বিনোদন হারিয়ে যেতে বসেছে লোধা-শবরদের পালাগান
ঙ্গল ঘেরা লোধা-শবর গ্রামের এক প্রান্তে শালখুঁটির পালামঞ্চ। হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ, করতাল নিয়ে প্রস্তুত যন্ত্রীরা। মশালের শিখা খান খান হয়ে যাচ্ছে চাঁদনি রাতের মায়াবী আলো। ইতিমধ্যে বেজে ওঠে আবহসঙ্গীত। তির-ধনুক হাতে ‘শবর’ ও তাঁর সঙ্গিনী ‘শবরী’ মঞ্চে আসতেই শুরু আবালবৃদ্ধবনিতার তুমুল হর্ষধ্বনি।
৫০-৬০ বছর আগেও পশ্চিম মেদিনীপুরের সুবর্ণরেখা তীরবর্তী এলাকায় লোধা-শবরদের পাশাপাশি বাগদি সম্প্রদায়ের গ্রামে এমন লোকযাত্রা পালার দেখা মিলত হামেশাই। কিন্তু, দিন গিয়েছে তার! লোধা সম্প্রদায়ের প্রবীণরা জানাচ্ছেন, পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত লোধা-শবর গ্রামগুলিতে ‘শবর-শবরী’, ‘ললিতা শবর’ ও ‘চুড়িয়া-চুড়িয়ানি’র মতো লোক যাত্রাপালা খুবই জনপ্রিয় ছিল। কেশিয়াড়ি, সাঁকরাইল, নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর ১ ও গোপীবল্লভপুর ২ ব্লকের লোধা-শবরদের পাশাপাশি, দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও কমপক্ষে তিনশো বছর ধরে পালাগুলির চল ছিল। তবে, ওই পালাগুলির লিখিত কোনও রূপ ছিল না। পুরুষানুক্রমে মুখে মুখে তা শিখতেন কুশীলবেরা। শিখতেন আবহ সঙ্গীতের সুর।
গবেষকদের বক্তব্য, মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্য হলেও পালাগুলির বিষয়বস্তু থেকে লোধা-শবরদের সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ভৌগোলিক পরিবেশ ও ধর্মাচরণের পরিচয় পাওয়া যায়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি গবেষণা প্রকল্পের অধীনে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান ইন্দ্রনীল আচার্যের তত্ত্বাবধানে বাংলার বিপন্ন লোকনাটকের ধারার সংরক্ষণ এবং অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে লুপ্তপ্রায় লোধা-শবরদের পালা ‘চুড়িয়া-চুড়িয়ানি’কেই বেছে নিয়েছেন ইন্দ্রনীলবাবুরা। সেই কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে গবেষকদের।
অঙ্কন : সুমন চৌধুরী।
কেন?
গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ইন্দ্রনীলবাবুর কথায়, দীর্ঘ দিন পালাগুলি মঞ্চস্থ না হওয়ায় কুশীলবদের অভিনয়ের ধার কমেছে। নতুন প্রজন্মের কোনও অভিনেতা উঠে আসেননি। বেশির ভাগ শিল্পীর বয়স হয়েছে। বর্তমান লোধা-শবর সম্প্রদায়ের মধ্যে পালাগুলির সম্পর্কে তেমন আগ্রহও নেই। তিনি বলেন, “পালাগুলিকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি, নতুন প্রজন্মের অভিনেতা তৈরি করে নিয়মিত মহড়া ও মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করতে না পারলে এই লুপ্তপ্রায় ‘পারফর্মিং আর্ট’কে বাঁচিয়ে রাখা মুস্কিল।” তাঁর মত, এ জন্য সরকারি স্তরে পদক্ষেপ প্রয়োজন। আমরা গবেষণা প্রকল্পের চূড়ান্ত রিপোর্টে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখব।
বেসরকারি উদ্যোগে অবশ্য এই ধরনের লোকযাত্রার পুনরুজ্জীবনের কাজ শুরু হয়েছিল আড়াই দশক আগে। নব্বইয়ের দশকে রাঢ় বাংলার লোকসংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রথম লোধা-শবরদের পালগুলিকে পাদপ্রদীপে নিয়ে আসেন। ২০০৪ সালে সুব্রতবাবু নিজের উদ্যোগে লোধাদের চারটি যাত্রাদল গড়েন। কিন্তু পেশাদারি ভাবে দলগুলিকে চালানো যায়নি। সুব্রতবাবু বলেন, “লোধাদের লোকযাত্রা সংরক্ষণ করতে গেলে সরকারি স্তরে দলগুলিকে নানা অনুষ্ঠানে পালা মঞ্চস্থ করার সুযোগ দিতে হবে। দ্রুত নগরায়ণ ও সাংস্কৃতিক সংকটের কারণেই পালাগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে। বহুবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনও লাভ হয়নি।” তিনি জানান, ৬০-৭০ বছর আগেও সুবর্ণরেখা নদী তীরবর্তী এলাকার গ্রামে গ্রামে এই পালাগুলিই ছিল প্রধান বিনোদন। সে সময় যাত্রাদলের সংখ্যা ছিল ৮৫টি। সেই সংখ্যাটা কমতে কমতে এখন গোটা সাতেক-এ এসে দাঁড়িয়েছে। সেই দলগুলির অবস্থাও ক্ষয়িষ্ণু বলে তাঁর অভিমত।
“সরকার উদ্যোগী না হলে কী ভাবে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখব!”
বাদল গুরু কুশীলব
লোধা লোকযাত্রার প্রবীণ শিল্পী নয়াগ্রামের বাবুলাল ভক্তা, গোপীবল্লভপুরের ভূষণ শবরদের আক্ষেপ, “পালাগানের মহড়া দিয়ে কী হবে? এখন আমাদের নাতি-নাতনিরাই আর ও সব দেখতে চায় না। পালা করার ডাকও আসে না!” তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, সাঁকরাইলের বহড়াদাড়ি গ্রামের বাগদি সম্প্রদায়ের যাত্রাদলটি প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ‘চুড়িয়া-চুড়িয়ানি’ পালাটি মঞ্চস্থ করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। দলের কুশীলব বাদল গুরু, গয়াপ্রসাদ গুরু-র প্রশ্ন, “সরকার উদ্যোগী না হলে কী ভাবে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখব!”
এই পরিস্থিতিতে বাদলবাবুদের পাশাপাশি, নারায়ণগড় ব্লকের ফটিক মিদ্যার মতো নতুন প্রজন্মের হাতে গোনা ক’য়েক জন সংস্কৃতিপ্রেমীর নিজেদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা লোধা-শবর সমাজের সবচেয়ে বড় ভরসা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.