দীর্ঘদিন বাদে পুরুলিয়ায় কংগ্রেসের কোনও জনসভায় উপচে পড়া ভিড় হল। কিন্তু, সে-সবকে ছাপিয়ে গেল আর এক কাণ্ড!
এক জন সদ্য তৃণমূল ছেড়ে দলে ফিরেছেন। অন্য জন আগেই রাজ্যের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেছেন। বুধবার পুরুলিয়া শহরের রাস ময়দানে জেলা কংগ্রেসের আয়োজিত সভায় হাজির ছিলেন সেই দুই নেতাই। |
এক জন সোমেন মিত্র, অন্য জন মানস ভুঁইয়া। রাজ্য সরকারের নানাবিধ কাজকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সেই সভায় জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অর্ণবী সেন বক্তব্য রাখার সময় মঞ্চে ওঠেন সোমেন মিত্র, মানস ভুঁইয়া, বিধায়ক অসিত মাল, যোশেফ মুন্ডা, আবু তাহের খান প্রমুখ। এর পরেই কংগ্রেসের জেলা নেতা ও কর্মীদের মধ্যে মঞ্চে ওঠার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এমন সময় আচমকাই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল মঞ্চ!
সভা ঘিরে তখন চরম বিশৃঙ্খলা। সকলে এগিয়ে আসতে চাইছেন সামনের দিকে। নেতারা আহত হয়েছেন কি না, উদ্বেগ ছড়াচ্ছে কর্মীদের মধ্যে। ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়ালেন সোমেনবাবু, মানসবাবুরা। মানসবাবুকে দেখা গেল, কালচিনির বিধায়ক যোশেফ মুন্ডার বুকে মালিশ করে দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে শান্ত হল জনতা। টেবিল গুছিয়ে ফের শুরু হল সভা। দুর্ঘটনার পরে সোমেনবাবু বলেন, “আসলে মঞ্চে অনেক লোক উঠে পড়েছিল। তাই ভেঙে গিয়েছে। তবে, আমার লাগেনি।” মানসবাবু বলেন, “যোশেফের মাথায় একটু লেগেছিল। সেটাই পরীক্ষা করে দেখছিলাম।” |
|
|
ভিড়ের চাপে মঞ্চ ভাঙছে।
পড়ে যাচ্ছেন সোমেন মিত্র। |
ধরাধরি করে তোলার চেষ্টা
করছেন কংগ্রেসের নেতার-কর্মীরা। |
|
ঘটনার পরে বিধায়ক অসিত মালকে দেখা যায় মাথায় হাত দিয়ে দেখছেন কোথাও কেটে গিয়েছে কি না। পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণুচন্দ্র পালকে। তাঁর কথায়, “চেয়ারে বসেছিলাম। হঠাৎ মড়মড় করে ভেঙে পড়ল মঞ্চ। আমার উপরে অনেকে পড়ে গেলেন। বাঁ পায়ের হাঁটুতে প্রচণ্ড লেগেছে।”
মঞ্চ ভাঙুক বা যাই হোক, এ দিন কংগ্রেসের সভার ভিড় কিন্তু শহরের চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। ভিড়ের বহর নিয়ে কংগ্রেস ও শাসকদল তৃণমূলে শুরু হয়েছে মৃদু চাপানউতোরও। জেলা কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি, মাঠে তিল ধারণেরও জায়গা ছিল না। অন্তত ৪০ হাজার লোক হয়েছিল। যদিও জেলা পুলিশের হিসেবে সভায় ২০ হাজার মানুষ এসেছিলেন। আর জেলা পরিষদের সভাধিপতি, তৃণমূলের সৃষ্টিধর মাহাতো দাবি করেন, “কংগ্রেসের কিছু সমর্থন তো রয়েইছে। তবে দু’জন বিধায়ক, দু’টি পঞ্চায়েত সমিতি দখলে রাখা কংগ্রেসের আরও বেশি লোক হওয়া উচিত ছিল।”
এ দিনের সভায় তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারে অণ্ণা হজারের নামার আগ্রহ নিয়ে সমালোচনায় সরব হন কংগ্রেস নেতারা। মানসবাবু বলেন, “অণ্ণা কি সারদা কেলেঙ্কারির কথা জানেন?” ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে সেচমন্ত্রী হিসেবে তিনি রুখা-শুখা পুরুলিয়ার জন্য ছ’টি জলাধার গড়ার পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। সে কথা জানিয়ে মানসবাবুর কটাক্ষ, “সে-সবের কিছুই তো হয়নি। আর এই ক’বছরে পুরুলিয়া কী পেয়েছে?” সোমেন মিত্র বলেন, “এই সরকারের প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। কী অবস্থা রাজ্যের?” প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েও কটাক্ষ করেছেন সোমেনবাবু। জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতোও জেলার বঞ্চনার বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন। তিনি বলেন, “এই জেলার বঞ্চনার বিষয়ে বিধানসভায় প্রশ্ন করেও সদুত্তর মেলে না। তাই এ দিন আমরা মানুষের কাছে সব কথা বলতে এসেছি।” |
শেষে ভাঙা মঞ্চেই শুরু সভার কাজ। |
এ দিনের সভায় বিধায়ক নেপাল মাহাতোর এলাকা বাঘমুণ্ডি, বিধায়ক উমাপদ বাউরির এলাকা পাড়া ছাড়াও বলরামপুর, জয়পুর, কোটশিলা, পুরুলিয়া ১ ও ২, কাশীপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা এসেছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে বলরামপুরে শেষবার এত বড় সমাবেশ করেছিল কংগ্রেস। ফের লোকসভা নির্বাচনের আগে তাই এ দিনের সমাবেশে এত লোক দেখে তৃপ্ত জেলা কংগ্রেস নেতারা। দলের নেতা বিভাস দাসের দাবি, “আমাদের সমর্থন বরাবরই এই জেলায় ভাল ছিল। তৃণমূল সরকারের কাজে বিরক্ত হয়ে ইদানীং অনেকে কংগ্রেসে ফিরে আসছেন।”
সভা শেষেও অবশ্য দলীয় কর্মীদের মধ্যে ভিড় নিয়ে গরমাগরম আলোচনা চলতে দেখা গেল। সঙ্গে মঞ্চ ভাঙা নিয়ে কথাবার্তা। নেপালবাবুর কথায়, “বেশি লোক উঠে পড়াতেই এই বিপত্তি ঘটে গিয়েছে। তবে সভা চলাকালীন মঞ্চ ভেঙে যাওয়া আমাদের কাছে শুভ লক্ষণ। কেন না বাঘমুণ্ডিতে আমি যখন বিধানসভায় প্রার্থী হই, তখনও মঞ্চ ভেঙে পড়েছিল। আমি জিতেছিলাম।”
সে যাই হোক। দিনের শেষে পুরুলিয়া শহরের বুকে দলের এত ভিড় দেখে উচ্ছ্বসিত কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা বললেন, “লোকসভা ভোটের আগে লড়ার বাড়তি রসদ পেয়ে গেলাম আমরা।” |
ছবিগুলি ফ্রেমবন্দি করেছেন সুজিত মাহাতো। |