|
|
|
|
সঙ্গীহারা লালু এ বার ভাঙনের টানাপোড়েনে
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি ও পটনা
২৪ ফেব্রুয়ারি |
এক নিঃসঙ্গতার ঘেরাটোপে লালুপ্রসাদ যাদব। সঙ্গ ছাড়ছে বন্ধু। দলেও ভাঙনের টানাপোড়েন।
এক সময় লোকমুখে গরিবো কা মসিহা হয়ে ওঠা আরজেডি-প্রধান ক’দিন আগেও সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, এখনও বিশ্বাস রাখেন প্রধানমন্ত্রী হবেন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দু’দিনে এক জোড়া ধাক্কার জেরে আরও কিছুটা কোণঠাসা, আরও নিঃসঙ্গ তিনি। দাগি তকমার কারণে সাংসদপদ খুইয়েছেন আগেই। রাজ্যেও তাঁর দল অনেক দিন ধরেই বিরোধী আসনে। আগামী লোকসভা ভোটে এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে যাঁকে সঙ্গী করে কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চেয়েছিলেন, সেই রামবিলাস পাসোয়ানই ধর্মনিরপেক্ষ জোট ছেড়ে বিজেপি-র সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু করেছেন। যে মোদীর বিরোধিতা করে এক সময় বিজেপি-র থেকে দূরত্ব তৈরি করেছিলেন, আজ সেই পাসোয়ানই তারিফ করছেন মোদীর। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই আজ আর একটি বড়সড় ধাক্কা। দিল্লিতে বসে লালু জানতে পারেন, দলের ২২ জন বিধায়কের ১৩ জনই পাড়ি দিয়েছেন নীতীশকুমারের দলে। তবে সহজে হাল ছাড়া ধাতে নেই। লালুকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, “এখনও জানি না কিছু।” কিন্তু রাজধানীতে বসেই শুরু হয় তাঁর ঘর আগলানোর মরিয়া চেষ্টা। ভাঙনের খবর প্রকাশ্যে এসেছিল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আরজেডি-র তরফে দাবি করা হয় ৫ বিদ্রোহীই ফিরে এসেছেন। এর কিছু বাদে জানানো হয় দলে ফিরে এসেছেন আরও এক জন। আর সন্ধে সাতটা নাগাদ আরজেডি-র রাজ্য সভাপতি আব্দুল বারি সিদ্দিকি পটনায় তড়িঘড়ি এক সাংবাদিক বৈঠক ডেকে হাজির করেন ১৩ জন বিধায়ককেই। বারি দাবি করেন, বিধানসভার স্পিকারের কাছে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাতে বিধায়কের সইগুলি জাল। আরজেডি-র এক জন বিধায়কও দল ছাড়েননি।
আরজেডি-তে ভাঙনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরে দল ভাঙানোর চেষ্টা নিয়ে জেডিইউ নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, তাঁর কিছুই জানা নেই। সাংবাদিকদের থেকেই প্রথম বিষয়টি জানতে পারলেন। নীতীশের কথায়, “সব সময় আমাকেই দায়ী করা হয়। খোঁজ নেব, প্রকৃতপক্ষে ক’জন আরজেডি ছেড়েছেন।”
লালুর দলের ভাঙনের কথা প্রকাশ্যে আসার কিছু পরেই ৬ জন দল ছাড়ার কথা অস্বীকার করেন। পরে সিদ্দিকি সাংবাদিক বৈঠকে ভাঙনের কথা উড়িয়ে দিলেও, সারা দিনের এই নাটক থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট। তা হল, লোকসভা ভোটের আগে লালু যে ভাবে শুধু বিহার নয়, জাতীয় স্তরেও নিজের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন, সেই প্রয়াস বড়সড় ধাক্কার মুখে।
এক সময় জরুরি অবস্থার হিরো। তার পর থেকে লালুর রাজনীতির যাত্রাপথে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। হুমড়ি খেয়েও ফের মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন বারবার। দু’দিন আগেও এক সাক্ষাৎকারে বলতে ভোলেননি, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা এখনও তাঁর ষোলো আনা। নীতীশকুমারের সঙ্গে বিজেপি-র বিচ্ছেদের পর থেকে ফের বুঝতে পারেন, বিহারে হারানো জমি ফিরে পাওয়ার ফের সুযোগ এসেছে। কংগ্রেস ও রামবিলাসের সঙ্গে মিলে জোট গড়ে নীতীশকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার স্বপ্নও দেখছিলেন।
কিন্তু হল কী?
বহু দিনের বন্ধু রামবিলাসও এখন সঙ্গ ছাড়ছেন। আর নিজেকেও মরিয়া চেষ্টা চালাতে হচ্ছে ঘর আগলাতে। বিধায়কদের একটি দল ইতিমধ্যেই বিধানভার অধ্যক্ষ উদয়নারায়ণ চৌধুরীকে চিঠি দিয়ে দল ছাড়ার কথা জানিয়ে দিয়েছিল। বিধানসভার সচিবালয় সন্ধের পরে ১৩ জন বিধায়কের নামে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আরজেডি-র ১৩ বিধায়ক দল ছাড়ায় তাঁদের আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে মানা হবে। যদিও পরে ৬ জন দল ছাড়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, “আমরা এ রকম কোনও চিঠিতে সই করিনি। দল ছাড়ার ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।” তার মধ্যে ললিত যাদব বলেন, “দল যে দিন ছাড়ব সে দিন বৈঠক করে সকলকে জানিয়ে যাব।” অন্য দিকে, আব্দুল গফুর বলেন, “এ রকম কোনও কাগজে আমি সই করিনি। অনেক সময় দলের এক জন বিধায়ক অন্যকে বিশ্বাস করেন। ফলে আমরা বিধানসভার বিভিন্ন কাগজে সই করে দিই। এটা ১৫বছর ধরে চলছে।” তাঁর অভিযোগ, “কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করেন তবে তো দলের বিধায়কদেরও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়বে।”
তবে আপাতত ভাঙন ধামাচাপা দেওয়া গেলেও দলে বিদ্রোহী মুখগুলি কিন্তু উদ্বেগেই রাখবে লালুকে। দলের প্রবীণ নেতা শকুনি চৌধুরির ছেলে সম্রাট যাঁদের অন্যতম। দল ছাড়া নিয়ে নাটকের মাঝের পর্বে তিনি এ দিন বলেন, “যে কংগ্রেস লালুকে জেলে পাঠাল, আজ তারই বি-টিমে পরিণত হয়েছে আরজেডি। লালুকে বাঁচানোর জন্য তৈরি অর্ডিন্যান্স যে রাহুল গাঁধী ছিঁড়ে ফেলার কথা বললেন, আজ তাঁদের কাছে গিয়েই তিন মাস ধরে আত্মসমর্পণ করে বসে রয়েছেন।” খুব ভুল বলেননি এই বিক্ষুব্ধ আরজেডি নেতা। দু’দিন আগেও দিল্লির গোটা সংবাদমাধ্যম যখন লালুকে ছেঁকে ধরে জিজ্ঞেস করছে, ‘রাহুল গাঁধীর উপর আপনার রাগ হয় না?’ তখনও লালু নিজস্ব ছন্দে সাংবাদিকদের ধমকে দিয়েছেন উল্টে। বলেছেন, “এই সব প্রশ্ন বিজেপি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মদতে করা হচ্ছে। রাহুল গাঁধীর কোনও দোষই নেই।” অথচ ঘরোয়া আলোচনায় লালু বরাবরই তাঁর কারাবাসের পিছনে রাহুলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এসেছেন। কিন্তু বিহারে পাসোয়ান-কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে নিজের জমি শক্ত করার স্বার্থেই সনিয়া-রাহুলের প্রশস্তি করছেন। এমনকী, জেল থেকে বেরোনোর সময়ও একই ভাবে কংগ্রেসের ভূয়সী প্রশংসা করে মোদীর বাপ-বাপান্ত করেছেন।
তাতেও শেষরক্ষা হচ্ছে না। রামবিলাস এখন বেসুরো গেয়ে সেই মোদীর ছাতার তলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর নিজের শক্তি বাড়ানো তো দূরস্থান, লালুর নিজের দলেই বড়সড় ভাঙনের মেঘ। যে নীতীশকে ধুলোয় মেশাতে চেয়েছিলেন, তিনিই আজ লালুর শিবিরে থাবা বসাচ্ছেন। এমন নয় যে, বিজেপি-র সঙ্গ ছেড়ে নীতীশ খুব একটা সুবিধেজনক অবস্থায় রয়েছেন। কিন্তু লালুর দল ভাঙনের আতঙ্ক ছড়িয়ে অন্তত তাঁর বিষাদের আবহেও কিছুটা অক্সিজেন জোগাতে পারবেন। দিল্লিতে কংগ্রেসের নেতারাও বলছেন, এর পরেও লালুর সঙ্গে বিহারে জোট করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কারণ, বিহারে তেমন শক্তি নেই কংগ্রেসেরও।
কিন্তু এ সবের মধ্যে যে ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন, যিনি নিজের প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছেন, তিনি কিন্তু লালুপ্রসাদ যাদবই।
আর এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের এই অবক্ষয়ে যিনি সকলের অলক্ষে হাসছেন, তিনি লালুর চরম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নরেন্দ্র মোদী। মোদী-শিবিরের নেতাদের মতে, বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে ঠেকানোর জন্য কংগ্রেস ও তাদের সহযোগী দলগুলি একযোগে সাম্প্রদায়িক জিগির তুলেছে। কিন্তু ভোট আসা পর্যন্তও সেই জিগির জিইয়ে রাখতে পারছে না। তাদের ভিতরেই এখন দক্ষযজ্ঞ বেধেছে। রামবিলাসের ছেলে চিরাগ এখনও জোট গড়ার বিষয়টি নিয়ে ধন্দে রেখেছেন, কিন্তু লালুর ‘সঙ্গী’ রামবিলাস তো অন্তত মোদীর জয়গান গাইতে শুরু করেছেন। আর যে কংগ্রেস দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও লালুর সঙ্গে গাঁটছড়া বাধতে চাইছে, আজ তাঁর দলেই ভাঙনের ডামাডোল। |
|
|
|
|
|