সার দিয়ে দাঁড়ানো এগারো জনকে খুঁটিয়ে দেখছিল বছর পাঁচেকের চোখ। পায়ে-পায়ে শিশুটি এক-এক জনকে পেরিয়ে এগোল। তার পরে এক জনের গায়ে হাত দিয়ে বলে উঠল, “একে আমি চিনি। এ-ই তো আমার মাকে মেরেছে।”
গত ১৬ জানুয়ারি কাটোয়ার সিপাইদিঘি মোড়ের কাছে সর্ষেখেতে মিলেছিল মুর্শিদাবাদের লালবাগের বাসিন্দা সাবিনা বিবির দেহ। পাশে বসে কাঁদছিল শিশুটি। পুলিশকে সে জানিয়েছিল, মায়ের সঙ্গে সেখানে পৌঁছেছিল সে। সঙ্গে ছিল এক ‘অচেনা কাকু’।
ঘটনার দিন দশেক পরে মোবাইলের গতিবিধি অনুসরণ করে মঙ্গলকোটের দুরমুট থেকে পুলিশ হাফিজুর ওরফে রাজা শেখ নামে এক যুবককে ধরে। বুধবার দুপুরে কাটোয়া উপ-সংশোধনাগারে এসে হাফিজুরকেই সেই ‘কাকু’ হিসেবে শিশুটি শনাক্ত করেছে বলে সংশোধনাগার সূত্রে জানা গিয়েছে। হাফিজুরকে শনাক্ত করেন সাবিনার দুই বৌদি পরিমানু বিবি ও মেমবালিকা বিবিও। তাঁরা জানান, জেল থেকে বেরোনোর পরেই ‘মা-মা’ বলে কেঁদে ওঠে শিশুটি। |
সংশোধনাগার সূত্রের খবর, শিশুটিকে নিয়ে এ দিন দুপুরে মুর্শিদাবাদ থেকে আসেন পরিমানু বিবিরা। প্রথমে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় জেলার শান্তনু ঘোষের ঘরে। সেখান থেকে একে-একে তাঁরা অভিযুক্তকে শনাক্ত করতে ভিতরে যান। সব শেষে যায় শিশুটি। তখন সেখানে হাজির কাটোয়ার এসিজেএম (২) উদয় রানা ও জেলার শান্তনুবাবু। সংশোধনাগারের পুলিশকর্মীরা জানান, সবুজ সোয়েটার ও কালো প্যান্ট পরা শিশুটি ঢুকতেই তাকে ডেকে নেন বিচারক। নাম-ঠিকানা জানার পরে দাঁড়িয়ে থাকা এগারো জনের দিকে দেখিয়ে জানতে চান, তাদের কাউকে সে চেনে কি না। বেশ কিছু ক্ষণ দেখার পরে এগিয়ে গিয়ে হাফিজুরের গায়ে হাত দেয় শিশুটি। বিচারকের দিকে ঘুরে জানিয়ে দেয়, এ-ই সেই ‘কাকু’। হাফিজুর তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
পুলিশের দাবি, জেরায় হাফিজুর তাদের জানিয়েছিল, স্বামী বিচ্ছিন্না সাবিনার সঙ্গে ফোনে ‘ক্রস কানেকশন’ থেকে তার আলাপ। বেশ কিছু দিন কথাবার্তার পরে সাবিনার বিয়ের প্রস্তাবে সে রাজি হয়। কিন্তু শর্ত দেয়, সাবিনাকে থাকতে হবে মুর্শিদাবাদেই। সে মাঝে-মধ্যে গিয়ে টাকা দিয়ে আসবে। কিন্তু ১৪ জানুয়ারি ছেলেকে নিয়ে কাটোয়ায় আসেন সাবিনা। পৌঁছে যান দুরমুটে। সেখানে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পরিত্যক্ত ঘরে রাত কাটান। তখন থেকেই সঙ্গে ছিল হাফিজুর। পর দিন সকালে তাঁরা ফের কাটোয়ায় আসেন। পুলিশের দাবি, হাফিজুর তাদের জানিয়েছে, ঘোরাফেরার ফাঁকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন সাবিনা। এমনকী, বিয়ে না করলে পুলিশে যাওয়ার হুমকিও দিচ্ছিলেন। সন্ধ্যায় তাঁরা ওই সর্ষেখেতে পৌঁছন। গল্প করতে করতে সাবিনা ও তাঁর ছেলে ঘুমিয়ে পড়েন। তার পরেই সাবিনাকে শ্বাসরোধ করে মেরে, ছেলেটির গায়ে চাদর চাপা দিয়ে সে পালায় বলে হাফিজুর স্বীকার করেছে, দাবি পুলিশের।
পুলিশ জানায়, হাফিজুর এক বার সাবিনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল মুর্শিদাবাদে। তখন তাকে দেখেছিলেন সাবিনার দুই বৌদি ও এক মামিমা। সেই মামিমা অসুস্থ থাকায় অভিযুক্তকে শনাক্ত করতে আসতে পারেননি। পরিমানু বিবি বলেন, “সাবিনার ছেলে আমাদের কাছেই থাকে। মা মারা গিয়েছে জানার পরেও ওর চোখে জল দেখিনি। কিন্তু আজ জেল থেকে বেরোনোর পরেই ও ‘মা-মা’ করে খুব কাঁদছে।”
শিশু-মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ তাপসী মিত্রের মতে, “শিশুটি হয়তো ধীরে ধীরে ওই ঘটনা ভুলছিল। কিন্তু ওই যুবককে দেখার পরে তার স্মৃতিতে ফের ঘটনাটি ঘা দিয়েছে। মা আর তার কাছে নেই আর তার পিছনে এই লোকটির হাত রয়েছে, তা বুঝেই বোধ হয় এ রকম আচরণ করছে ও।” |