ঘরে ঢুকে দেখা গেল, বছর সতেরোর কিশোরী গলায় শাড়ির ফাঁস দিয়ে ঝুলছে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে। কপালে সিঁদুর। দেহে প্রাণ নেই। মেঝেয় পড়ে তার প্রেমিক। কীটনাশক খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই যুবক আপাতত কলকাতার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি। ঘর থেকে মেয়েটির লেখা একটি সুইসাইড নোট পেয়েছে পুলিশ। দু’জনের স্বাক্ষরও আছে তাতে। লেখা, “আমরা এক সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। কেউ মেনে নিল না। সেই জন্য এক সঙ্গে চলে যাচ্ছি।”
বুধবার সন্ধ্যায় হাবরার হিজলপুকুর বিদ্যাসাগর রোড এলাকার এই ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশের অনুমান, ওই কিশোরী ও তরুণের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তা মেনে নিতে রাজি ছিলেন বাড়ির লোকজন। যে কারণে আত্মঘাতী হয়েছে প্রিয়া সাহা নামে কিশোরীটি। আত্মহত্যার চেষ্টা করে তার প্রেমিক বছর বাইশের অভিজিৎ দে। যদিও অভিজিতের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে হাবরা থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রিয়ার বাবা-মা। ওই যুবকের দিদি-দাদার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ করেছেন তাঁরা। খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হলেও গ্রেফতার করা হয়নি কাউকে। প্রিয়ার দেহ ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে বারাসত জেলা হাসপাতালে। তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেই রিপোর্টের অপেক্ষা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, বছর তিনেক ধরে প্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অভিজিতের। ওই যুবক একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। স্বচ্ছ্বল পরিবার। অন্য দিকে, প্রিয়ার বাবা পিন্টুবাবুর ফটোকপির ব্যবসা। অর্থাভাবে দিন কাটে। বড়লোকের বাড়ির ছেলের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক মেনে নিতে রাজি ছিলেন না পিন্টুবাবুরা। আপত্তি ছিল উল্টো দিক থেকেও। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়েকে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে দিতেও রাজি ছিলেন না পিন্টুবাবুরা। যে কারণে, পিন্টুবাবু সস্ত্রীক বাড়ি থেকে বেরোলে মেয়েকে বাড়িতে তালাবন্ধ করে চাবি নিয়ে চলে যেতেন। ফটোকপির দোকানে রোজই যেতেন স্বামী-স্ত্রী। ফলে দিনের অনেকটা সময় বাড়িতে তালাবন্ধ অবস্থায় কাটাতে হত ওই কিশোরীকে। মাস তিনেক ধরে চলছিল এই পরিস্থিতি। স্কুল কিংবা প্রাইভেট টিউটরের কাছে যেতে হত বাবা-মায়ের সঙ্গে।
পুলিশ জানতে পেরেছে, ওই তালার একটি নকল চাবি তৈরি করিয়েছিলেন অভিজিৎ। তা দিয়ে তালা খুলে মাঝে মধ্যে প্রিয়ার বাড়িতে ঢুকে পড়তেন। তদন্তকারী অফিসারদের অনুমান, বুধবার সন্ধ্যাতেও সে ভাবেই ঘরে ঢুকেছিলেন। প্রেমিকার কপালে সিঁদুর দেন। তারপরে দু’জন বিষ খান। পরে প্রিয়ার ঝুলন্ত দেহ মেলে।
সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ মায়ের মোবাইলে ফোন করেছিল প্রিয়া। ব্যস্ত থাকায় ফোন কেটে দেন মা। পরে ফোন করে দেখেন, মেয়ের মোবাইল ‘স্যুইচড অফ।’ তখন তিনি ফোন করেন অভিজিৎকে। ওই যুবক জানান, তিনি অন্যত্র আছেন। কথা বলতে পারবেন না। অভিজিৎ অবশ্য ফোন করেছিলেন দিদি রেখাকে। তিনি বলেন, “সাড়ে ৭টা নাগাদ ভাইয়ের ফোন আসে। ও বলে, বিষ খেয়েছে। চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যেন চিন্তা না করি।” ফোন আসার পরে অভিজিতের দিদি-দাদারাই প্রিয়ার বাড়িতে হাজির হন। তাঁরাই ঘরে ঢুকে বের করে আনেন অভিজিৎকে। তত ক্ষণে মেয়ের বাবা-মাও চলে এসেছেন।
মেয়েকে খুনের অভিযোগ তুলে উত্তেজিত হয়ে পড়েন পিন্টুববাবুরা। এলাকার কিছু লোক চড়াও হয়ে ভাঙচুর চালায় অভিজিতের বাড়িতে।
প্রিয়ার মা বলেন, “এই সম্পর্কে প্রথমে আমাদের আপত্তি ছিল ঠিকই, কিন্তু পরে মেনে নিই। গত লক্ষ্মীপুজোর দিন ছেলেটিকে খেতেও ডেকেছিলাম বাড়িতে। বলেছিলাম, তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। মেয়ে আর একটু বড় হোক, পড়াশোনা করুক। তারপর বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে। কিন্তু ওরা যে এ ভাবে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করত, সে কথা কোনও ভাবে বুঝতে পারিনি।” |