নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মধ্যেও ভাল থাকতেন তিনি। এক-দু’দিন নয়। টানা দু’বছর। আসলে ভাল থাকার সেই শক্তিটা তাঁকে জোগাত সঙ্গীত। নিজে ভাল পিয়ানো বাজাতেন। নাৎসি ক্যাম্পের সেই ভয়াবহ অত্যাচারের দিনগুলোতেও নানা রকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেখানকার বন্দিদের মুখে হাসি ফোটাতেন তিনি। নাৎসি অত্যাচারের সেই প্রবীণতম সাক্ষী অ্যালিস হার্জ সোমার মারা গেলেন গত কাল। বয়স হয়েছিল ১১০ বছর।
লন্ডনের এক হাসপাতালে দু’দিন আগে সংক্রমণের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন অ্যালিস। তাঁর নাতি অ্যারিয়েল সোমার একটি বিবৃতি দিয়ে ঠাকুমার মৃত্যুর খবর জানান। অ্যালিসের জীবন নিয়ে অতি সম্প্রতি তৈরি হয়েছে একটি
|
অ্যালিস হার্জ সোমার |
স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রও। ৩৮ মিনিটের ‘দ্য লেডি ইন নাম্বার সিক্স: মিউজিক সেভ্ড মাই লাইফ’ এ বছর অস্কারের জন্য মনোনয়নও পেয়েছে।
১৯০৩ সালে প্রাগের এক ইহুদি পরিবারে জন্ম অ্যালিসের। পড়াশোনা আর সঙ্গীতের আবহেই বেড়ে ওঠা। চেক লেখক ও দার্শনিক ফ্রান্জ কাফকা প্রায়ই অ্যালিসদের বাড়ি যেতেন। বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে কাফকার প্রসঙ্গ টেনেওছেন অ্যালিস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন চেকোশ্লোভাকিয়ার দখল নেয় হিটলার বাহিনী। অ্যালিসের পরিবারের লোকজন তখন দেশ ছেড়ে প্যালেস্তাইনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু বৃদ্ধা অসুস্থ মায়ের সেবায় রত অ্যালিস তখনও প্রাগে। সেখানেই তাঁর মাকে মেরে ফেলে নাৎসি বাহিনী। সালটা ১৯৪৩। জোর করে অ্যালিস ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে যাওয়া হয় আর এক চেক শহর টেরেজিনের এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। প্রায় ৩৫ হাজার ইহুদি তখন সেখানে বন্দি। অ্যলিসের স্বামী লিওপোল্ড সোমার ও একমাত্র ছেলে রাফায়েলও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ঠিক এক বছর পর লিওপোল্ড-আর অ্যালিস বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তার পর আর কখনও স্বামীকে দেখতে পাননি অ্যালিস। টেরেজিন ক্যাম্পে তখন অ্যালিসের বেঁচে থাকার আশ্রয় তাঁর ছেলে আর সঙ্গীত।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিয়ানো শেখা শুরু করেছিলেন। আর ১১০ বছর বয়স পর্যন্ত সেটাই ছিল ধ্যানজ্ঞান। কনসার্টে বাজিয়েছেন। টেরেজিনের ক্যাম্পেও বেঁচে ছিলেন ওই পিয়ানোটাকেই আঁকড়ে ধরে। অ্যালিস নিজেই এক বার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “জার্মানরা সেই সময় গোটা বিশ্বের কাছে নিজেদের খুব ভাল মানুষ হিসেবে দেখাতে চাইত। তাই মাঝে মধ্যেই নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। আমাকে ডাকত ওরা। দেখতাম ক্যাম্পের অত্যাচারিত, না খেতে পাওয়া, অসুস্থ মানুষগুলো কী ভাবে আমার পিয়ানো শোনার জন্য মুখিয়ে থাকত। আসলে ওই পিয়ানোটাই ওঁদের কাছে খাবারের কাজ করত।”
নাৎসি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে কয়েক বছর তেল আভিভে ছিলেন অ্যালিস। সেখানেও পিয়ানো শেখাতেন। ১৯৮৬ সালে পাকাপাকি ভাবে লন্ডনে থাকতে শুরু করেন। ২০০১ সালে মারা যান একমাত্র ছেলে রাফায়েলও। তবু হাসতে ভোলেননি অ্যালিস। সঙ্গীতই তাঁকে সেই প্রেরণা জোগাত। নাতি অ্যারিয়েল বলেছেন, “উনি আমাদের সঙ্গে হাসতেন। আমাদের ওঁর সঙ্গীতের মাধ্যমে মুগ্ধ করতেন। উনি ছিলেন প্রেরণা।” ‘দ্য লেডি ইন নাম্বার সিক্স...’ তথ্যচিত্রটির প্রযোজক ফ্রেডরিক বোহবটের কথায়, “আমরা যেন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, অ্যালিস সোমার মারা যেতে পারেন না।”
মৃত্যুতে বোধহয় বিশ্বাস করতেন না অ্যালিস নিজেও। নাৎসি অত্যাচার যাঁর অতীত, সেই অ্যালিসই বলতেন, “জীবন, ভালবাসা, প্রকৃতি, সঙ্গীত। সবই সুন্দর। আমাদের সব অভিজ্ঞতাই আসলে উপহার।” হাসপাতালে যাওয়ার আগের দিনগুলোতেও বিটোফেনের সুর নিজের পিয়ানোয় বাজিয়েছেন অ্যালিস। কারণ তিনিই বলতেন, “আমি ইহুদি। কিন্তু বিটোফেন আমার ধর্ম।” |