করলা কখন আসে, পথ চেয়ে শিবপ্রসাদ
কুশে ফেব্রুয়ারি আসে আর যায়। ইমানুলের ছিটমহলে আয়েষার পা পড়ে না।
জোড়া নিম গাছের কোল ঘেঁষে খানিক এগিয়েই রাস্তাটা ফুরিয়ে গিয়েছে মরা সোঁতার কোলে। শুকনো জলধারার পাশেই বিএসএফের চৌকি। করলা ছিটমহলের লক্ষ্মণরেখা।
মাইল পাঁচেকের মাঠ ভাঙলে বাঁশঝাড়, যজ্ঞিডুমুরের ছায়ায় আরও এক মৌজা, শিবপ্রসাদ ছিটমহল। সীমানা ভাঙলে সে ছিটেও আছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোখরাঙানি এনকাউন্টার দিখলা দুঙ্গা (গুলি করে দেব)!
তবুও কোচবিহারের দিনহাটা এলাকার সেই সব ছিটের মানুষ রুজির টানে ঝুঁকি নিয়েই পা রাখেন গাঁয়ের বাইরে। নাম ভাঁড়িয়ে নিবাস বলেন দূর কোনও গ্রামের। ছিট থেকে কাজের খোঁজে, স্কুলে পড়তে কিংবা চিকিৎসার সুযোগ নিতে চুপিচুপি পৌঁছে যান ছোট্ট জনপদ নয়ারহাটে। করলা আর শিবপ্রসাদ, বাংলাদেশের দুই ছিটমহলের মাঝে হাইস্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, খানকয়েক মনিহারি দোকান নিয়ে মরুদ্যানের মতো সেই গঞ্জটি ভারতীয় ভূখণ্ডে।
সেই নয়ারহাটেই দেখা হয়েছিল ইমানুল শেখ আর আয়েষা খাতুনের (নাম পরিবর্তিত)। কাজের খোঁজে বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে শিবপ্রসাদ ছিটমহলের বাইরে পা দেওয়া ছেলেটি স্কুলের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। করলার ছিট থেকে সেই স্কুলেই পড়তে আসত ক্লাস নাইনের আয়েষা। দুই বাড়িতেই সম্মতি ছিল। এক দিন নিকাহ্ও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। দিন স্থির হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। সে দু’বছর আগের কথা।
আয়েষার বাবা আব্দুল বারি বলেন, “ছিটের বাসিন্দাদের কোনও পরিচয় নেই বাবু। না ভোটার কার্ড, না রেশন কার্ড। পরিচয় শুধু ছিটমহলের বাংলাদেশি।” ছিটে বিয়ে দেওয়া তাই দুরূহ। মেয়ের বিয়ে ঠিক করতে পেরে আব্দুল বারির তাই মনে হয়েছিল ‘জন্নতের দুয়ারে’ পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁর মনে পড়ে, “কথাবার্তা পাকা হল। কত দেনমোহর দিতে হবে, তাও ঠিক হল।”
কিন্তু বিয়ের দিন কয়েক আগে হঠাৎই দুই ছিটমহলে বিএসএফের ব্যাটেলিয়ন বদলে যায়। নতুন পোস্টিং। সদ্য দায়িত্ব নেওয়া বিএসএফ কর্মীরা বিয়ের আগের রাতে ফতোয়া দেয় ছিটের বাইরে কেউ পা দেবে না! শিবপ্রসাদ আর করলা, গা ঘেঁষাঘেঁষি করা দুই ছিটমহলের আর কুটুম হয়ে ওঠা হল না। শুক্রবার, ভাষা দিবসে শিবপ্রসাদ ছিট থেকে ফোনে বাজে ইমানুলের বিষণ্ণ গলা, “দু’টো বছর কেটে গেল। আয়েষার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।”
দীর্ঘদিন ধরেই ছিটের মানুষজনের অভাব-অভিযোগ নিয়ে কাজ করা ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল সমন্বয় কমিটি’র কর্তা দীপ্তিমান সেনগুপ্তের আক্ষেপ, “ছিটের মানুষের বেঁচে থাকাটাই বিড়ম্বনা। সেখানে বিয়ে তো দুষ্কর ব্যাপার। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কও নিয়ন্ত্রণ করে বিএসএফ।” কমিটির সদস্য রাজু ভট্টাচার্য জানান, “কোচবিহারের সব ছিটেই সে দিন বিএসএফের নতুন ব্যাটেলিয়ন মোতায়েন হয়েছিল। তাদের ফতোয়ায় শুধু বিয়ে বন্ধ হয়নি, থমকে গিয়েছে আয়েষার স্কুলে যাওয়া। ছিটের বাইরে কাজের খোঁজে পা রাখাও বন্ধ ইমানুলের।”
বিএসএফের ডিআইজি (উত্তরবঙ্গ) দলবীর সিংহ সাঁধুর ব্যাখ্যা, “বাংলাদেশের ছিটমহলের বাসিন্দাদের এ দেশে পা রাখাই নিষেধ। মানবিকতার খাতিরে কখনও-কখনও তাঁদের ছিটের বাইরে যেতে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই সব ছিটে নতুন ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে গ্রামের মানুষের ‘সম্পর্ক’ই গড়ে ওঠেনি এখনও। হয়তো সেই কারণেই সে দিন বিয়ের ছাড়পত্র দেয়নি বিএসএফ।”
নয়ারহাটের পঞ্চায়েত প্রধান, তৃণমূলের অশ্বিনী রায়ের আক্ষেপ, “ওঁরা এমনই বন্দি যে ছিটের মধ্যেই পাত্র-পাত্রী খুঁজে বিয়ে দিতে হয়। অনেক সময়ে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুই ছিটের মধ্যে ওই বিয়েটা হলে অন্তত একটা নতুন পথ দেখাতে পারত।”
“ভাষা দিবসে ছিটের মধ্যেই একটা অনুষ্ঠান করলাম। করলার ছিটেও সে খবর পাঠিয়েছিলাম। আশা ছিল, যদি কোনও ভাবে আয়েষা আসে। নাঃ, এ বারও আসতে পারল না!”
ইমানুলের গলা বুজে আসে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.