সন্ত্রাসের উত্তর ১
সেই ভুটানে ফের শিবির কেএলও-র
সোজা রাস্তায় টানা গাড়িতে গেলে তিন ঘণ্টার একটু বেশি। দূরত্ব তো দেড়শো কিলোমিটারও নয়।
তবে ওরা সোজা পথ ধরে না। একনাগাড়েও যায় না। ওদের রুট বিস্তর ঘোরানো-প্যাঁচানো। প্রথমে আলিপুরদুয়ার থেকে বাসে বারোবিশা। সেখান থেকে মারুতি ভ্যানে অসমের কোকরাঝাড় বাসস্ট্যান্ড। তার পরে ফের বাসে চিরাং টাউন। মোটরযানের পালা ওখানেই শেষ। এ বার বাহন সাইকেল। তাতে চড়ে ঘুরপথে ভুটান সীমান্তের এসএসবি (সশস্ত্র সীমা বল) ক্যাম্পের আশপাশে।
আর শেষের পুরো অংশটি পদব্রজে। একটু-আধটু নয়, গোটা একটা রাত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে কেএলও-র শিক্ষানবিশ জঙ্গিরা পৌঁছয় তাদের গন্তব্যে। জেলেফুর ট্রেনিং ক্যাম্পে।
জেলেফু। দক্ষিণ ভুটানের সারপাং জেলার ছোট্ট, ছিমছাম শহর। ভারতের লাগোয়া হওয়ার সুবাদে দু’দেশের বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রও। শহরের অদূরে জঙ্গল। জেলেফুর ওই অরণ্যেই ২০১২-র এপ্রিল থেকে চলছে কেএলও-র ‘বেস ক্যাম্প’ বা জঙ্গি প্রশিক্ষণের প্রাথমিক শিবির। অন্তত ভারতীয় গোয়েন্দাদের তেমনই দাবি। ওঁদের বক্তব্য, গত ২৬ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ির বজরাপাড়া-পাহাড়পুরে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে জেলেফু-ক্যাম্পের কথা জানা গিয়েছে। সম্প্রতি ধরা পড়া কেএলও’র একাধিক সদস্যও জেরার মুখে তার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছে।
তালিমের রুট
অর্থাৎ ভুটানি সেনার হাতে উৎখাত হওয়ার ন’বছরও পেরোয়নি, সেই ভুটানের মাটিতেই কেএলও নতুন ভাবে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। অথচ ২০০৩-এর ডিসেম্বরের ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’ ভুটানে ঘাঁটি গাড়া জঙ্গিদের মেরুদণ্ড কার্যত গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতীয় ফৌজের সঙ্গে সমন্বয় রেখে পরিচালিত অভিযানটিতে জেলেফু, সানড্রুপ ঝোংকার, কালীখোলার মতো নানা জায়গায় গজিয়ে ওঠা ভারতীয় জঙ্গিদের তিরিশটি শিবির ধ্বংস করে দেয় রয়্যাল ভুটান আর্মি ও রয়্যাল বডিগার্ডস। গোয়েন্দা হিসেবে, তিরিশটির মধ্যে আলফা-র শিবির ছিল ১৪টি, এনডিএফবি-র ১১টি, কেএলও-র পাঁচটি। কেএলও-র পাঁচ ক্যাম্পে ছিল চারশোরও বেশি জঙ্গি।
গোয়েন্দারা এ-ও খবর পেয়েছিলেন, ভুটানে তাড়া খেয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে গিয়ে শিবির গড়ে কেএলও। পরে ঢাকার হাসিনা সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ করায় বাংলাদেশ থেকেও হটতে হয়। ২০১০ থেকে মূলত মায়ানমারের গহন অরণ্যই হয়ে ওঠে কেএলও-র তালিম-কেন্দ্র। কিন্তু ২০১৪-র ২৮ জানুয়ারি কেএলও-র সহকারী সাধারণ সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকি ওরফে প্রাণনারায়ণ কোচ ও ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ নারায়ণ রায় ওরফে তরুণ থাপাকে গ্রেফতার করে জানা গেল, কেএলও তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে সেই ভুটানেই ফের জঙ্গি শিবির ফেঁদেছে। “এত দিন আমরা জানতাম, কেএলও-র ট্রেনিং ক্যাম্প চলছে শুধু মায়ানমারে। ইকবাল ও তরুণ থাপার জবানবন্দিতে ধারণাটা জোর ধাক্কা খেয়েছে।” স্বীকার করছেন রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা। শুধু তা-ই নয়, এ দফায় কেএলও-র বিস্তার আরও ব্যাপক বলেও তিনি জানিয়েছেন। কী রকম?
অফিসারের ব্যাখ্যা, “ওদের ক্যাম্প চলছে ভুটান-মায়ানমারে। মাথারা গা ঢাকা দিয়ে থাকছে নেপালে। আর নাশকতা হচ্ছে উত্তরবঙ্গে, অসমে। নেটওয়ার্ক কতটা ছড়িয়েছে, বুঝতে অসুবিধে নেই।”
তবে গোয়েন্দাদের দাবি: জেলেফু-র শিবিরে অস্ত্র-বিস্ফোরকের তালিম হয় না। ওটা আদতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শিবির (বেসিক ট্রেনিং ক্যাম্প)। কেএলও-য় সদ্য যোগ দেওয়া উত্তরবঙ্গ-অসমের তরুণদের ওখানে রেখে সংগঠনের নীতি ও আদর্শ বোঝানো হয়, পরিজন ছেড়ে দূরে থাকার অভ্যাস করানো হয়, সঙ্গে চলে শারীরিক কসরৎ ও ‘পজিশন ফর্মেশন’-এর শিক্ষণ। নতুন ‘রিক্রুট’দের ছোট ছোট দলে ভাগ করে জেলেফুর ক্যাম্পে এক মাস ধরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর্ব চলে। উত্তীর্ণ হয় যারা, পরের ধাপে তাদের পাঠানো হয় মায়ানমারের কাচিনে, যেখানে পুরোদস্তুর জঙ্গি কার্যকলাপের তালিম দেওয়া হয়। কাচিন ক্যাম্পের ‘ট্রেনিং-কোর্স’ তিন মাসের। সেখানে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহার-সহ নাশকতার খুঁটিনাটি শেখানো হয়। গোয়েন্দা-সূত্রের বক্তব্য: মায়ানমারের ক্যাম্পে কড়া ট্রেনিংয়ে পাঠানোর আগে আনকোরা ছেলেমেয়েদের যাতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণটা হয়ে থাকে, সেই লক্ষ্যেই কেএলও-র শীর্ষ নেতৃত্ব জেলেফু-শিবির তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।
এবং গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, জলপাইগুড়ি কোতোয়ালির ডাঙাপাড়া এলাকার পেদিপাড়া গ্রামের নারায়ণ রায় ওরফে তরুণ থাপাই ছিলেন কেএলও-র জেলেফু শিবিরের প্রথম ‘ক্যাম্প কমান্ডার।’ যিনি কিনা নিজে ২০০১-এ ট্রেনিং নিয়েছিলেন ভুটানেরই পিপিং শিবিরে, কেএলও-র চতুর্থ শিক্ষার্থী-ব্যাচের ক্যাডার হিসেবে। তরুণের পরে জেলেফুর ভার যায় সেবক বর্মন ওরফে জেমসের হাতে। বছরখানেক আগে তিনিও পুলিশের জালে পড়েন। সেই ইস্তক ময়নাগুড়ির টেকাটুলি গ্রামের জ্যোতিষ রায় ওরফে হাজং জেলাফুর ক্যাম্প কমান্ডারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। গোয়েন্দাদের এ-ও খবর, জেলেফু শিবিরে এখন ক্যাডার প্রায় ২০ জন। অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের, কিছু অসমের। নাগা জঙ্গি সংগঠন এনডিএফবি (সংবিজিত গোষ্ঠী)-ও জেলেফুতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শিবির চালাচ্ছে জেরার মুখে তরুণ এ তথ্যও দিয়েছেন বলে তদন্তকারীদের দাবি।
২০১২-র জুন মাস। জেলেফুতেই টম অধিকারী, মঞ্চলাল সিংহ ওরফে ডাক্তার, ইকবাল সিদ্দিকি ও তরুণ থাপার সঙ্গে দেখা করলেন কেএলও-র চেয়ারম্যান জীবন সিংহ।
(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.