তাঁর মোবাইল ফোনে খদ্দেরদের অন্তত দু’শো নম্বর। আবার সেই খদ্দেরদের প্রায় অর্ধেকই কলকাতার বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া এবং ওই সব কলেজের হস্টেলের আবাসিক। ছাত্রের সংখ্যাই বেশি, তবে ছাত্রী যে একেবারে নেই, তা-ও নয়।
চরসের কারবারি রামকুমার রাই কলকাতার কোনও হোটেলে উঠে ফোনে যোগাযোগ করতেন তাঁদের সঙ্গে। আর সেই মতো ওই পড়ুয়ারা সেখানে গিয়ে নগদ টাকার বিনিময়ে নেশার জিনিসের ‘ডেলিভারি’ নিতেন। এসএসকেএম হাসপাতালের হস্টেলে এক ইন্টার্ন-এর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় যখন পড়ুয়াদের মাদক সেবনের বিষয়টি নিয়ে ফের তোলপাড় শুরু হয়েছে, সেই সময়ে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার হওয়া ওই মাদক কারবারির সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের যোগাযোগের কথা জেনে তদন্তে নতুন দিশা পাচ্ছেন লালবাজারের গোয়েন্দা দফতরের কর্তারা।
পুলিশি সূত্রের খবর, ওই পড়ুয়াদের একটা বড় অংশের উপরে রবিবারই গোয়েন্দারা নজরদারি শুরু করেছেন। তাঁদের কয়েক জনকে এই সপ্তাহেই লালবাজারে ডেকে পাঠানো হবে। রামকুমারের মতো শহরের বাইরে থেকে এসে অন্য কোনও মাদক কারবারি কলকাতায় ওই অবৈধ ব্যবসা করছে কি না, তা ওই হবু ডাক্তার, হবু ইঞ্জিনিয়ার ও জুনিয়র ডাক্তারদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করবেন গোয়েন্দারা। তাঁরা বোঝার চেষ্টা করবেন, চরস-সহ অন্য মাদকের নেশা ওই পড়ুয়াদের মধ্যে কতটা ছড়িয়ে পড়েছে। ওই নেপালি যুবকের সন্ধান কলেজের পড়ুয়ারা কী ভাবে পেলেন, তা নিয়েও গোয়েন্দারা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
নেপালি যুবক রামকুমার রাইকে শরৎ বসু রোডের একটি হোটেল থেকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রায় এক কিলোগ্রাম চরস ও নগদ ৫৪ হাজার টাকা-সহ গ্রেফতার করেন লালবাজারের নারকোটিক সেল-এর গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জেরায় রামকুমার তেমন সহযোগিতা না করলেও তাঁর মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া বিভিন্ন ফোন নম্বর থেকে ওই চরস-চক্রে সামিল কলকাতা ও আশপাশের শ’দুয়েক ক্রেতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
রামকুমারের মোবাইলে অবশ্য বিক্রেতাদের কারও সম্পূর্ণ নাম ছিল না। যোগাযোগের তালিকায় অধিকাংশ নাম-ই ছিল পদবিবিহীন কিংবা সাঙ্কেতিক।
গোয়েন্দারা প্রতিটি নম্বর ধরে ধরে ফোন করে ও মোবাইলের পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই দু’শো নম্বরের মধ্যে থেকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন অধিকাংশ খদ্দেরদের। যাঁদের পরিভাষায় ওই নেশার বস্তুর নাম ‘কালা’ কিংবা ‘ব্ল্যাক’।
এ বিষয়ে লালবাজারের এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, “মাদকের কারবারিরা কখনওই খদ্দেরদের নাম বলে না। কিন্তু রামকুমারের মোবাইল ফোনে ওই দু’শো নম্বর থাকাটাই এ ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করল।” তিনি জানিয়েছেন, অতীতে মাদকাসক্তদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা গিয়েছে, তারা সাধারণত কখনও কারবারিদের নাম বলে দেয় না। দু’পক্ষই পারস্পরিক গোপনীয়তা বজায় রাখে। যেটা এ বেলায় বজায় থাকল না বলে তদন্তকারী অফিসারদের দাবি। আর এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য, কিছুকাল আগে ভবানীপুর এলাকার এলগিন রোড ও গোখেল রোডের মোড় থেকে মাদকের এক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এসএসকেএম হাসপাতাল-সহ ভবানীপুরের কয়েকটি কলেজের পড়ুয়াদের মধ্যে সে নিয়মিত ভাবে মাদক বিক্রি করত। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনও খদ্দেরের নাম-ই মেলেনি।
তবে রামকুমারের মোবাইল থেকে হদিস পেয়ে লালবাজারের গোয়েন্দাদের একটি দল ওই চরস-চক্রের শিকড়ে পৌঁছতে সোমবার দিল্লি রওনা হয়েছেন। প্রসঙ্গত, আদতে নেপালের বাসিন্দা হলেও রামকুমার কয়েক বছর যাবৎ দিল্লিতেই আস্তানা গেড়ে ওই কারবার চালাচ্ছিলেন বলে গোয়েন্দারা দাবি করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক কালে প্রতি মাসেই রামকুমার লক্ষ লক্ষ টাকার মাদক নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। আর সেই মাদকের একটা বড় অংশই কিনতেন ওই পড়ুয়ারা।
এক গোয়েন্দা-কর্তা বলেন, “মাদকের নেশার ক্ষেত্রে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মধ্যে গাঁজা, চরস কিংবা খুব বেশি হলে হেরোইনের চল রয়েছে। কোকেনের নেশার খরচ খুব বেশি বলে তার চল অনেক কম।” এক বার কোকেন টানতে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয় বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন।
তবে ওই অফিসারের বক্তব্য, “নির্দিষ্ট খবর না থাকলে ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারির ছাত্রদের বা তাঁদের হস্টেলের ঘরে তল্লাশি চালানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া, হবু ডাক্তারেরা স্নায়ুর ওষুধ বেশি মাত্রায় নিয়ে নেশা করলে পুলিশ কী করবে?”
তবে এসএসকেএমে জুনিয়র ডাক্তারের রহস্যমৃত্যুর পরে শহরের প্রতিটি মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-হস্টেলের উপরে নজরদারি শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। আবাসিক পড়ুয়াদের মধ্যে কয়েক জনকে পুলিশ ‘চর’ হিসেবে রাখারও চেষ্টা করছে। কিন্তু পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে সেই চরেরাও যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়তে পারে, পুলিশের একাংশ এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিচ্ছে না। |