প্রবন্ধ ২...
হাসপাতালে যে অভিজ্ঞতা হল
শীতের সকাল। বসে আছি সকাল সাড়ে ন’টা থেকে। এগারোটা নাগাদ পরিচিত এক মহিলার বড় অপারেশন। রোগটা বড়, সামর্থ্য সীমিত, সরকারি হাসপাতালে ভরসা পাওয়া গেছে। অপেক্ষা, কখন ডাক পড়বে। অভিজ্ঞরা বলে দিয়েছেন ঠায় বসে থাকতে। কখন দরকার লাগে, কিছু বলা যায় না।
বসে থাকতে থাকতে চত্বরটাকে এক মৌতাতের আসর মনে হতে লাগল। দাড়ি-পাঞ্জাবি-ঝোলা-ইন্টেলেকচুয়াল থেকে শুরু করে দূর জেলা থেকে চিকিৎসা করাতে আসা বৃদ্ধ, সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, মায় গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো ডাক্তার শ্রেণিবিভাজিত সমাজের চেনা ছবি।
অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হল আমাদের পেশেন্টকে। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে হাতে এল একটা স্লিপ: এক্ষুনি এই ওষুধগুলো কিনে আনতে হবে। ছুটলাম। ন্যায্য মূল্যের দোকানে বিরাট লাইন, অপারেশন শেষ হওয়ার আগে ওষুধ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। উপরন্তু ঝুঁকি, সব ওষুধ যদি ওখানে না পাওয়া যায়, বাকিগুলো বাজারের দোকানদাররা না-ও দিতে পারে গতকালই এ নিয়ে সমস্যা হয়েছে। সুতরাং, মুক্ত বাজার থেকে অন্যায্য মূল্যে ওষুধগুলো কেনা। সেটাও সহজ নয়। দালালের ভিড়। ওই দোকানে ২০%, ওখানে ২৫%। ফিরতে না ফিরতে আবার স্লিপ, আবার দৌড় এবং আবার ফেরামাত্র শুনলাম আমাকে আাবার খোঁজা হচ্ছে, রক্ত এনে রাখতে হবে, দরকার হতে পারে। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্তের কার্ড আগের দিনই নেওয়া ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে ব্লাড ব্যাঙ্কে। একটা ছোট্ট কাউন্টার, সামাল দেওয়ার জন্য এক জনই লোক, বাইরে তিন-চার রকমের লাইন কেউ কার্ড করাবেন, কেউ রক্ত নেবেন, কেউ রক্ত ফেরত দেবেন, ইত্যাদি। প্রতীক্ষার পর কাউন্টারে পৌঁছে হাতে পেলাম একটা রসিদ। সেটা নিয়ে এমার্জেন্সির ক্যাশ কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে আসতে এবং বদলি রসিদ এখানে দিয়ে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে।

ক্যাশ কাউন্টার প্রতীক্ষার পরীক্ষায়তন। ভাগ্যিস সঙ্গে আর এক জন ছিলেন! তিনি আগেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কাজ হল। আবার ব্লাড ব্যাঙ্ক। রক্তের প্যাকেট হাতে নেওয়া, যথারীতি প্রতীক্ষার পর। ইতিমধ্যে অপারেশন প্রায় শেষ। আমাদের বলা হল, রক্তটা ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে জমা করে আসতে, যেন দরকার হলে নেওয়া যায়। সেখানে নৈর্ব্যক্তিকতার প্রতিমূর্তি সেবিকারা বহুক্ষণ পরে মুখ তুলে চাইলেন। উদ্দেশ্য জানালাম। কিন্তু রজনী এখনও বাকি! রক্তের সঙ্গে দেওয়া রসিদের এবং খাতায় লেখা রোগীর বয়স মিলছে না। অতএব আবার ব্লাড ব্যাঙ্ক। তাঁরা প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিলেন যে, ভুলটা ডিপার্টমেন্ট থেকেই হয়েছে। আবার ডিপার্টমেন্টে কাকুতিমিনতি। শুদ্ধিকরণ এবং স্বাক্ষরের নীচে মোহর লাগাতে আরও প্রতীক্ষা এবং পুনরায় ব্লাড ব্যাঙ্কে যাওয়া। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক।
এর মধ্যে রোগীকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে আনা হয়েছে। জানলাম, এমনি দেখার লোক সে রকম কেউ নেই। দিনে রাতে একশো-একশো দুশো টাকা দিয়ে দু’জন আয়া রাখতে হবে। তাঁরাই এখানে সর্বেসর্বা। কর্তব্যরত নার্সরাও এই আয়াদের হাতেই ইঞ্জেকশন দেওয়া, স্যালাইনের বোতল বদল করা, সব দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন। শুনে ভয় হল, কিন্তু সেই ভয়টাই যে বাস্তব হবে ভাবিনি। বিকেলের দিকে আয়া এসে রোগীর স্যালাইনের বোতলটা বদল করে দিয়ে গেলেন, খানিক পরেই কর্তব্যরত ডাক্তার এসে আবিষ্কার করলেন স্যালাইনের নল দিয়ে কিছুই আসছে না। আয়াকে বলতেই তিনি ডাক্তার সহ সকলের সামনে এমন গলাবাজি শুরু করলেন যে চুপ করে যেতে বাধ্য হলাম। এঁদের হাতেই রেখে যেতে হয় প্রিয়জনদের। অবশ্য সবাই এক রকম নন, ওঁদের মধ্যেই কেউ কেউ এতই শুশ্রূষু যে, দেখে বিস্মিত হতে হল। তা হলে বাকিরা এমন কেন? হতে পারে প্রবল দারিদ্র, কাজের চাপ ও গার্হস্থ্য সমস্যায় জর্জরিত মানুষগুলো এ-রকমই হয়ে গেছেন। হয়তো বা পরপীড়নেই মুক্তি খুঁজে পান।
একটা জিনিস দেখে বিস্মিত ও নিশ্চিন্ত লাগল। ডাক্তাররা বার বার এসে দেখে যাচ্ছেন, খোঁজ নিচ্ছেন। যিনি অপারেশন করলেন, তিনি তো ঈশ্বরের প্রতিরূপ। সাবধান করে দিলেন, খুব সতর্ক থাকা দরকার, সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল। তিনি কোন দিক দিয়ে সংক্রমণের কথাটা বলেছিলেন জানা নেই, কিন্তু মহিলা বিভাগের শৌচালয়টা দেখার পর সংক্রমণ বিষয়ে শত ভাগ নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
রাত হল। আয়া বদল হল। রোগীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও ওয়ার্ডে বহু লোকের আনাগোনা, সারা দিন। নিয়ম আছে, কিন্তু ভাঙার আনন্দটা থেকে লোককে বঞ্চিত না-করার দয়ালু ব্যবস্থাও বহাল। যত্রতত্র থুতু ফেলা, চিৎকার করে কথা বলা, জোরে গাড়ির হর্ন বাজানো, হাসপাতালের ভেতরেই ধোঁয়া-ওঠা ভাতের দোকান, রোঁয়া-ওঠা কুকুরের কাঁদুনি...
সন্দেহ জাগে, এটা স্বাস্থ্য-বাজারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিমা নয়তো!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.