যে জন আছে মাঝখানে!
স্বাস্থ্য পরিষেবায় সারা দেশের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তাঁর মতে, বিহার বা ছত্তীসগঢ়ের তুলনায় বাংলার অবস্থা ভাল। কিন্তু তামিলনাড়ু বা কেরলের তুলনায় এ রাজ্য অনেক পিছিয়ে। সামনের সারিতে আসতে হলে পশ্চিমবঙ্গকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের উপরে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
বুধবার স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালার সমাপ্তির পরে সাংবাদিক বৈঠকে অমর্ত্যবাবু বলেন, শিক্ষার সঙ্গে স্বাস্থ্যের উন্নতি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। বাম আমলে কেরল বা ত্রিপুরায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হলেও এ রাজ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি।
গত তিন বছরে রাজ্যে কি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কোনও উন্নতি হয়নি?
সময় নির্দিষ্ট করে সরাসরি মন্তব্য করেননি অমর্ত্যবাবু। তবে বলেন, পরিবার পরিকল্পনার মতো কিছু ক্ষেত্রে এ রাজ্যের পরিস্থিতি যথেষ্ট ভাল। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্য, টিকাকরণ কর্মসূচি, কর্মীদের দায়বদ্ধতা ইত্যাদির উপরে আরও বেশি জোর দিতে হবে।
কী ভাবে গুরুত্ব বাড়াতে হবে, তারও হদিস দেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। তিনি জানান, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। শুধু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, সেখানে পরিকাঠামো রাখতে হবে। “আর সব কেন্দ্রে কর্মীদের উপস্থিতি জরুরি। অনেক দূর থেকে রোগী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছে শুনলেন, সেখানে ডাক্তার নেই। তা হলে তো রোগীর যাতায়াতের ধকলটাই বৃথা হয়ে গেল। এ বিষয়টা সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে,” পরামর্শ অমর্ত্যবাবুর। |
কমিউনিস্ট পার্টি কেরলে শিক্ষা এবং তারই হাত ধরে স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি ঘটালেও পশ্চিমবঙ্গে তেমন অগ্রগতি হয়নি বলে অমর্ত্যবাবু খেদ প্রকাশ করেন। বলেন, “কেরলে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। শুনলাম, সেখানে মুদির দোকানে ওষুধ পাওয়া যায়। ওষুধ কেনার সময় এক মুদি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কোনও অ্যালার্জি আছে কি না। এই সচেতনতা এ রাজ্যে কল্পনাও করা যায় না।” হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইউনিয়নের অতিসক্রিয়তারও সমালোচনা করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কোনও রকম তোপ দাগছি না। কিন্তু কাজের সময়ে যে কাজের জায়গায় থাকাটাই বেশি জরুরি, এটা কর্মীদের বোঝানো উচিত ইউনিয়নের। এ রাজ্যে এটা নিশ্চিত করতে হবে।”
স্বাস্থ্য পরিষেবা বিপণনেরও বিরোধিতা করেছেন অমর্ত্যবাবু। তাঁর মতে, “স্বাস্থ্য পরিষেবার অবাধ বিপণন দেশের ক্ষতি করছে। বেসরকারি অংশগ্রহণ জরুরি ঠিকই, কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় থাকাটা তার চেয়েও জরুরি। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার দায়িত্বটা সব সময়েই সরকারের হাতে থাকা উচিত।”
ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি সংক্রান্ত একটি কর্মশালায় যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। স্বাস্থ্য পরিষেবায় চিন, তাইল্যান্ড, এমনকী বাংলাদেশও কী ভাবে ভারতকে ছাপিয়ে গিয়েছে, তার উল্লেখ করেন তিনি। অমর্ত্যবাবুর মতে, স্বাস্থ্য পরিষেবা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তার জন্য যথাযথ মনোযোগ এবং যোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন। যাঁরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন, তেমন কর্মীদের আচমকা বদলি করলে কাজের গতি ব্যাহত হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এই প্রসঙ্গেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব কেশব দেশিরাজুর বদলি-বিতর্কের বিষয়টি উঠে আসে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিবকে সম্প্রতি অন্য দফতরে বদলি করা নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্ক চলছে। অমর্ত্যবাবু বলেন, “তামাক নিয়ন্ত্রণ, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করছিলেন দেশিরাজু। জানি না, কেন তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হল। কারণ যা-ই হোক, আমি খুবই অবাক হয়েছি।” |