ঘোষণা মন্ত্রিসভার
ডিএ-র ক্ষতে প্রলেপ দিতে জোড়া মলম
শিয়রে লোকসভা নির্বাচন। সরকারি কর্মীদের মহার্ঘভাতা (ডিএ) বাকি ৪২%। এ অবস্থায় কর্মীদের জন্য সোমবার জোড়া প্রাপ্তির ঘোষণা করল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
এ দিন নবান্নে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে কর্মীদের আবাসন ও স্বাস্থ্যবিমা সংক্রান্ত দু’টি সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকার ঠিক করেছে, কর্মীদের জন্য তারা আবাসন বানিয়ে দেবে। কর্মীরা সস্তায় জমি পাবেন, বাড়ি তৈরির খরচ হিসেবে সহজ কিস্তিতে তাঁদের ঋণও দেওয়া হবে। স্বাস্থ্যবিমাতেও মিলবে বাড়তি সুবিধা। বর্তমানে রাজ্য সরকারি কর্মীদের জন্য যে স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প চালু আছে, তাতে হাসপাতালে চিকিৎসা-ব্যয় মেটানোর পরে সরকারের কাছ থেকে ওই টাকা ফেরত পাওয়া (রিইম্বার্সমেন্ট) যায়। এ বার চিকিৎসা-ব্যয়ের প্রথম এক লক্ষ টাকা সরকার সরাসরি হাসপাতালকে মিটিয়ে দেবে। অর্থাৎ, ‘ক্যাশলেস’ চিকিৎসার সুযোগ মিলবে। এক লক্ষের বাড়তি খরচ রিইম্বার্স করা হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের আড়াই বছর কাটলেও ডিএ-র প্রশ্নে কর্মীদের ক্ষোভ কাটেনি। বস্তুত বিরোধী ইউনিয়ন তো বটেই, তৃণমূল-সমর্থক কর্মী সংগঠনগুলির তরফেও এই মর্মে বার্তা পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলের বিভিন্ন নেতা। বিরোধী ইউনিয়নগুলির অভিযোগ: ক্ষমতায় আসার আগে ডিএ নিয়ে এখনকার শাসকদল যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাদের সরকার তা পূরণের সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না। বরং পূর্বতন বাম জমানার তুলনায় বকেয়া বেড়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীদের ডিএ-র ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ।
এবং ফারাক কমার কোনও লক্ষণও আপাতত নেই বলে বিরোধী সংগঠনগুলির অভিযোগ। তাদের দাবি, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষের রাজ্য বাজেটে সাকুল্যে এক কিস্তি (৬%) ডিএ-র জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। ফলে সময়ের সঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য ডিএ’র ব্যবধান বাড়বে বই কমবে না। তা হলে বকেয়ার কী হবে?
ভবানী ভবনে রাজ্য পুলিশের সদর দফতরের উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সুদীপ আচার্য।
রাজ্য সরকারি কর্মচারী মহলের ক্ষোভের কথা জেনে গত শনিবারই শাসকদলের সমর্থক সরকারি কর্মীদের সভায় এর জবাব দেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “আমাদের সরকার একটু স্বচ্ছল হলে বকেয়া ডিএ দিয়ে দেব।”
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে অবশ্য ক্ষোভ সম্পূর্ণ প্রশমিত হয়নি। উপরন্তু কেন্দ্রের সাম্প্রতিক একটি ঘোষণাও কর্মী মহলের একাংশের অসন্তোষ বাড়িয়েছে। গত নভেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশন গঠনের ঘোষণা করেছে দিল্লি, যার সুপারিশ কার্যকর হবে ২০১৬-র ১ জানুয়ারি থেকে। প্রথা অনুযায়ী, কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজ্যেরও বেতন কমিশন গড়ার কথা। কিন্তু ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিল্লিকে চিঠি দিয়ে বলেছে, বকেয়া ডিএ মেটাতে হলে এবং বেতন কমিশনের সুপারিশ ন্যূনতম মানতে হলেও বছরে অতিরিক্ত ৩১ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। কেন্দ্র তা জোগাতে রাজি থাকলে তবেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন বেতন কমিশন গড়বে বলে ওই চিঠিতে জানানো হয়েছে। ইউনিয়নগুলির বক্তব্য, রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সাম্প্রতিক বাজেট-বক্তৃতাতেও বেতন কমিশন গঠনের সামান্য আভাস নেই।
ক্ষোভের তালিকায় নতুন সংযোজন রাজ্যের বদলি-নীতি। দরকারে সচিবালয়ের কর্মীদের রাজ্যের যে কোনও জেলায় বদলি করা যাবে এই বিজ্ঞপ্তি কর্মীদের বড় অংশকে খুশি করতে পারেনি। সিনিয়রিটির বদলে দক্ষতা-ভিত্তিক পদোন্নতি ও বেতনবৃদ্ধির নীতি নিয়েও কিছু মহলে কিছু অসন্তোষ রয়েছে। উপরন্তু প্রশাসনের সদরকে মহাকরণ থেকে নবান্নে স্থানান্তরকে এখনও অনেকে মেনে নিতে পারেননি।
এ দিন রাজ্য মন্ত্রিসভার ঘোষণায় এমন বিবিধ ক্ষোভ প্রশমনেরই প্রয়াস দেখতে পাচ্ছে রাজ্য-কর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রশাসনিক কাজে সহায়তা পেতে শাসকদলের শীর্ষ নেতারা গত মার্চে সমর্থক-কর্মীদের সভা করেছিলেন। গত শনিবার এমনই এক সভার মঞ্চ থেকে কো-অর্ডিনেশন কমিটি ভেঙে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। সিপিএম-অনুগামী ওই কর্মী সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মনোজ গুহের দাবি, তাঁদের পতাকার নীচে এখনও ৮০% কর্মী রয়েছেন। তৃণমূলপন্থী কর্মী ইউনিয়নের নেতাদের একাংশও মানছেন, শাসনক্ষমতা বদল হলেও সদস্য-সংখ্যার বিচারে তাদের বিরোধী সংগঠন খানিকটা এগিয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের মতে, লোকসভা-বিধানসভা নির্বাচনে বুথের ভিতরে ভোট পরিচালনার কাজে সরকারি কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এই সরকারের আমলে লোকসভাই হচ্ছে প্রথম নির্বাচন, যেখানে ভোটকেন্দ্রের ভিতরে বড় ভূমিকা নেবেন সরকারি কর্মীরা। সেটা মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী কো-অর্ডিনেশন ভাঙার কথা বলেছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
একই সঙ্গে সে দিনের সভাতেই কর্মীদের জন্য জোড়া সুবিধার কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, যাতে এ দিন তাঁর মন্ত্রিসভার সিলমোহর পড়েছে। সরকারের ঘোষণা: কর্মীদের সহজ শর্তে গৃহঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ কথা জানিয়ে বলেন, “প্রাথমিক ভাবে ৫০ হাজার বাড়ি তৈরি হবে। পূর্ত দফতর বানাবে ৩০ হাজার, আবাসন দফতর ২০ হাজার। আবাসন প্রকল্প হবে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ (পিপিপি মডেল)-এ।” পার্থবাবু জানান, প্রাথমিক ভাবে গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি কর্মীদের জন্য বাড়ি হবে। প্রকল্পটি চলবে রাজ্য জুড়েই। তবে প্রকল্পের শর্ত কী, গৃহঋণে সুদ কত এ সব খুঁটিনাটি চূড়ান্ত হয়নি। অন্য দিকে রাজ্য-কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প চালু হয়েছে ২০০৯-এ। এতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে সরকারি কর্মীকে সব খরচ মেটাতে হয়। পরে আবেদনের ভিত্তিতে গ্রাহককে তা ফেরত দেয় সরকার। “এখন থেকে প্রথম এক লক্ষ টাকা ক্যাশলেস হবে। তার পরে বর্তমান নিয়ম আনুযায়ী আবেদনের ভিত্তিতে টাকা মিটিয়ে দেওয়া হবে।” এ দিন বলেন স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
বিরোধীরা অবশ্য সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে ছাড়েনি। কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “ভোটের আগে কর্মীদের বোকা বানানোর চেষ্টা হচ্ছে।” তাঁর দাবি, “সরকারি কর্মীদের জন্য প্রচুর ফ্ল্যাট ফাঁকা রয়েছে। সেগুলো কাউকে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি আবাসনে রক্ষণাবেক্ষণ শিকেয়। নতুন প্রকল্প না-করে এই কাজগুলো মুখ্যমন্ত্রী আগে করুন।” আইএনটিইউসি অনুমোদিত সরকারি কর্মী সংগঠন ‘কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ’-এর নেতা সঙ্কেত চক্রবর্তীর মন্তব্য, “শাসকদল বুঝেছে, লোকসভায় সরকারি কর্মীদের ভোট তারা পাবে না। তাই এখন নাকের বদলে নরুণ দিয়ে ভোট-বৈতরণী পার হতে চাইছে।” ডিএ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন ওয়েস্ট বেঙ্গল এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (নবপর্যায়)-এর নেতা সমীর মজুমদারও।
তৃণমূলের কর্মী সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন অবশ্য সরকারের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। সংগঠনের নেতা মৃগেন মাইতির প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেবেন। তাঁকে একটু সময় দিতে হবে। বেতন কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও মুখ্যমন্ত্রী জানেন। যথাসময়েই তা গঠন করা হবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.