সমাজে আছে এবং এখন সময় এসেছে নীচের তলার লোকগুলির কথা শোনার, এই সরল সত্যটাকে মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। আমার মনে হয় সেটাই হবে প্রকৃত প্রগ্রেসিভ রাজনীতি ও সমাজনীতি। |
|
|
|
|
|