বিজেপির দাবি মেনেই বিল পাশ রাজ্যসভায়
বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ২২ মিনিট। ভূমিষ্ঠ হল তেলঙ্গানা, দেশের ২৯তম রাজ্য। যে বিল পাশ করাতে গিয়ে গত কয়েক দিন ধরে অভূতপূর্ব হট্টগোলের ছবি দেখেছে লোকসভা এবং রাজ্যসভা। আজকের দিনটাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বক্তৃতা দিয়েছেন, আর তাঁকে চার দিক থেকে ঘিরে পাহারা দিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদরা! ওয়েলে নেমে তখন চিৎকার করছিলেন তৃণমূলের সাংসদরা। এর মধ্যেই সীমান্ধ্রের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের দাবি তোলে বিজেপি। সেই দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না কংগ্রেসের। তার পরেই ধ্বনি ভোটে পাশ হয়ে যায় বিল।
এর পরে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সই ও বিজ্ঞপ্তি জারির মতো কিছু আনুষ্ঠানিক সরকারি কাজ বাকি রয়ে গেল। সেগুলি বাদ দিলে বলা যায়, ১৩ বছর পরে আবার নতুন রাজ্যের জন্ম হল দেশে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ় ও উত্তরাখণ্ডের জন্মের সময় এত হট্টগোল হয়নি। সে দিক থেকে তেলঙ্গানার জন্ম আলাদা বইকি। শুধু দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ইতিহাসই নয়, ইউপিএ জমানার দ্বিতীয় ইনিংসে সংসদ অধিবেশনের অধিকাংশ সময়ই গিলে নিয়েছে এই বিল। দশ বছর আগে ক্ষমতায় আসার সময়ে ইউপিএ-র সঙ্গী ছিল তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বা টিআরএস। পৃথক তেলঙ্গানা গঠনের আশ্বাস দিয়ে ২০০৪-এ লোকসভা ভোটে লড়েছিল তারা। কিন্তু তার পর প্রায় এক দশক কেটে গিয়েছে, প্রবল দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে বিল থেকে গিয়েছিল হিমঘরে। প্রথম জমানায় তো হয়ইনি, দ্বিতীয় জমানাতেও তা পাশ হবে কি না, তা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছিল সংশয়।
কিন্তু রাজশেখর রেড্ডির ছেলে জগন্মোহনের উত্তরোত্তর রাজনৈতিক বাড়বৃদ্ধিকে মোকাবিলা করতেই শেষ পর্যন্ত বিল নিয়ে ঠেলা দিলেন সনিয়া গাঁধী-রাহুল গাঁধী। তার পরেই ঝোড়ো ইনিংস খেলে স্লগ ওভারে ম্যাচ বার করে নিয়ে গেল সরকার।
রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সময় তৃণমূলের বিক্ষোভ। ছবি: পিটিআই।
কিন্তু ম্যাচ কি সত্যিই বেরোল? তেলঙ্গানায় যদি কংগ্রেসের প্রভাব রক্ষা সম্ভব হয়ও, বাকি অন্ধ্র নিয়ে প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে বিজেপি যে ভাবে আজ সীমান্ধ্রের বিশেষ প্যাকেজের জন্য সরব হয়েছে, তাতে স্পষ্ট, দুর্বল প্রতিপক্ষ হলেও সহজে জমি ছাড়তে তারা নারাজ। এর বড় কারণ, বিজেপি বরাবরই পৃথক তেলঙ্গানা গঠনের পক্ষে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে তারা শেষ মুহূর্তে বিল পাশ করাতে কংগ্রেসকে সাহায্য করল কেন? নিজেরা ক্ষমতায় এলেই তো তেলঙ্গানা গড়তে পারত। বিজেপির মধ্যে এই প্রশ্ন উঠলে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি দলকে বোঝান, তেলঙ্গানা ঝঞ্ঝাট এখন মিটে গেলে তাঁদেরই ভাল। তা হলে ভবিষ্যতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে এই নিয়ে আর তাদের মাথাব্যথা থাকবে না।
তবে এই যুক্তিতে লোকসভায় বিল পাশ করতে দিলেও পরে বিজেপি নেতারা বুঝতে পারছিলেন, তাঁদের এমন কিছু করা উচিত যাতে অন্ধ্রের দুই অঞ্চলে মানুষের মনে কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করা যায়। তাই রাজ্যসভায় বিল পেশের আগে বিজেপি একাধিক নতুন প্রস্তাব আনে। সেই তালিকায় ছিল সীমান্ধ্রের জন্য বিপুল আর্থিক প্যাকেজের দাবি।
রাজ্যসভায় বিল পাশ করানোর স্বার্থে সেই দাবি মানা ছাড়া সরকারের পথও ছিল না। তবে কৌশলে কাল রাত থেকেই কংগ্রেস চাউর করে দেয়, আগামী পাঁচ বছরের জন্য সীমান্ধ্রকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন সনিয়া। আজ বিতর্কে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও বলেন, রাজ্য ভাগের পর অন্ধ্রকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে আর্থিক সাহায্য দেবে কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী এই আশ্বাস দেওয়ার পর রাজ্যসভায় বিল পাশে বিজেপি আর বাধা দেয়নি।
বিল পাশের পর এক শীর্ষ কংগ্রেস নেতা বলেন, এমন নয় যে সীমান্ধ্রের জন্য হাল ছেড়ে দিল কংগ্রেস। অচিরেই সেখানকার জন্য হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, মেট্রো রেল, উড়ালপুল, বিমানবন্দর ইত্যাদি ঢালাও ঘোষণা করবে কংগ্রেস। যাতে ভবিষ্যতে জমি না হারাতে হয় তাদের। বস্তুত, রাজ্য ভাগের জন্য সীমান্ধ্র যাতে কংগ্রেসকে একেবারে খলনায়ক বলে ছাপ না মেরে দেয়, সে জন্য আজ রাজ্যসভার বিতর্কে রাহুল কৌশলে এগিয়ে দেন জনপ্রিয় তেলুগু অভিনেতা তথা দলীয় সাংসদ চিরঞ্জীবীকে। তিনি রাজ্য ভাগ নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন ঠিকই। কিন্তু এ-ও বলেন, “বিজেপি, চন্দ্রবাবু নায়ডু আর জগন্মোহন কংগ্রেসকে এই অবস্থান নিতে বাধ্য করেছেন। তাঁরা বারবার তেলঙ্গানা গিয়ে সেই আবেগ উস্কে দিয়েছেন। আমরা চাইব, সীমান্ধ্রও যেন বঞ্চিত না হয়।”
বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন...
আর নতুন রাজ্য গড়ার আবেগে ভর করে তেলঙ্গানায় ভাল ফলের আশা করছে কংগ্রেস। দলীয় সূত্রে বলা
হচ্ছে, লোকসভা ভোটের আগেই কংগ্রেসে মিশে যেতে পারে টিআরএস। সেটা হলে তো আরও ভাল। অন্য দিকে, অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রীর পদে সদ্য ইস্তফা দেওয়া কিরণকুমার রেড্ডি যদি নতুন দল করেন, তা হলে সমস্যা বাড়বে জগন্মোহনের। ফলে পরোক্ষে লাভ হতে পারে কংগ্রেসেরই। এই হিসেব কষেই এগোচ্ছেন কংগ্রেস নেতারা। যদিও চিরঞ্জীবীর দুঃখপ্রকাশকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি। তিনি বলেছেন, “এ এক অদ্ভুত কাণ্ড! সরকারের মন্ত্রীই কেন্দ্রের বিলের বিরোধিতা করছেন।” আবার বিতর্কে অংশ নিয়ে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, তেলঙ্গানা রাজ্য গঠন দেশ জুড়ে পৃথক রাজ্য গঠনের আন্দোলনকে উস্কে দেবে। পশ্চিমবঙ্গে গোর্খাল্যান্ড সমস্যা আবার মাথাচাড়া দেবে। এর বিপরীতে রাজ্যভাগে সায় দিয়ে বিএসপি নেত্রী মায়াবতী দাবি করেন, এ বার উত্তরপ্রদেশ ভেঙে চারটি নতুন রাজ্য তৈরি করতে হবে। মহারাষ্ট্র ভাগ করে গড়তে হবে বিদর্ভ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, নতুন রাজ্য তৈরি হলেও এত সহজে তেলঙ্গানা বিতর্ক না-ও মিটতে পারে। এর বড় কারণ হায়দরাবাদ। দুই পক্ষের মূল বিবাদ তো নিজামের শহরের দখলদারি নিয়েই। ঐতিহাসিক ভাবে এই শহর তেলঙ্গানার অংশ হলেও, এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে রায়লসীমা ও উপকূল অন্ধ্রের আবেগ, রাজনীতি ও বাণিজ্যিক স্বার্থ। তা ছাড়া রইল সাংবিধানিক প্রশ্নও। এই প্রথম এক রাজ্যপালের হাতে দীর্ঘ সময়ের জন্য দুই রাজ্যের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা কতটা সংবিধানসম্মত, সেটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েই গেল।
সরকারের অবশ্য বক্তব্য, এই সবের জবাব খোঁজার সুযোগ ভবিষ্যতেও থাকবে। আপাতত রাজ্য গঠন যে হল, সেটাই বড় বিষয়।

বিজেপি, চন্দ্রবাবু নায়ডু আর জগন্মোহন কংগ্রেসকে এই অবস্থান নিতে বাধ্য করেছেন। তাঁরা বারবার তেলঙ্গানা গিয়ে সেই আবেগ উস্কে দিয়েছেন। আমরা চাইব, সীমান্ধ্রও যেন বঞ্চিত না হয়।
চিরঞ্জীবী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.