|
|
|
|
জানলার কাচে আছড়ে পড়ছে বরফ-বুলেট
সুচেতনা মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী • নিউ ইয়র্ক |
ছোটবেলায় বড় সাধ ছিল, বরফ পড়া দেখব। কিন্তু সে ইচ্ছে যে এত ভয়াবহ হতে পারে, কখনও কল্পনাও করিনি!
দিনটা ১৩ ফেব্রুয়ারি। আমেরিকার অন্য জায়গাগুলোর মতো নিউ ইয়র্কেরও থমথমে দশা। যেন কার্ফু লেগেছে। ম্যানহাটনের দৈত্যাকার বাড়িগুলোর মাথায় থমথম করছে লালচে আকাশ। সন্ধে নামতেই ব্রডওয়ে খাঁ খাঁ। পোর্ট অথরিটি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতেই দেখি লম্বা লাইন। রীতিমতো ঠেলাঠেলি, কে কার আগে গাড়ি ধরতে পারে। আবহাওয়া দফতর যে লাল সঙ্কেত দেখিয়েছে। এ বার ‘প্যাক্স’ আসছে।
হাডসন নদীর নীচে লিঙ্কন টানেলে নাকি আগেভাগেই নামানো হয়েছে তিন-তিনটে বরফ পরিষ্কারের যন্ত্র। নেমেছে সেনাও। স্কুলগুলো দু’দিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করেছে। চরম দুর্ভোগে বিমানযাত্রীরা। ক’দিনে হাজার খানেক উড়ান বাতিল হয়েছে। যে ক’টা বিমান উড়েছে, নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। বরফ-ঠান্ডার মধ্যেই বিমানবন্দরে বন্দি বহু মানুষ। |
|
পথ ঢেকেছে বরফে। নিউ ইয়র্কে। |
গত কয়েক মাস ধরেই তুষারঝড়ে বিধ্বস্ত আমেরিকা। সেই ডিসেম্বর থেকে ‘অ্যাটলাস’, ‘বোরিয়েস’, ‘হারকিউলিস’, ‘ইওন’ আর তার পর এ বার ‘প্যাক্স’ একের পর এক ঝড়ে নাকাল বারাক ওবামার দেশ। এর মধ্যে উত্তর-পূর্ব আমেরিকার আটলান্টিক উপকূলের রাজ্যগুলিতে ঝড়ের প্রকোপ বেশি। আবহবিদরা কাঠগড়ায় তুলেছেন বিশ্ব উষ্ণায়নকে। মেক্সিকান গরম হাওয়ার স্রোত কানাডিয়ান শীতল স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়েই উত্তর-দক্ষিণ ক্যারোলাইনা, ওয়াশিংটন ডিসি, পেনসিলভ্যানিয়া, নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক ও মেইন-এর মতো রাজ্যগুলোতে প্রবল তুষারপাত ঘটাচ্ছে। সেই সঙ্গে উত্তরমেরুর ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে আসছে আমেরিকার ওই অংশগুলোতে। আবহবিদরা প্রকৃতির এই খেল্-এর নাম দিয়েছেন, ‘পোলার ভর্টেক্স’।
হাডসন নদীর ও পারে নিউ জার্সির ইন্ডিয়া স্ট্রিট-ও ঘরবন্দি। ঘরে ঘরে ফায়ারপ্লেস। টিভিতে ঘুরেফিরে আবহাওয়ার চ্যানেল। বাইরে তখন ঘণ্টায় ৪০ মাইল বেগে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া হুঙ্কার ছাড়ছে। গত বার ঝড়ের পর আলাস্কার হিমবাহের মতো রাস্তার দু’পাশে পাহাড়প্রমাণ বরফ জমেছিল। দিনের বেলায় যদি বা সূর্যদেবের দেখা মেলে, বরফ গলে যাওয়ার পর আর এক বিপত্তি। ভিজে রাস্তায় সাধারণ মানুষের অবস্থা ‘হ্যাপি ফিট’-এর সেই পেঙ্গুইনগুলোর মতো। পা চেপে চেপে না হাঁটলেই কপালে বিপদ নাচছে। প্রতিবেশী স্বাতী ভট্টাচার্য পিছলে পড়ে হাত ভেঙেছেন। একই দশা
আরও অনেকের। |
|
বাইরে চলছে তুষার-ঝড়। নিউ ইয়র্কে। |
আবহাওয়া চ্যানেল বলছে, উত্তর মিসিসিপি থেকে আলাবামা, জর্জিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ক্যারোলাইনাতে ইতিমধ্যেই ঝড় আছড়ে পড়েছে। এ বার ফিলাডেলফিয়া, ওয়াশিংটন ডি সি, বাল্টিমোর হয়ে ঝড় ছুটছে নিউ জার্সি আর নিউ ইয়র্কের দিকে। সন্ধে থেকেই তাই ভিড় ইন্ডিয়া স্ট্রিটের আপনা বাজারে। সকলেই ঘরে খাবার ও পানীয় জল মজুত করে রাখছেন। বলা যায় না, কী হয়!
ঝড় আসার কথা ছিল রাত সাড়ে এগারোটায়। তার পর আবহাওয়া চ্যানেলগুলোর দাবি অনুযায়ী পিছিয়ে হল দেড়টা। ঘড়িতে দু’টো বাজল। কিন্তু কই? ঝড় তো এল না।
মাঝরাতে হঠাৎই ঘুম ভাঙল একটা বিদঘুটে শব্দে। ধড়ফড়িয়ে উঠে এক দৌড়ে জানলার সামনে। বরফের পরতে জানলার কাচ আবছা। শুধু বোঝা যাচ্ছে, বাইরে অবিরাম তুষারধারা ভেঙে দিচ্ছে রাতের নিস্তব্ধতা। জানলার কাচে আছড়ে পড়ছে বরফ-বুলেট। ঘড়ির কাঁটা জানান দিল ভোর তখন পাঁচটা। ঝড় থামল বেলা দেড়টায়। শুরু হল বৃষ্টি।
পরের কয়েকটা দিন পাড়ার প্রায় সব বাসিন্দাই ঘরবন্দি ছিলেন।
৮ ইঞ্চি পুরু বরফের চাদরে মুখ ঢেকেছিল রাস্তা। তাপমাত্রা -১২ ডিগ্রি থেকে -১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘরের হিটিং সিস্টেম চালু থাকা সত্ত্বেও হাড়কাঁপুনি ঠান্ডা। আর মাঝেমধ্যে নিস্তব্ধতা খান খান করে দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন।
ঝড় এখন থেমেছে। যদিও এখনও বরফের চাদরে মুখ ঢেকে আছে নিউ ইয়র্ক। ইতিমধ্যে এসেছিল ‘রেকস’। আবহ দফতর হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, ‘সেনেকা’ আসছে। তবু তারই মধ্যে খুশির খবর। টিভির পর্দার নীচে লাল সঙ্কেতের পাশেই ছোট ছোট হরফে লেখা ‘বসন্ত আসছে ১৯ মার্চ’।
|
ছবি: নির্মাল্য চক্রবর্তী। |
|
|
|
|
|