বাংলার মেয়েরা তোমরাই প্রধান
কন্যাশ্রী, কন্যাশ্রী সরকারের দান
কন্যাশ্রী, কন্যাশ্রী মমতার দান
অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ শ্রেণিতে
পড়লে পাবে পাঁচশো টাকা
ভুল করে পড়াশুনো
ছেড়ো নাকো আর।
মাইক হাতে নিজের লেখা ও সুরে গানটি গাইছেন লোকশিল্পী শিখা অধিকারী। তালে-তালে হাততালি দিচ্ছে ছাত্রীরা। বৃহস্পতিবার সকালে নদিয়ার রানাঘাট লালগোপাল বালিকা বিদ্যালয়ে সে যেন এক দৃশ্য।
স্কুলে হঠাৎ গান-বাজনা কিসের?
খোঁজ নিয়ে জানা গেল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রচারেই এত আয়োজন। গত মঙ্গলবার রানাঘাট রবীন্দ্র ভবন সার্ধশতবর্ষ মঞ্চে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের উদ্যোগে পণপ্রথা, নারী পাচার, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, কন্যাশ্রী প্রকল্পের কার্যকারিতা বিষয়ক কর্মশালা ও প্রচারাভিযানের আয়োজন করা হয়েছিল। লোকশিল্পের বিভিন্ন শাখার ২৮ জন শিল্পী ও তাঁদের এক জন করে সহকারী এতে যোগ দিয়েছিলেন। শিল্পীরা ওখানে বসেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গান রচনা করেন ও সকলের সামনে তা পরিবেশন করেন। এর মধ্য থেকে বেশ কয়েকটি গানকে কন্যাশ্রী প্রকল্প প্রচারের কাজে ব্যাবহার করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। বাছাই করা সেই গানেরই একটি এদিন রাণাঘাটের ওই স্কুলে গেয়ে শোনান লোকশিল্পী শিখাদেবী। অনুষ্ঠান শেষ করে বছর পঞ্চাশের শিখাদেবী বলেন, “পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠান করছি। কিন্তু গান গেয়ে এত আনন্দ পাইনি আগে। এই গানটা নিজেই লিখে সুর দিয়েছি। সকলের ভাল লাগছে। এর থেকে বেশি পাওয়ার কি আছে?” শিল্পী হরিদাস সাহা, স্বপনকুমার বিশ্বাস বলেন, “অনুষ্ঠান করে ২৫০-৩৫০ টাকা পাই। তাও সারা বছর কাজ হয় না। গড়ে মাসে দিন পনেরো কাজ হয়। অনেক কষ্টে দিন কাটাই। সব কিছুর মাঝেও এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে এসে খুব আনন্দ পাচ্ছি। যেখানেই যাচ্ছি সকলে খুশি হচ্ছে।” গান-বাজনায় খুশি স্কুলের কলা বিভাগের একাদশ শ্রেণির পূজা চৌধুরী, অষ্ঠম শ্রেণির সায়নী চক্রবর্তীরা। সামাজিক প্রকল্পের প্রচারে প্রশাসনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান শিক্ষিকা রুমা ভদ্র সিকদার বলেন, “বিদ্যালয়ে এগারোশো ছাত্রীর মধ্যে ৪৩৬ জনকে কন্যাশ্রীর কার্ড করানো হয়েছে। তবে, অনেকেই বিষয়টি জানে না এখনও। সহজ ভাবে গান গেয়ে তাদের বিষয়টি জানানোর এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।”
জেলার ভারপ্রাপ্ত তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক রানা দেব দাস জানান, লোকশিল্পীদের এই দল বুধবার থেকে প্রচার শুরু করেছে। তিন দিনের রানাঘাট মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় ১৬টি বালিকা বিদ্যালয়ে যাবে তারা। প্রতি দলে একজন সঙ্গীতশিল্পী ও পাঁচ-ছয় জন করে যন্ত্রশিল্পী রয়েছেন। রানাবাবু বলেন, “ওই সব বিষয় ছাড়াও আগামী দিনে বিভিন্ন সরকারি দফতরের প্রচারে ওই সব শিল্পীদের কাজে লাগানো হবে।”
শুধু কন্যাশ্রীর প্রচার নয়, তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বাউল গান, কবিগান ও পুতুল নাচের মতো লোকশিল্পের বিভিন্ন শাখার শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে জেলায়। প্রাথমিক পর্যায়ে রানাঘাট মহকুমা দিয়ে শুরু হয়েছে। আগামিদিনে বাকি মহকুমাগুলিতেও এই কর্মসূচি নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে লোকশিল্পীরা যেমন আর্থিক ভাবে উপকৃত হবেন, তেমনই স্কুল পড়ুয়া থেকে সাধারণ লোকজনের কাছে খুব সহজ-সরল ভাবে বিষয়গুলো তুলে ধরা সম্ভব হবে।
বস্তুত সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসা লোকশিল্প চর্চা এখনও যাঁরা করে থাকেন, তাঁদের অধিকাংশেরই পেশা অন্য। শুধুমাত্র ভাললাগার কারণেই লোকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা। এই দিয়ে সংসার চলে না। এই কাজে আর্থিক সাহায্য পেলে লোকশিল্পীরাও মন দিয়ে চর্চা করতে পারবেন। প্রশাসনের এই উদ্যোগকে তাই সমর্থন করছেন বিশিষ্টজনেরাও। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের প্রধান তপনকুমার বিশ্বাস বলেন, “সত্যিই খুব ভাল কাজ। প্রশংসা না করে পারছি না। এটা লোকসংস্কৃতির ব্যাবহারিক দিক। এতে সকলেরই ভাল।” |